স্থবির ভোক্তাব্যয়
বিশ্বায়ন-পূর্ব যুগের পথে অস্ট্রেলিয়ার অর্থনীতি
ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ০৮:৪২ পিএম, ৯ সেপ্টেম্বর,
বুধবার,২০২০ | আপডেট: ০৬:২১ এএম, ২২ ডিসেম্বর,রবিবার,২০২৪
নভেল করোনাভাইরাস পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হতেই লকডাউনের বিধিনিষেধ সামান্য শিথিল করেছে অস্ট্রেলিয়া। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বাকি বিশ্ব থেকে এখনো যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে দেশটির। বৈদেশিক বাণিজ্যে এখনো স্থবিরতা বিরাজ করছে, যা দেশটির অর্থনীতিকে বিশ্বায়ন-পূর্ব যুগে নিয়ে যাচ্ছে। খবর ব্লুমবার্গ।
এ মন্দার সময়ে অস্ট্রেলিয়ার যা কিছু রফতানি আয় হচ্ছে, তা আসছে খনি ও কৃষি খাত থেকে। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার প্রতিষ্ঠানগুলো ম্যানুফ্যাকচারিং খাতের পুনর্জাগরণের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু বিদেশী পর্যটক, শিক্ষার্থী ও অভিবাসীদের আগমন এখনো বন্ধ রয়েছে দেশটিতে, যারা ভোক্তাব্যয়ের অন্যতম প্রধান উৎস। ফলে যতক্ষণ না বিদেশীরা অস্ট্রেলিয়ায় প্রবেশ করতে পারছেন, ততক্ষণ দেশটিতে ভোক্তাব্যয় আগের অবস্থানে ফিরে আসার প্রত্যাশা পূরণ হবে না।
বন্ধ সীমান্ত ও স্থানীয় নির্ভরতা অস্ট্রেলিয়ার অর্থনীতিকে ১৯৮০-এর দশকে ফিরিয়ে নিচ্ছে। সে সময়ের অস্ট্রেলীয় অর্থনীতি আর আজকের অর্থনীতির মধ্যে বিস্তর ফারাক রয়েছে। শুল্ক প্রত্যাহারের মাধ্যমে বাণিজ্য উন্মুক্তকরণ ও পর্যটন শিল্পকে বিশ্বদরবারে তুলে ধরতে সরকারি উদ্যোগের ফলে আশির দশকের পর বিশেষ গতি পায় অস্ট্রেলিয়ার অর্থনীতি। কিন্তু নভেল করোনাভাইরাসের কারণে সেই গতি তো রুদ্ধ হয়েছেই, বরং উল্টো পথে হাঁটতে শুরু করেছে অর্থনীতি।
অস্ট্রেলিয়ার জিডিপির ৫৫ শতাংশের উৎস গৃহস্থালি ব্যয়। করোনার বিস্তার ঠেকাতে সরকার যখন লকডাউন ঘোষণা করে, তখন মানুষজন জরুরি পণ্য সংগ্রহ করে রাখতে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। ফলে লকডাউনের প্রথম কয়েক দিন দেশটিতে গৃহস্থালি ব্যয় বেড়ে গিয়েছিল। কিন্তু মানুষের চলাচলে বিধিনিষেধ আরোপ করায় অন্যান্য খাতের ব্যয়ে রীতিমতো ধস নামে। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে ঘরের বাইরে যাওয়া বারণ। তাই রেস্তোরাঁ ও মুভি থিয়েটারগুলো বিরান ভূমি হয়ে পড়ল। খাঁ খাঁ শূন্যতা নেমে এল ভোক্তাব্যয়ের অন্যান্য খাতেও।
অস্ট্রেলিয়ায় দোকানপাট ও রেস্তোরাঁগুলো ধীরে ধীরে খুলে দেয়া হচ্ছে বটে, তবে ভোক্তাব্যয় আগের অবস্থানে ফিরে আসতে আরো সময় লাগবে। জনগণ তখনই ব্যয় করবে, যখন তাদের মনে চাকরির নিরাপত্তা নিয়ে কোনো দুশ্চিন্তা থাকবে না এবং জরুরি পণ্য ছাড়াও অন্য খাতে খরচ করার মতো পর্যাপ্ত অর্থ থাকবে তাদের হাতে। অর্থাৎ ব্যয়ের সামর্থ্য না থাকলে এবং ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগ না কমলে অস্ট্রেলিয়ার অর্থনীতিতে চাঙ্গা ভাব ফিরে আসতে সময় লাগবে অনেক।
অর্থনীতিবিদ জেমস ম্যাকিনটায়ার বলেন, ‘২০১৯ সালে প্রতি মাসে প্রায় ১০ লাখ অস্ট্রেলীয় নাগরিক বিদেশ ভ্রমণ করেছে। কিন্তু করোনা পরিস্থিতিতে তারা এখন তাদের পর্যটন গন্তব্য পরিবর্তন করেছে। বিদেশের কোনো জায়গার বদলে তারা স্থানীয় পর্যটনকেন্দ্রগুলোকেই বেছে নিচ্ছে। লকডাউনের বিধিনিষেধ এভাবেই আন্তর্জাতিক ভ্রমণের অর্থনীতি বদলে দিয়েছে।’
অস্ট্রেলিয়ায় করোনার আগে থেকেই গৃহস্থালি খাতে ঋণের পরিমাণ বেড়ে গিয়েছিল। এমনকি উন্নত বিশ্বগুলোর মধ্যে তা সবচেয়ে বেশি ছিল। ব্যয়যোগ্য আয়ের তুলনায় ঋণের পরিমাণ প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যাওয়ার বিষয়টিকে রিজার্ভ ব্যাংক অব অস্ট্রেলিয়া দীর্ঘদিন ধরেই অর্থনীতির জন্য বড় একটি ঝুঁকি হিসেবে বিবেচনা করে আসছে।
অস্ট্রেলিয়ায় বেকারত্বের হার বর্তমানে ৬ দশমিক ২ শতাংশ। কেন্দ্রীয় ব্যাংক তা প্রায় ১০ শতাংশে উঠে যাওয়ার আশঙ্কা করছে। এ অবস্থায় ব্যাংকগুলো ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে বিশেষ ছাড় দিচ্ছে। এছাড়া তারা ধরেই নিয়েছে যে খেলাপি ঋণ উল্লেখযোগ্য হারে বেড়ে যাবে। এজন্য তারা খেলাপি ঋণের বিপরীতে সঞ্চিতির পরিমাণ প্রায় চার গুণ করেছে।
অর্থনীতির মন্দা ভাবের মধ্যেও অস্ট্রেলিয়াকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে খনি ও কৃষি খাত। অস্ট্রেলিয়াকে বলা হয় কমোডিটির পাওয়ার হাউজ। দেশটির মোট উৎপাদনে এর অবদান মাত্র ১০ শতাংশ হলেও রফতানি আয়ের প্রধান একটি উৎস এ কমোডিটি। করোনার মধ্যেও এসব পণ্যের রফতানি আয়ের পরিসংখ্যান দেশটিকে হতাশ করেনি। এপ্রিলে পোর্ট হেডল্যান্ড থেকে আকরিক লোহার রফতানি রেকর্ড উচ্চতায় উঠেছে। বেড়েছে পার্থ মিন্ট থেকে স্বর্ণ বিক্রির পরিমাণও।
তবে কেবল রফতানি আয় দিয়ে তো আর অর্থনীতি চলতে পারে না। ভোক্তাব্যয় হলো একটি দেশের অর্থনীতির মূল প্রাণশক্তি। লকডাউনের কারণে সেই ভোক্তাব্যয়ই আজ গতিহীন। উন্মুক্ত বাণিজ্য ও পর্যটন শ্রীহীনতার কারণে আশির দশকের আগে অস্ট্রেলিয়ার অর্থনীতি যেভাবে খাবি খাচ্ছিল, নভেল করোনাভাইরাস আবার সে অবস্থা ফিরিয়ে আনছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য দেশটিকে অবশ্যই ভোক্তাব্যয় বাড়ানোর ব্যবস্থা নিতে হবে।