রাশেদুল ইসলাম
মধুমাসে টকফল
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ১০ জুন,সোমবার,২০২৪ | আপডেট: ০৬:১৯ পিএম, ৩০ ডিসেম্বর,সোমবার,২০২৪
বলি এখন মধুমাস চলছে । বছরে একবারই এই মাস পাওয়া যায় ।
আমি একটি ডায়াবেটিস সমিতির স্বাস্থ্যকেন্দ্রে বসে আছি । আমার সামনে একজন লেডি ডাক্তার । ভেবেছিলাম তাঁর মনটা নরম হবে । কিন্তু হোল বিপরীত । তিনি শক্ত করেই বললেন, ‘আপনার ডায়াবেটিসের অবস্থা ভালো না । আপনার জন্য মধুমাস বাদ । মধুমাসে খেতে চাইলে টকফল খাবেন’ । তিনি তাঁদের গাইডলাইনে থাকা মিষ্টি ফলের ছবিগুলো ঘজঘজ করে কেটে দিলেন ।
আমি খাঁটি বাঙালি । জাতীয় ফল কাঁঠাল আমার প্রিয় । কিন্তু ডাক্তার যা বললেন, তার অর্থ, এই মধুমাসে আমার প্রিয় সেই কাঁঠাল আর খাওয়া হবে না । সব টকফল খেতে হবে ।
মানুষের আসলে তিন ধরণের ক্ষুধা আছে । দেহের ক্ষুধা, মনের ক্ষুধা এবং চোখের ক্ষুধা ।
খাদ্য দেহের ক্ষুধার জ্বালানি বিশেষ । সারাদিন একজন মানুষের শরীরে যে পরিমাণ ক্ষয় হয়, তা পূরণের জন্যই খাবারের প্রয়োজন হয় । কিন্তু, যে সব খাবার দেহের জন্য সত্যিকার প্রয়োজন, যে সব খাবার মানুষের শরীরের জন্য নির্দোষ পুষ্টিকর – মানুষের চোখ এবং মন সেই সব খাবার খেতে বাঁধা দেয় । ফলে, মানুষের নিজের মন এবং চোখই তার নীরোগ ও সুস্থ থাকার পথে এক নম্বর বাঁধা । কিন্তু, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে একজন মানুষ সারাজীবন তার আসল শত্রুকে ঠিকমত চিনতে না পেরেই এই পৃথিবী থেকে বিদায় নেয় । যেমন, এই আমি । এখন আমার মন টানছে, চাঁপাইনবাবগঞ্জের লিচু, রাজশাহীর আম, পাহাড়ি আনারস, যশোরের কাঁঠাল –আরও কত কি ! কিন্তু, ডাক্তারের মতে এখন এসব ফল আমার শরীরের জন্য বিষের মত ক্ষতিকর । কিন্তু আমার চোখ আমাকে প্রলুব্ধ করছে, মন বলছে, রাখ মহিলা ডাক্তারের কথা; মধুমাস পার হলে এসব ফল আর পাওয়া যাবে না । এখানে আমার এক নম্বর শত্রু আমারই নিজের মন এবং আমার দুটি চোখ । কিন্তু তাদেরকে শত্রু মনে হয় না আমার । এখনই মনে হচ্ছে মধুমাসে মধু না খেলে, আর কী খেলাম ?
প্রকৃতপক্ষে, মানুষ যদি কেবলমাত্র তার অত্যাবশ্যকীয় দেহের ক্ষুধা নিবারণের জন্য তাদের কর্মকাণ্ড সীমিত রাখত, তাহলে এই পৃথিবী এমনি এমনিই ক্ষুধা ও দারিদ্রমুক্ত থাকত, রোগমুক্ত থাকত । পৃথিবী আরও সৌন্দর্যমন্ডিত হত । কিন্তু, যত নষ্টের গোঁড়া মানুষের এই মন ও চোখের ক্ষুধা ।
অবশ্য পৃথিবীতে কোন কিছুই শতভাগ ভালো বা শতভাগ মন্দ বলে কিছু নেই । সবকিছুরই ভালো এবং মন্দ দিক রয়েছে । যেমন, মানুষের মনের ক্ষুধা এবং চোখের ক্ষুধা মানুষকে প্রাণী জগতের অন্যান্য প্রাণী থেকে আলাদা করেছে । মানুষ নিজেকে সৃষ্টির সেরা প্রমাণ করতে পেরেছে । পৃথিবীর যাবতীয় ব্যবসাকান্ড পরিচালিত হয় মানুষের মন ও চোখের ক্ষুধার কারণে । পণ্য প্রতিযোগিতা বাজারে মানুষের প্রদর্শন বাতিক (Demonstration Effect) একটি উল্লেখযোগ্য হাতিয়ার- যার উৎস মানুষের মন ও চোখের ক্ষুধা । তবে, পৃথিবীব্যাপী যুদ্ধ এবং যাবতীয় অশান্তি সৃষ্টির মূলে রয়েছে এই প্রদর্শন বাতিকতা । এটাই এর চূড়ান্ত নেতিবাচক দিক ।
অবশ্য এসব আমার আলোচনার বিষয় নয় । আমার আলোচনার বিষয় মন ও টকফল । আমি জানি মন একটা ছাগলের মত । ছাগলের সামনে যেমন কাঁঠালের পাতা ধরলে ইচ্ছেমত তাকে যে কোন জায়গায় নেওয়া যায়, মনকেও যদি ঠিকমত চালানো যায়, তাকে দিয়েও অনেক কিছু করানো যায় । এই যুক্তিতে এখন আমি আমার মনকে বোঝানোর চেষ্টা করছি । আমি বোঝানোর চেষ্টা করছি, আসলে টকফলের চেয়ে ভালো ফল আর হয় না । বিশেষ করে মধুমাসের টকফল বেশি সুস্বাদু ।
বাস্তবতা হচ্ছে, মানবজীবন নিজের চোখ ও মনের দাসত্ব করেই শেষ হয় । আমি নিজেও সাধারণ মানুষ । আমার জীবনও তাই । তবে মানুষের জীবন তার মন ও চোখের কথায় চলা উচিত নয়; চলা উচিত তার নিজের বিবেক ও বুদ্ধিবিবেচনা দিয়ে । তাহলেই মানুষের নিজের, সমাজ, দেশ ও পৃথিবীর শান্তি নিশ্চিত হতে পারে ।
শুভ কামনা সকলের জন্য ।