অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস কি বিপদ ডেকে আনতে পারে?
ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ৪ জুলাই,মঙ্গলবার,২০২৩ | আপডেট: ১১:০৩ এএম, ১৯ ডিসেম্বর,বৃহস্পতিবার,২০২৪
কল্পনা করুন আপনি একটি ধুসর রঙের ভালুকের সাথে লড়াই করছেন। কেবল আপনি একা এবং একটি ভালুকের মধ্যে সামনাসামনি লড়াই। কে জিতবে বলে মনে হয়? অথবা ধরা যাক একটা কুমীর, অথবা একটা শঙ্খচূড় সাপ কিংবা একটা ঈগলের সাথে লড়াইয়ে?
যুক্তরাষ্ট্রে ২০২১ সালে মোট ১ হাজার ৭০০ মানুষের ওপর ইউগভ পরিচালিত এক জরিপে দেখা যায়, ৬ শতাংশ মানুষ বলেছেন ভালুকের সাথে এরকম লড়াইয়ে তারাই জিতবেন। আর কুমীরের সাথে লড়াইয়ে জিতবেন বলেছেন ৬ শতাংশের চেয়ে সামান্য বেশি কিছু মানুষ।
এ ছাড়া ২৩ শতাংশ মানুষ বলেছেন, তারা শঙ্খচূড় সাপের সাথেও জিতবেন। ৩৮ শতাংশ বলেছেন তারা লড়াইয়ে ঈগলকে হারাতে পারবেন। হয়তো এসব মানুষের মধ্যে টারজানের মতো ক্ষমতা আছে। কিন্তু এরকম সম্ভাবনাই বেশি যে- এরা আসলে অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসী।
কিংবা ধরা যাক, আকাশে থাকা একটি বিমানকে জরুরি ভিত্তিতে অবতরণ করাতে হবে এটিকে বিধ্বস্ত না করে এবং যাত্রীদের প্রাণহানি ছাড়াই। আপনি কি পারবেন? সম্প্রতি নিউজিল্যান্ডে ইউনিভার্সিটি অব ওয়াইকাটোর একজন গবেষক, কায়লা জর্ডান তার এক সমীক্ষায় উত্তরদাতাদের কাছে এই প্রশ্ন রেখেছিলেন। এবারো দেখা গেল, লোকজনের আত্মবিশ্বাস অবাক করার মতো। যাদের কাছে গবেষক এই প্রশ্ন রেখেছিলেন তাদের অর্ধেক বলেছেন, তারা নিরাপদে বিমানটি মাটিতে নামাতে পারবেন এমন সম্ভাবনা ২০ শতাংশ।
উত্তরদাতাদের যখন তিন মিনিটের একটি ভিডিও দেখানো হলো, যেখানে একজন দক্ষ পাইলট একটি বিমান মাটিতে নামিয়ে আনছেন, তখন তো তাদের আত্মবিশ্বাস আরো বেড়ে গেল। এবার তারা বললেন, নিরাপদে যে তারা বিমানটি নামাতে পারবেন সেই সম্ভাবনা ৩০ শতাংশ। আর ২৫ শতাংশ উত্তরদাতা তো আরো বেশি আত্মবিশ্বাসী, তারা বললেন, তাদের সাফল্যের সম্ভাবনা ৬০ শতাংশ।
ব্যাপারটা বুঝতে পারছেন? এরা স্বীকার করছেন যে একটি উড়ন্ত বিমানকে কারো সাহায্য ছাড়া নিরাপদে মাটিতে নামিয়ে আনা খুবই চ্যালেঞ্জিং একটা কাজ, এর জন্য বিরাট দক্ষতার প্রয়োজন। তারপরও বিরাট সংখ্যক মানুষ, যাদের কোনো দক্ষতাই নেই, তারা মনে করছেন একটা জরুরি পরিস্থিতিতে তারা একটি বিমানের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সেটিকে নিরাপদে অবতরণ করাতে পারবেন কারো সাহায্য ছাড়াই।
যে ভিডিওটি তাদের দেখানো হয়েছিল, সেটি বিমানের ককপিটের পেছন থেকে রেকর্ড করা। সেখানে কোন শব্দ ছিল না। পাইলট তার হাত দিয়ে কী করছেন, সেটি দর্শকরা দেখতে পাচ্ছিলেন না। একজন পাইলট, যিনি এই ভিডিওটি দেখেছেন, তিনি বলেছিলেন, এটি একেবারেই অকাজের একটি ভিডিও, এটি দেখে শেখার কিছু নেই।
এরকম দৃষ্টান্ত অবশ্য আছে, যেখানে পাইলট ককপিটে অসুস্থ হয়ে পড়ে যাওয়ার পর যাত্রীরা এটির নিয়ন্ত্রণ নিয়েছেন এবং এরপর সফলভাবে এটিকে মাটিতে নামাতে সক্ষম হয়েছেন।
এরকম সর্ব-সাম্প্রতিক ঘটনাটি ঘটেছে ২০২২ সালের মে মাসে ফ্লোরিডায়। কিন্তু এক্ষেত্রে যাত্রী ড্যারেন হ্যারিসনকে সাহায্য করেছিলেন একজন এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলার, যিনি একই সঙ্গে একজন ফ্লাইং ইনস্ট্রাক্টর। বিমানটি অবতরণ করানোর পুরো সময়টা জুড়ে এই এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলার কাম ফ্লাইং ইনস্ট্রাক্টর ড্যারেন হ্যারিসনকে নির্দেশনা দিয়ে গেছেন কী করতে হবে।
একজন অভিজ্ঞ পাইলটের মতে, কারো সাহায্য না নিয়ে একটি বিমানকে নিরাপদে অবতরণ করানোর ক্ষেত্রে একজনের সাফল্যের সম্ভাবনা দশ হতে পনের শতাংশ। নিউজিল্যান্ডের গবেষণায় উত্তরদাতাদের যত ভাগ বলেছিলেন তারা এই কাজ পারবেন, তার তুলনায় অনেক কম।
মানুষের মধ্যে এই যে অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস, এটি যে কেবল জীবন-মৃত্যুর মুখোমুখি পরিস্থিতিতেই যে দেখা যায়, তা নয়।
আরেকটি ইউগভ জরিপে মানুষের কাছে প্রশ্ন রাখা হয়েছিল, ২৩ বারের গ্রান্ড স্ল্যাম জয়ী সেরেনা উইলিয়ামসের বিরুদ্ধে টেনিস ম্যাচে তারা কোনো পয়েন্ট অর্জন করতে পারবে কিনা। ৭ শতাংশ উত্তরদাতা বলেছে তারা পারবে। আর কেবল পুরুষদের মধ্যে এরকম আত্মবিশ্বাসীর সংখ্যা ১২ শতাংশ।
ড্রাইভিং এর বেলাতেও এরকম মাত্রাতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস দেখতে পাওয়া যায় অনেক মানুষের মধ্যে।
যুক্তরাষ্ট্রে ১৯৮১ সালে পরিচালিত একটি গবেষণার কথা এক্ষেত্রে প্রায়শই উল্লেখ করা হয়। এতে দেখা গিয়েছিল, ৯৩ শতাংশ ড্রাইভারই মনে করে তারা গড়পড়তা ড্রাইভারের চেয়ে ভালো। অথচ পরিসংখ্যানের দিক থেকে বিচার করলে, এরকম হওয়ার কো সম্ভাবনাই আসলে নেই।
এই ‘কগনিভিটিভ বায়াস’ বা জ্ঞানজাত পক্ষপাতকে অনেক সময় ‘লেক ওবেগন ইফেক্ট’ বলা হয়। লেখক গ্যারিসন কেইলার্সের এক কাল্পনিক শহরের নামে এই নাম দেয়া হয়েছে। এই শহরের সব শিশুই নাকি গড়পড়তার চেয়ে ভালো। তবে এটির টেকনিক্যাল নাম হচ্ছে ‘ইল্যুসরি সুপিরিয়রিটি’ বা ‘গড়পড়তার চেয়ে ভালো ইফেক্ট।’
কিছু কিছু মানুষকে যদি গড়পড়তার চেয়ে ভালো হতে হয়, কিছু লোককে তো অবশ্যই গড়পড়তা হতে হবে এবং অন্য কিছু মানুষকে হতে হবে গড়পড়তার চেয়ে খারাপ। কিন্তু তারপরও আমরা নিজেদের গড়পড়তার নিচে দেখতে চাই না।
একইভাবে, আমাদের মধ্যে এমন কিছু মানুষ আছে, যারা স্বীকার করে না যে তারা কিছু জানে না। এর ফলে যেটা দাঁড়ায়, তা হলো, নিজের জ্ঞানের অতিরিক্ত দাবি করে এরা নিজেদের জাহির করে। আপনি কি কোলারিনের কথা শুনেছেন? কিংবা প্যারালাক্স প্লেটের কথা?
এই দুটিই আসলে বানানো আজগুবি বৈজ্ঞানিক পরিভাষা। কিন্তু লোকজনকে যখন প্রশ্ন করা হলো, তখন অনেকেই বললো, হ্যাঁ শুনেছি বা জানি।
একটু আত্মবিশ্বাস থাকলে সেটা অবশ্যই ভালো। আমরা চাই, শিশুরা যেন নিজেদের ওপর বিশ্বাস রাখে এবং নতুন কিছু করার চেষ্টা করে। সাফল্য অনেক সময় আসে ঝুঁকি নিতে পারলে। আমরা যদি নিজেদের যেটুকু সক্ষমতা, তার পুরোটা কাজে লাগাতে পারি, তার তার চেয়ে বেশি কিছু করার চেষ্টা করতে পারি।
আপনি যদি নিজেকে আত্মবিশ্বাসী বলে দেখাতে পারেন, তখন আপনি অন্যদেরকেও আত্মবিশ্বাসী হতে অনুপ্রেরণা যোগাতে পারেন। আপনি যদি আত্মবিশ্বাসের সাথে নিজের মতামত প্রকাশ করতে পারেন তখন মানুষ আপনাকে অনেক বেশি বিশ্বাস করবে, আপনার ওপর আস্থা রাখবে।
কিন্তু এখানে আবার একটা আপাত-বৈপরীত্য আছে। মনোবিজ্ঞানে এটিকে বলা হয় ‘ডানিং-ক্রুগার ইফেক্ট।’ একটি গবেষণায় দেখা গিয়েছিল যারা নিজেদের যোগ্যতা নিয়ে অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসী, সত্যিকারের অর্জনের ক্ষেত্রে দেখা যায় তারাই সবচেয়ে খারাপ করে।
অনেকে অবশ্য এই ধারণার সাথে দ্বিমত পোষণ করেন। তবে আমার ধারণা, আমি কোভিড লকডাউনের সময় এই ইফেক্টের কবলে পড়েছিলাম। আমার দীর্ঘদিনের বিশ্বাস ছিল, আমি খুব ভালো পিয়ানো বাদক হতে পারবো, যদি কিনা আমার নিজের একটি পিয়ানো থাকে এবং আমি সেটি নিয়মিত বাজাতে পারি।
কিন্তু যখন আমি একটি পিয়ানো কিনলাম এবং প্র্যাকটিস শুরু করলাম, তখন আমি দেখলাম আমি এক্ষেত্রে মোটেই ভালো নই, একেবারে যাচ্ছেতাই। তাহলে মানুষের মধ্যে এই যে মাত্রাতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস দেখা যায়, এর উৎস কোথায়? একটি ব্যাপার তো স্পষ্ট, এখানে কোনো মানুষের ব্যক্তিত্ব কেমন, সেটা একটা কারণ।
যেসব মানুষ ‘নার্সিসিজম’ বা আত্ম-প্রেমে ভুগে, তাদের মধ্যে ‘সবজান্তা’ ভাবটা প্রকট। আর লিঙ্গেরও যে একটা ভূমিকা আছে, সেটা তো আমরা দেখেছি। সেটা ভাল্লুকের সাথে লড়াই করা হোক বা সেরেনা উইলিয়ামসের বিপক্ষে ম্যাচ খেলা হোক, পুরুষদের মধ্যে এরকম অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসের দেখা মিলবে বেশি।
পুরুষরা যে নারীদের চেয়ে শারীরিকভাবে শক্তিশালী, তাতে সন্দেহ নেই। কাজেই এ ধরনের প্রশ্নের ক্ষেত্রে তারা এরকম আত্মবিশ্বাস দেখাবে, সেটা আশা করা যেতে পারে। কিন্তু নিরাপদে বিমান অবতরণের চ্যালেঞ্জের বেলায়? সেক্ষেত্রেও দেখা যাচ্ছে, নারীর তুলনায় পুরুষরা বেশি আত্মবিশ্বাসী।
তবে এখানে ব্যাপারটা তো শুধু আমরা কে, তা নিয়ে নয়। আমরা কী করি, সেটাও একটা ব্যাপার।
ককপিটের সেই ভিডিওটার কথা ভাবুন। যারা এই ভিডিওটি দেখেছেন, তারা অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠেছিলেন। গবেষকদের ধারণা, ভিডিওটি দেখে উত্তরদাতারা নিজেদেরকে ওই রকম একটা ভূমিকায় কল্পনা করছিলেন।
কিন্তু এরকম ভুল আত্মবিশ্বাসের বড় বিপদ আছে, আমাদের ঝামেলায় ফেলতে পারে।
কায়লা জর্ডান, যিনি বিমান অবতরণ নিয়ে সমীক্ষাটি চালিয়েছিলেন, তিনি মনে করেন, অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসের ব্যাপারে আমাদের সতর্ক থাকা উচিৎ। বিবিসিতে আমাকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি তাই বলেছিলেন।
‘আমরা দেখেছি, একটি মাত্র ছোট্ট ভিডিও দেখার পর মানুষের আত্মবিশ্বাস কিভাবে ২৮ শতাংশ বেড়ে গেল। আপনি যখন মনে করছেন যে একটি বিমান আপনি অবতরণ করাতে পারবেন, যেটা কিনা আপনি আসলে পারবেন না, তখন বাকী যাত্রীরা হয়তো আপনার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকবে যদি আপনি এই কাজের জন্য যোগ্যতর কাউকে কাজটি করতে দেন, বলছিলেন তিনি।
নিজের ওপর আত্মবিশ্বাস থাকা ভালো। আমরা এমন একটা পরিবেশে এখন বাস করি, যেখানে আমাদের উৎসাহিত করা হয় এরকমটা ভাবতে যে- আমি সবকিছু করতে পারি যদি কিনা আমি নিজের ওপর বিশ্বাস রাখি।
আমরা নিজেকে নিয়ে সংশয়ে ভুগতে চাই না, সারাক্ষণ ব্যর্থতার ভয়ে থাকতে চাই না। কিন্তু আমাদের নিজেদের সক্ষমতা সম্পর্কে একটা অকপট ধারণা থাকা ভালো।
কাজেই যদি আপনি একটি ধুসর ভালুকের মুখে পড়েন, সেটির সাথে লড়াই না করে এড়িয়ে যাওটাই ভালো। আর সেরেনা উইলিয়ামস যদি আপনাকে টেনিস ম্যাচ খেলার চ্যালেঞ্জ দেয়, ভদ্রভাবে তাকে ‘না’ বলাটাই শ্রেয়।