রাশেদুল ইসলাম
প্রাথমিক শিক্ষায় শুদ্ধাচার অনুশীলন কর্মশালাঃ পটভূমি
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ৮ জুলাই,সোমবার,২০২৪ | আপডেট: ০২:২৪ পিএম, ৭ ডিসেম্বর,শনিবার,২০২৪
আমাদের সমাজে চলমান দুর্নীতি ও বিভিন্ন প্রকার অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের দীর্ঘমেয়াদী সমাধানের উপায় হিসেবে অর্পণ- দর্পণ স্মৃতি ফাউন্ডেশন আয়োজিত ‘প্রাথমিক শিক্ষায় শুদ্ধাচার অনুশীলন’ শীর্ষক কর্মশালা জুলাই ০৬, ২০২৪ তারিখে ঢাকা অফিসারর্স ক্লাবে অনুষ্ঠিত হয় । কর্মশালার প্রথম পর্বে বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনের চেয়ারম্যান জনাব মোঃ সোহরাব হোসাইন এবং সমাপনী পর্বে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে নিয়োজিত মাননীয় প্রতিমন্ত্রী মিজ রুমানা আলী এমপি প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন । দু’টি পর্বে বিভক্ত এ কর্মশালার প্রথম ও দ্বিতীয় পর্ব যথাক্রমে অর্পণ--দর্পণ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক শারমিনা পারভিন এবং ঢাকা স্কুল অব ইকোনোমিকস এর চেয়ারম্যান কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ এঁর সভাপতিত্বে পরিচালিত হয় । এখানে অর্পণ- দর্পণ স্মৃতি ফাউন্ডেশন কোন পরিস্থিতিতে কেন এ ধরণের কর্মশালার আয়োজন করে, তার একটি পটভূমি তুলে ধরা হোল ।
অর্পণ দর্পণ দু’ভাই । আমাদের অকাল প্রয়াত দু’টি শিশু সন্তান । সাদমান আবসার অর্পণ ১৯৯২ সালে এবং আদনান রাশেদ দর্পণ ১৯৯৪ সালে মৃত্যুবরণ করে । আমাদের সমাজে শিশুদের নিষ্পাপ ফেরেস্তা হিসেবে গণ্য করা হয় । তারমানে ছেলে দুটি নিস্পাপ শিশু অবস্থায় মারা গেছে। তাদের স্মৃতি রক্ষার জন্যই ২০১৬ সালে অর্পণ- দর্পণ স্মৃতি ফাউন্ডেশন আনুষ্ঠানিক ভাবে প্রতিষ্ঠা করা হয় । প্রথমে প্রশ্ন আসে, এই প্রতিষ্ঠানের কাজ কি হবে ? সে সময় আমার মাথায় আসে, ছেলে দু’টি নিস্পাপ অবস্থায় মারা না গিয়ে, যদি বেঁচে থাকত, তাহলে তারা কি করত? একটা নিস্পাপ বড় মানুষ কি কাজ করে ? নিশ্চয় তারা সব ভালো কাজ করে । তাহলে অর্পণ- দর্পণ স্মৃতি ফাউন্ডেশন দুনিয়ার সব ভালো কাজ করবে।
কিন্তু, প্রশ্ন আসে, দুনিয়ার সব ভালো কাজ কি একজন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের পক্ষে করা সম্ভব ? নিশ্চয়ই নয় । এই ধারণা থেকেই আমরা আমাদের কাজকে দু’ভাগে ভাগ করি ।
এক- নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী ভালো কাজ করা এবং
দুই- অন্যকে ভালো কাজে উদ্বুদ্ধ করা ।
নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী ভালো কাজ করার জন্যই আমরা আমার নিজ গ্রাম যশোর জেলার চৌগাছা উপজেলার মুক্তারপুর গ্রামে ‘অর্পণ- দর্পণ স্মৃতি পাঠাগার’ গড়ে তুলি । এই পাঠাগারের মাধ্যমে আমরা নিজেদের সামর্থ্য অনুযায়ী এলাকার মানুষের জন্য কল্যাণকর বিভিন্ন কাজ করে থাকি। যেমন, চলতি ২০২৪ সালে আমাদের ইউনিয়নের বিভিন্ন স্কুল ও মাদ্রাসার ৬০ জন শিক্ষার্থীকে সুফিয়া খাতুন শিক্ষা বৃত্তি প্রদান করা হয়েছে । এবার কোরবানি ঈদে পাঠাগারে যে গরুটি কোরবানি দেওয়া হয়েছে, তা দিয়ে এলাকার ৮০ টি অসচ্ছল পরিবারের মধ্যে মাংশ বিতরণ করা সম্ভব হয়েছে ।
দর্পণ- দর্পণ স্মৃতি পাঠাগারকে আমরা আসলে একটি ‘নলেজ হাব’ হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করছি, যেন এলাকার সকল শ্রেণিপেশার মানুষ পাঠাগার থেকে তাঁদের জীবিকা নির্বাহসহ যে কোন বিষয়ে প্রয়োজনীয় সাহায্য ও পরামর্শ পেতে পারে ।
ফাউন্ডেশনের দ্বিতীয় লক্ষ্য অন্যকে ভালো কাজে উদ্বুদ্ধ করা । এই লক্ষ্য পূরণের জন্য ২০১৫ সাল থেকে আমি লেখালেখি শুরু করি । আমার লেখা ১০ টি বই এখন বাজারে । বইগুলো Motivational; মানুষকে ভালো কাজে উদ্বুদ্ধ করার জন্য লেখা । কিন্তু বই লেখার ক্ষেত্রে প্রশ্ন আসে, আমার লেখা পড়ে একজন মানুষ ভালো কাজ করবে কেন ? পরের প্রশ্ন, তাহলে সমাজে মানুষ ভালো কাজ কেন করে ? এ প্রশ্নের উত্তরে দেখা যায়, সমাজের মানুষ মূলত ধর্মীয় কারণে বিভিন্ন ভালো কাজ করে থাকে । মৃত্যুর পর স্বর্গ বা বেহেশত লাভ করা, দোযখ বা নরকের আযাব থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্যই মানুষ মূলত সমাজে ভালো কাজ করে থাকে। এই ধারণা থেকেই আমাকে ধর্মের উপর পড়াশুনা করতে হয় এবং আমার লেখার মধ্যে ধর্মের প্রভাব চলে আসে । কিন্তু, ধর্মের উপর পড়াশুনা করতে গিয়েই আমি ভীষণ অবাক হই । ধর্ম পড়তে গিয়ে জানতে পারি, আমরা যে দুনিয়ার সব ভালো কাজ করতে চাই, এটা আমার আবিস্কার নয় । এটাই সকল ধর্মের বিধান ।
যেমন পবিত্র কোরআনে সূরা মূলক এর ২ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে,
‘তোমাদের মধ্যে সৎকাজে কে এগিয়ে আছে তা পরীক্ষা করার জন্যই জীবন ও মৃত্যুর ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। তারমানে ভালো কাজ করার জন্যই আল্লাহ মানুষ সৃষ্টি করেছেন । ফলে, মানুষ ভালো কাজ করবে- এটাই স্বাভাবিক।
স্বামী বিবেকানন্দ সনাতন হিন্দু ধর্মের সারকথা একটি মাত্র বাক্যে প্রকাশ করেছেন ।
তিনি বলেছেন,
“জীবে প্রেম করে যেই জন,
সেই জন সেবিছে ঈশ্বর”।
স্বামী বিবেকানন্দের মতে, ঈশ্বর সর্বত্র বিরাজমান । তিনি হিন্দু ধর্মকে সর্বেশ্বরবাদ তত্ত্বের উপর দাঁড় করিয়েছেন। আমরা যে দেশকে মায়ের সাথে তুলনা করি; গলা মিলিয়ে সবার সাথে রবীন্দ্র সঙ্গীত গাই -
ও আমার দেশের মাটি,
তোমার ‘পরে ঠেকাই মাথা’ - এ জাতীয় গান স্বামী বিবেকানন্দের সর্বেশ্বরবাদ তত্ত্বের উপর রচিত ।
তারমানে স্বামী বিবেকানন্দের মতে সকল প্রকার জীব জগতকে সেবা করার মাধ্যমেই মানুষ ঈশ্বরের আনুকূল্য পেতে পারে ।
আমার মাথায় প্রশ্ন আসে, এই যদি সকল ধর্মের বিধান হয়, তাহলে সমাজে মানুষ ভালো কাজ করে না কেন ? মানুষ মানুষের উপকার করে না কেন ? একজন ধার্মিক মানুষ কেন বলে, ‘আমি মানুষের উপকার করিনে, কারণ, কারো উপকার করলে নিজেই বিপদে পড়তে হয়’ ! যে দেশের মানুষ ধর্মের জন্য জীবন দিতে দ্বিধাবোধ করে না, সেই দেশের মানুষ ধর্মের বিধান অনুযায়ী মানুষের কাজে লাগে না কেন ?
এ প্রশ্নের জবাব পেতে আমাকে ইতিহাসের দিকে তাকাতে হয় । ইতিহাস পড়ে আমার মনে হয়েছে, শুধু আমাদের দেশ নয়, গোটা ভারত উপমহাদেশে সেই আদিকাল থেকে ধর্মকে চার দেয়ালের মধ্যে রাখা হয়েছে । ধর্মকে কখনো চার দেওয়ালের বাইরে আনা হয়নি । ‘আল্লাহ আমাকে রক্ষা করো, ভগবান আমাকে রক্ষা করো বা ঈশ্বর আমাকে রক্ষা করো’ –এগুলো সব চার দেওয়ালের মধ্যের ব্যাপার । চার দেওয়ালের বাইরে আনা হয়নি । চার দেওয়ালের বাইরে মানুষের যে ধর্মপালন - তা মূলত উৎসব । এ কারণে এই উপমহাদেশে মানুষ ধর্মের কাজ এবং অধর্মের কাজ একই সাথে করে থাকে । যিনি নামাজ পড়েন, তিনিই ঘুষ খান । যিনি পূজা অর্চনা করেন, তিনিই অন্যের ক্ষতি করেন । ফলে, আমাদের দেশে ধর্ম এবং কর্মের অবস্থান সমান্তরাল- রেল লাইনের মত । ধর্ম এবং কর্মের মাঝে একটা বড় ব্যবধান রয়ে গেছে ।
তাহলে আমরা যদি ধর্মের কথা বলে মানুষকে ভালো কাজে উদ্বুদ্ধ করতে চাই, সঙ্গত কারণেই তা কার্যকর হবার কথা নয় । যদি ধর্ম এবং কর্মের ব্যবধান কমানো যায়, তাহলেই তা সম্ভব । সেক্ষেত্রে প্রথমে জানা দরকার ধর্ম ও কর্মের মাঝখানে কি আছে ?
আমরা লক্ষ্য করি আমাদের দেশে ধর্ম এবং কর্মের মাঝখানে ঢুকে আছে মিথ্যা। এই মিথ্যাকে অপসারণ করা গেলেই ধর্ম ও কর্মের ব্যবধান কমানো সম্ভব । বিষয়টি একটা উদাহরণ দিয়ে সুস্পষ্ট করা যেতে পারে । একজন নানা তাঁর নাতিকে ঘাড়ে নিয়ে বেড়াতে বেরিয়েছেন । জানা গেলো, কাছেই একটা চোর ধরা পড়েছে, সবাই চোরকে বেদম পেটাচ্ছে । নাতি আবদার করলো, সে চোর দেখতে চায় । বাধ্য হয়ে নানা ভিড় লক্ষ্য করে চোরের দিকে এগুতে থাকেন । নাতি যেহেতু নানার ঘাড়ের উপরে বসা, সে অনেক আগেই দেখতে পায় । সে বলে ওঠে, ‘নানা, আমি দেখেছি, এতো চোর নয় ! এতো মানুষ’ !!
যারা চোরকে ধরে মারছে এবং যারা তাঁদেরকে ঘিরে দাঁড়িয়ে সেই দৃশ্য দেখছেন, তারা সবাই বলছেন সে চোর; কিন্তু এই বাচ্চা ছেলেটি বলছে, সে চোর নয়; সে মানুষ । কিন্তু, কেন ?
কারণ, এই শিশুটির চোখে এখনো সামাজিক মিথ্যার আবরন পড়েনি । এই শিশু ছেলেটিই কয়েকদিন পরে সবার সাথে অন্যের কথা শুনে চোরকে চোর বলবে, মানুষ বলবে না ।
এখন সেই চোরের কথা বলি । আসলে চোরের বাড়ির কেউই গত দু’দিন খাবার খেতে পায়নি । তাঁর বৃদ্ধ দাদি তাকে বলেছেন, “যেখান থেকে পারিস, ভাত যোগাড় করে আন, আমি খিদে সহ্য করতে পারছিনে”। সেই যুবক তাঁর দাদির জন্য হোটেলে ভাত চুরি করতে গিয়েই ধরা পড়ে । এই চোরকে মারার আগে তাঁকে যদি জিজ্ঞাসা করা হতো, কেন সে চুরি করেছে ? তাহলে সে তার চুরি করার কারণ বলত । সেক্ষেত্রে চুরির অভিযোগে না মেরে, কেউ না কেউ, তাঁকে সাহায্য করত । কিন্তু, এখানে যে সমস্যা তৈরি হয়েছে, তা মূলত সামাজিক মিথ্যার কারণে ।
নানা নাতির ঘটনার ব্যাখ্যা থেকে আমাদের মাথায় একটা উপায় আসে । এদেশে মানুষকে দিয়ে ভালো কাজ করাতে হলে, সমাজকে আগে মিথ্যামুক্ত করতে হবে । এই ধারণা থেকেই অর্পণ- দর্পণ স্মৃতি ফাউন্ডেশন ২০২২ সালের ৯ এপ্রিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি সেমিনার আয়োজন করে । সেমিনারের বিষয় ছিল, ‘সুপরিকল্পিত উপায়ে বাংলাদেশে মিথ্যামুক্ত সমাজ গঠন সম্ভব’ । সেমিনারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক ইসলামী চিন্তাবিত উপস্থিত ছিলেন । প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন, ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে নিয়োজিত মাননীয় প্রতিমন্ত্রী জনাব মোঃ ফরিদুল হক খান এমপি । সভাপতি হিসেবে ছিলেন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও ঢাকা স্কুল অব ইকোনোমিকস এর চেয়ারম্যান কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ।
সেদিনের সেমিনারের ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশে মিথ্যামুক্ত সমাজ গড়ার কৌশল নির্ধারণে ২০২২ সালের আগস্ট মাসে আমরা ঢাকাস্থ কৃষিবিদ ইন্সটিটিউশনে একটি কর্মশালা আয়োজন করি । কর্মশালায় প্রধান অতিথি ছিলেন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ কাজী খলীকুজ্জমান আহমেদ । সভাপতিত্ব করেন অর্পণ- দর্পণ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক শারমিনা পারভিন । এ কর্মশালার অনেকগুলো সুপারিশের মধ্যে একটি ছিল প্রাথমিক শিক্ষা পর্যায়ে শিশুকিশোরদের মধ্যে সত্যকথা বলার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে । এই সুপারিশের আলোকে আমরা মেহেরপুর জেলার ৫টি কিন্ডারগার্টেন স্কুলে ১১৫ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে সত্য অনুশীলন প্রতিযোগিতার আয়োজন করি। মেহেরপুরে অনুষ্ঠিত সেই প্রতিযোগিতার আহবায়ক ছিলেন গাংনীর অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক ও সমাজসেবক জনাব মোঃ সিরাজুল ইসলাম ।
সত্যিকার অর্থে মেহেরপুরের সেই সত্য অনুশীলন প্রতিযগিতা-২০২২ আমাদেরকে আলোড়িত করে। প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহনকারি শিক্ষার্থী, তাদের অভিভাবক, শ্রেণি শিক্ষক, প্রতিষ্ঠান পরিচালনা কমিটি, সকলের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহন আমাদের মুগ্ধ করে। মেহেরপুরের অভিজ্ঞতা বিষয়ে মতবিনিময়ের জন্য আমি প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর এবং পিকেএসকে অনুরোধ জানাই । কিন্তু কোন পক্ষ থেকে এ বিষয়ে কোন সাড়া পাওয়া যায়নি । একজন অফিসার আমাকে মৌখিক ভাবে জানান যে, প্রকৃতপক্ষে মিথ্যামুক্ত সমাজ গড়ার প্রসঙ্গটি আপত্তিকর । কারণ, যিনি মিথ্যাকথা বলেন, তিনি নিজেও স্বীকার করেন না যে, তিনি মিথ্যা বলেন । মিথ্যামুক্ত দেশ গড়ার কথা বলাও দেশের জন্য অপমানকর । কারণ, একথা বলার অর্থ এটা স্বীকার করে নেওয়া যে, বাংলাদেশ মিথ্যা কথা বলে ।
আমার নিজের কাছেও সেই কর্মকর্তার কথা ভিন্ন একটা কারণে যৌক্তিক মনে হয় । আমাদের মূল লক্ষ্য মানুষকে ভালো কাজে উদ্বুদ্ধ করা । সমাজকে মিথ্যামুক্ত করা নয় । একজন মানুষ শতভাগ সত্যবাদি হলেও, তিনি যদি সমাজ বা মানুষের কোন উপকারে না আসেন, তাহলে তাঁর সত্যকথা দিয়ে সমাজের কি লাভ ? দেশের কি লাভ ?
এ সময় কি এক কারণে দুর্নীতি দমন কমিশন নিয়ে অনেক কথা হচ্ছিল । লক্ষ্য করি, দুর্নীতি দমন কমিশনের উল্লেখযোগ্য কাজের একটি দেশে দুর্নীতির উৎসমুখ চিহ্নিত করে প্রয়োজনীয় প্রতিকারের ব্যবস্থা নেওয়া । তার ভিত্তিতে সে সময়ে আমি দেশের দুর্নীতির উৎসমূখ চিহ্নিত করে সেগুলো প্রতিকারের ব্যবস্থা সম্বলিত একটি ধারণাপত্র দুর্নীতি দমন কমিশনে প্রেরণ করি । মূলতঃ সেই ধারণাপত্রের আলোকেই অর্পণ –দর্পণের প্রস্তাবিত এই কর্মশালা ।
আমরা লক্ষ্য করেছি, বাংলাদেশে যতপ্রকার দুর্নীতি ও অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড সংঘটিত হয়, তা মূলত ৪ টি কারণে ঘটে থাকে-
(১) এদেশের শিক্ষিত শ্রেণির মানুষের স্বার্থপরতা ও আত্মকেন্দ্রিক চিন্তা-
নিজের উন্নতি চাওয়ার মধ্যে দোষের কিছু নেই । কিন্তু আমাদের অনেকেই আছেন, যারা অন্যের ক্ষতি করার মাধ্যমে নিজের উন্নতি চান । যারা ঘুষ খান, তাঁরা এই ঘুষ গ্রহনের কারণে কোন ব্রিজ ভেঙ্গে পড়বে কি না, যিনি খাদ্যে ভেজাল দেন, তিনি খাদ্যে ভেজাল দেওয়ার কারণে কারো কোন কঠিন অসুখ হবে কিনা, কেউ মারা যাবে কি না, বা যিনি মনে করেন বাংলাদেশ এখন বসবাসের উপযুক্ত নয়, তাঁরা দেশ ছেড়ে যেতে চান । কিন্তু, দেশ ছেড়ে চলে গেলে, যারা দেশে থাকবেন, তাঁদের কি হবে এসব নিয়ে তাঁর কোন মাথাব্যাথা নেই । ফলে, আমাদের দেশে দুর্নীতিসহ যত প্রকার অপরাধ আছে, তা কোন না কোন ভাবে এই ৪টি কারণের এক বা একাধিক কারণের সাথে জড়িত।
(২) পারস্পারিক আস্থাহীনতাঃ এখন আমরা কেউ কাউকে বিশ্বাস করতে পারিনে । আমি এত ভালো কথা লিখছি, কিন্তু কেউ কেউ ভাবছেন, উনার আসল উদ্দেশ্য কি ? এত ভালো কথা বলছেন কেন ? এ ধরণের পরস্পর আস্থাহীন সমাজ বেশিদুর এগুতে পারে না ।
(৩) প্রতিহিংসাপরায়ণতাঃ আমাদের দেশ প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবন দেশ । কিন্তু, এ দেশে মানবসৃষ্ট দুর্যোগে যে পরিমাণ ক্ষতি হয় ( যেমন বিভিন্ন বাজারে আগুন, পুকুরে বিষ, ফসল নষ্ট ইত্যাদি), তা কোন অংশে প্রাকৃতিক দুর্যোগের চেয়ে কম নয় ।
(৪) পরমুখাপেক্ষিতাঃ পর দ্রব্যের প্রতি লোভ আমাদের জন্মগত । এ কারণে কোটিপতির ছেলেকে একটি ফ্রি চকলেটের লোভ দেখিয়ে একজন ছেলেধরা তাকে নিয়ে যেতে পারে।
আর, এই ৪ টি মৌলিক কারণের উৎপত্তি হয়েছে সমাজে মানুষের মধ্যে অবাধ মিথ্যাচার এবং তাদের মধ্যে দেশপ্রেম, ধর্ম ও নৈতিকতাবোধ কাজ না করার কারণে-যা দেশের টেকসই অর্থনৈতিক উন্নতির পথে অনেক বড় বাঁধা ।
অর্পণ-দর্পণ স্মৃতি ফাউন্ডেশন উদ্ভূত সামাজিক সমস্যাগুলো স্থায়ীভাবে নিরসনের লক্ষ্যে প্রাথমিক শিক্ষা পর্যায়ে শুদ্ধাচার অনুশীলনের প্রস্তাব করে আসছে । ২০২২ সালে এ প্রস্তাবের উপর মেহেরপুর জেলায় পরীক্ষামূলক কাজ করেছি আমরা । একথা আগেই বলা হয়েছে । যে অনুশীলন উপকরণ নিয়ে আমরা মেহেরপুরে কাজ করেছি এবং সেখান থেকে যে সব ফিডব্যাক আমরা পেয়েছি, তার আলোকে অর্পণ- দর্পণের হালনাগাদ প্রস্তাব আমরা একটি কর্মশালার মাধ্যমে উপস্থাপন করতে চাই । কারণ, এ বিষয়ে বিভিন্ন শ্রেণি পেশার অভিজ্ঞ মানুষের মতামত অনেক বেশি মূল্যবান । এই কর্মশালায় গৃহীত সুপারিশমালা আমরা যথানিয়মে সরকারের নিকট উপস্থাপন করতে চাই । আমরা বিশ্বাস করি, অর্পণ- দর্পণের কর্মশালায় বিভিন্ন অভিজ্ঞজনের সুপারিশের ভিত্তিতে প্রাথমিক শিক্ষার জন্য যে শুদ্ধাচার অনুশীলন কৌশল নির্ধারণ করা হবে, তা যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করা গেলে, শুদ্ধাচার অনুশীলনে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীদের মনে আমাদের মধ্যে থাকা উল্লিখিত ৪টি বদগুণ কখনো দানা বাঁধতে পারবে না । এর ফলে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সেই ‘দু:খী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর সোনারবাংলা’ গড়ে তোলা সহজতর হতে পারে।
৭ জুলাই, ২০২৪ । মোহাম্মদপুর, ঢাকা ।
লেখক অর্পণ- দর্পণ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী এবং
সাবেক সচিব (গ্রেড-১), গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার ।