রাশেদুল ইসলাম
হজ্বে যাওয়া নিয়ে কথা
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ২০ জুন,মঙ্গলবার,২০২৩ | আপডেট: ০৯:৩৬ পিএম, ২৯ ডিসেম্বর,রবিবার,২০২৪
(তিন)
আমাকে দিনে রাতে দুবার ইনসুলিন নিতে হয় । ইনসুলিন মানে ইনজেকশন । শরীরে খোঁচাখুঁচি । এ কারণে ভয়ে অনেকে ইনসুলিন ব্যবহার করতে চান না । আমি অবশ্য ইনজেকশনে তেমন ভয় পাইনে । কারণ এসব মুহূর্তে আমি আব্দুল আলীমের একটি গানের কয়েক লাইন মনে করার চেষ্টা করি -
“পরের জাগা, পরের জমি,
ঘর বানাইয়া আমি রই,
আমি তো সেই ঘরের মালিক নই” ।
তারমানে আমার এই শরীর বা দেহ কাঠামো আমার নিজের নয় । শরীরটা পরের । আমি এখানে আশ্রয় নিয়েছি মাত্র । এ কারণেই একজন মুসলমান নারী বা পুরুষ মারা গেলে আমাদের বলতে হয়, ‘ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন’ ; অর্থাৎ, আমরা আল্লাহর কাছ থেকে এসেছি, আমাদের আল্লাহর কাছেই ফিরে যেতে হয়’। এর মাঝে নির্দিষ্ট কিছু সময়ের জন্য একটা শরীরে আমাদের আশ্রয় নিতে হয় ।
হিন্দু ধর্মেও একই কথা বলা হয় । একইভাবে সদ্য পিতৃহারা একটি সন্তান সবাইকে বলেন, ‘তাঁর বাবা দেহত্যাগ করেছেন’। তারমানে তাঁর বাবা একটি দেহের মধ্যে বাস করতেন । সেই দেহ ছেড়ে তিনি চলে গেছেন।
ইনজেকশন নেওয়ার সময় এ ধরণের চিন্তার কারণে বোধহয় আমার শরীরে ইনজেকশন দেওয়ার কোন ব্যাথা অনুভব করিনে । কারণ, শরীরটা তো আমার নিজের নয় ।
এসব অবশ্য আমার লেখার বিষয় নয় । আমার লেখার বিষয় আমার মত ইনসুলিন নেওয়া হজ্বযাত্রীদের সমস্যা নিয়ে । ইনসুলিন ফ্রিজে সংরক্ষণ করতে হয় । ১০ মিনিটের বেশি ইনসুলিন বাইরে রাখার নিয়ম নেই । এক্ষেত্রে হজ্ব যাত্রাপথের ১০/১২ ঘণ্টা ইনসুলিনের কি হবে ? লাজফার্মার একজন তরুণ বিক্রেতা জানান, ইনসেপ্টার এক ধরণের বক্স আছে, তাতে ইনসুলিন নিরাপদে বহন করা যেতে পারে। ১০/১২ ঘণ্টায় কোন অসুবিধা হবে না । ছেলেটি সেই ব্যাগের ব্যবহারবিধি আমাকে বুঝিয়ে দিয়ে বিনীতভাবে একটি অনুরোধ করেন । তাঁর অনুরোধের বিষয়, আমি যেন ক্বাবাশরীফে গিয়ে আল্লাহর দরবারে তাঁর ও তাঁর পরিবারের জন্য দোয়া করি । তাঁর পরিবারে যেন আর্থিক সুখ ও সচ্ছলতা আসে । আমি সম্মত হলে তাঁর মুখ খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে । তারমানে আমাদের সাধারণ ধর্ম বিশ্বাসী মানুষ শতভাগ বিশ্বাস করে, হজ্বে যাওয়া মানে আল্লাহর দরবারে হাজির হওয়ার মত বিষয়; যেখানে সরাসরি আল্লাহর কাছে দোয়ার মাধ্যমে নিজের এবং অন্যের জন্য ফরিয়াদ জানান এবং তার ফল পাওয়া সম্ভব ।
এখানে উল্লেখযোগ্য দুটি বিষয় ব্যাখ্যা করা যেতে পারে।
এক, আল্লাহর দরবার, দুই, দোয়া ।
দুটি বিষয়ই অদৃশ্যমান । আল্লাহর দরবার বলে দৃশ্যমান কিছু নেই বা দোয়ারও দৃশ্যমান কোন অস্তিত্ব নেই ।
এই অদৃশ্যমান আল্লাহ্ এবং তাঁর একক ক্ষমতার উপর বিশ্বাস স্থাপন একজন মুসলমান হওয়ার প্রথম শর্ত । পবিত্র কোরআনের মর্ম অনুযায়ী একজন মুসলমান দুটি গুণাবলীতে ভূষিত ।
এক, একজন মুসলমান বিশ্বাসী এবং
দুই, একজন মুসলমান সৎকর্মশীল ।
পবিত্র কোরআনে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে,
‘যারা বিশ্বাস করে এবং সৎকর্ম করে, তাদের কর্মফল হিসেবে তারা হবে জান্নাতের স্থায়ী মেহমান’ (আয়াত ১৯, সূরা সেজদা)।
হজ্বের বিষয়টি পুরোপুরি একজন মুসলমানের বিশ্বাস নির্ভর । বিশ্বাসের ক্ষেত্রে একজন মুসলমানের ৫ টি অবশ্য পালনীয় দায়িত্ব রয়েছে । তার একটি হজ্বব্রত পালন। একজন সচ্ছল মুসলমানের জন্য জীবনে একবার হজ্ব করা ফরজ বা অত্যাবশ্যক করা হয়েছে ।
মূলত সচ্ছল ব্যক্তিরাই সমাজের চাবিকাঠি । তাঁরাই সমাজের যাবতীয় কলকাঠি নাড়ে । তাই পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে,
‘কোন জনপদ ধ্বংস করার আগে আমি সেখানকার বিত্তবান ও প্রভাবশালী লোকদের সৎকর্ম করার নির্দেশ দিই’ (আয়াত ১৬, সূরা বনি ইসরাইল)।
মহান আল্লাহ্ মানুষকে তাঁর প্রতিনিধি নির্বাচন করে দুনিয়ায় পাঠিয়েছেন। সেদিক দিয়ে হজ্বকে আল্লাহর প্রতিনিধি সম্মেলন বলা যেতে পারে । হজ্বে কথাবার্তা তেমন কিছু নেই । হজ্বের যে ৩ টি ফরজ এবং ওয়াজিবের কথা বলা হয়েছে, সেখানেও অতিরিক্ত কথাবার্তার কিছু নেই । যেমন হজ্বের ৩টি ফরজ-
১। ইহরাম বাঁধা। ২। আরাফার ময়দানে অবস্থান এবং ৩। তওয়াফে জিয়ারত ।
হজ্বের ৬টি ওয়াজিব-
১। সাফা- মারওয়া সাঈ করা, ২। মুযদালিফায় রাত্রি যাপন, ৩। মিনায় কংকর নিক্ষেপ ৪। কোরবানি করা ৫। মাথা মুন্ডানো এবং ৬। বিদায়ী তওয়াফ ।
তারমানে হজ্বের ফরজ বা ওয়াজিব পালনের ক্ষেত্রে কথাবার্তার তেমন কিছু নেই । বার বার শুধু বলা,
‘লাব্বাইয়কা আল্লাহুমা লাব্বাইক,
লাব্বাইকা লা শারীকা লাকা লাব্বাইক ।
ইন্নাল হামদা ওয়ান্নি’মাতা লাকা ওয়াল মূলক
লা শারিকা লাক’ ।
বাংলা অর্থে-
আমি হাজির, আয় আল্লাহ্ ! আমি হাজির !
আমি হাজির তোমার কোন শরিক নেই,
আমি হাজির ।
নিশ্চয়ই সকল প্রশংসা ও নিয়ামত তোমারই ।
আর সকল রাষ্ট্র ও রাজ্য একমাত্র তোমার ।
তোমার কোন শরিক নেই’ ।
ফলে আপাতদৃষ্টিতে সুনির্দিষ্ট ৫ টি দিনে (৮ যিলহজ্ব থেকে ১২ যিলহজ্ব) ৫ টি স্থানে সুশৃঙ্খলভাবে যথানিয়মে ৯ টি (ফরজ ও ওয়াজিব) ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান পালন করার নাম হজ্ব । কিন্তু প্রকৃত পক্ষে গোটা বিষয়টি মনস্তাত্ত্বিক -বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে থাকা ধর্ম বিশ্বাসী আল্লাহভীরু (মুত্তাকিন) মুসলমানদের মহাপ্রভু আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের একটি আধ্যাত্মিক যাত্রার নাম হজ্ব।
হজ্বের বিভিন্ন করণীয় বিশ্লেষণ করা হলে বিষয়টি আরও পরিস্কার হতে পারে ।
মহান আল্লাহ্ আমাদের হজ্বকে সহজ করে দিন এবং তা কবুল করুন ।
দোয়া চাই সকলের ।
(চলমান)