রাশেদুল ইসলাম
আমাদের কৃতজ্ঞতা ও অভিনন্দন
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ১২ আগস্ট,সোমবার,২০২৪ | আপডেট: ১১:০৭ পিএম, ২১ ডিসেম্বর,শনিবার,২০২৪
শান্তিতে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ডঃ মুহাম্মদ ইউনূস আমার শিক্ষক । তবে আমি তাঁর সরাসরি ছাত্র নই । আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের ছাত্র । আর স্যার ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক । আসলে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির মাধ্যমে স্যারের সাথে আমার পরিচয় । বিভিন্ন দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের মডেল জানার পাশাপাশি, নিজের দেশের উন্নয়নের মডেল কেমন হতে পারে, এসব জানার এবং আলোচনা করার অদম্য কৌতূহল ছিল আমার । সে কারণেই আমি স্যারের একজন ভক্ত হয়ে পড়ি । স্যার চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা আসলেই আমি স্যারের সাথে দেখা করতাম এবং দেশের প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে করণীয় বিষয়ের উপর তাঁর জ্ঞানগর্ভ আলোচনা শুনতাম । স্যার জামানত ছাড়াই প্রান্তিক পর্যায়ের মহিলারা কিভাবে স্বল্প ঋণ গ্রহনের মাধ্যমে নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তন করতে পারেন, কিভাবে স্বাবলম্বী হতে পারেন, সে বিষয়ে তাঁর নিজের বাস্তব অভিজ্ঞতার কথা বলতেন । এসব বিষয় নিয়ে লেখা তাঁর ‘বেলতৈল গ্রামের জরিমন ও অন্যান্যরা’ বইটি তিনি আমাকে উপহার দেন ।
ডঃ মুহাম্মদ ইউনূস স্যার আমাকে খুব স্নেহ করতেন এবং বিভিন্ন অনুপ্রেরণাদায়ক গল্প শুনাতেন । এক একদিন এক এক রকম গল্প । গল্পগুলো খুব ছোট, কিন্তু তাৎপর্যপূর্ণ । এখানে একটি গল্পের উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। একদিন তিনি পাহাড়ি ঝর্নার কথা বলেন । বলেন, পাহাড় থেকে নেমে আসা ঝর্নার পানি দুর্বার স্রোতের সৃষ্টি করে । তুমি যদি কুলে দাঁড়িয়ে থাকো, তাহলে দেখবে মোটা গাছের গুড়ি, গরু বা মহিষের কোন মৃতদেহ চোখের পলকে সেই স্রোতে ভেসে যাচ্ছে । তুমি যদি পানির আরও কাছাকাছি যাও, তাহলে দেখবে স্ফটিকের মত স্বচ্ছ পানি । একটু খেয়াল করলে দেখবে, সেই স্বচ্ছ পানিতে অনেক কেচকি মাছ । কিন্তু সেগুলো মোটা গাছের গুড়ির মত স্রোতে ভেসে যাচ্ছে না, বরং সেগুলো স্রোতের প্রতিকূলে পাহাড়ের দিকে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে । এর মূল কারণ, মরা গাছের গুড়ির জীবন নেই, কিন্তু কেচকি মাছের জীবন আছে । স্রোতের প্রতিকূলে যাওয়াই সত্যিকার জীবনের লক্ষণ । তাই, জীবনে কখনো মরা গাছের গুড়ি হইও না; কেচকি মাছ হওয়ার চেষ্টা করবে ।
কোটা সংস্কার তথা বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকারি ছাত্রদের সবাই ডঃ মুহাম্মদ ইউনূসের গল্পের সেই কেচকি মাছের মত- যে মাছ স্রোতের টানে ভেসে যেতে জানেনা, স্রোতের প্রতিকূলে উজান ঠেলে ঝর্নার উৎসমুখে যেতে চায় । সামাজিক সমস্যা নিরসনে আসলে সমস্যার উৎসমুখ চিহ্নিত করাটাই আসল । উৎসমুখ চিহ্নিত করে, সে অনুযায়ী ব্যবস্থা না নিলে, সমস্যা, সমস্যাই থেকে যায় ।
এ প্রজন্মের সূর্যসন্তানেরা নিয়মতান্ত্রিক ভাবে কোটা সংস্কার আন্দোলন করতে গিয়ে অনেক বড় বাঁধা পান । এক পর্যায়ে তাঁদের আন্দোলন রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনে রুপ নেয়- বাস্তবিক অর্থে যা ছিল রাজনৈতিক এবং তাঁদের জন্য ভয়ংকর । এ কারণে, তাঁদেরকে এক রক্তাক্ত পথ পাড়ি দিতে হয় । ৫ আগস্ট, ২০২৪ তারিখে রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের প্রথম ধাপ হিসেবে তাঁদের ‘এক দফা, এক দাবি’র লক্ষ্য অর্জনে সক্ষম হন তাঁরা । ছাত্র জনতার এক অভূতপূর্ব গণঅভ্যুত্থানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ থেকে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। ফলশ্রুতিতে ইতোমধ্যে সংসদ ভেঙ্গে দেওয়া হয়েছে । তবে বাতাসে এখনো বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অসম সাহসী ছাত্র যুবক আবু সাঈদসহ অনেক ঝরে যাওয়া তাজা প্রাণ লাশের গন্ধ, স্বজনহারা এবং চরম ক্ষতিগ্রস্থ মানুষের গুমোট কান্নায় ভরে আছে গোটা দেশ । দেশের অর্থনীতি চরম বিপর্যস্ত; স্থবির হয়ে আছে সবকিছু। নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত পুলিশ বাহিনির অনুপস্থিতিতে দেশজুড়ে আতংকিত সব মানুষ । চরম সঙ্কটময় এই মুহূর্তে দেশের স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনা এবং অর্থনীতির গতি সঞ্চার করে দেশকে এগিয়ে নেওয়ার লক্ষ্যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে এ দেশেরই সোনার ছেলে শান্তিতে নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ ডঃ মুহাম্মদ ইউনূসের কোন বিকল্প নেই । আন্দোলনকারি ছাত্রছাত্রীরা তাঁকেই বেছে নিয়েছেন এবং ডঃ মুহাম্মদ ইউনূস তাঁদের প্রস্তাবে রাজী হয়েছেন । এজন্য আন্দোলনকারি সকল ছাত্রছাত্রী এবং ডঃ মুহাম্মদ ইউনূসের প্রতি আমাদের অশেষ কৃতজ্ঞতা । আমাদের অশেষ কৃতজ্ঞতা সেনাবাহিনি প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের প্রতি - যার নির্মোহ, আন্তরিক ও অক্লান্ত চেষ্টায় দেশে একটি আশা জাগানিয়া অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়েছে ।
আজ ৮ আগস্ট, ২০২৪; একটি নতুন বাংলাদেশ গড়ার দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে শান্তিতে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ডঃ মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে দু’জন ছাত্র প্রতিনিধিসহ ১৭ সদস্যের সেই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার শপথ নিলেন । অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা ডঃ মুহাম্মদ ইউনূস। তাঁর কথা আগেই বলা হয়েছে । এই সরকারের সম্মানিত উপদেষ্টাদের মধ্যে দু’জন ছাত্র প্রতিনিধি ব্যতীত ১৪ জন উপদেষ্টাদের প্রত্যেকেই নিজ নিজ ক্ষেত্রে সর্বজনবিদিত সফল ব্যক্তিত্ব। অনেক সংকটময় মুহূর্ত দক্ষতার সাথে অতিক্রম করার সফল উদাহরণ তাঁদের রয়েছে । ছাত্র প্রতিনিধি দু’জন বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে সফল নেতৃত্বকারি এবং ভবিষ্যৎ নতুন বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্নদ্রষ্টা । তাঁদের সকলের প্রতি আমাদের প্রাণঢালা অভিনন্দন। আমাদের গর্বিত সূর্য সন্তানদের স্বপ্ন যথাযথভাবে বাস্তবায়নে তাঁরা সম্মিলিতভাবে তাঁদের মেধা, অভিজ্ঞতা, দক্ষতা ও বিচক্ষনতা দিয়ে বাংলাদেশকে সত্যিকার একটি জনবান্ধব রাষ্ট্রে পরিণত করার লক্ষ্যে কাম্য অবদান রাখবেন - এ বিশ্বাস বোধহয় আমরা রাখতে পারি ।
মহান আল্লাহ আমাদের প্রিয় বাংলাদেশকে ঘিরে এ প্রজন্মের সূর্যসন্তানদের লালিত স্বপ্নের সুষ্ঠু বাস্তবায়নে সহায় হউন ।
৮ আগস্ট, ২০২৪ । মোহাম্মদপুর, ঢাকা ।