রাশেদুল ইসলাম
সার্থক জনম আমার
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ৫ জুন,রবিবার,২০২২ | আপডেট: ১০:৪৮ এএম, ১৯ ডিসেম্বর,বৃহস্পতিবার,২০২৪
আজ আমার জন্মদিন ।
দাপ্তরিক বিচারে ১৯৬২ সালের ৫ জুন আমার জন্ম ।
আজ ২০২২ সালের ৫ জুন ।
দীর্ঘ ৬০ বছরের একটি লম্বা ইনিংস শেষ হোল আমার জীবনের ।
এখন আমার বয়স ৬০ বছর ।
আমার যখন জন্ম, তখন আমার জানামতে, একজন বাঙালী পুরুষের গড় আয়ু ছিল ৪৭ বছর ।
সেই হিসেবে আরও ১৩ বছর আগে আমার মৃত্যু হওয়ার কথা ছিল ।
আমার বয়সী অনেকেই ইতোমধ্যে মারাও গেছেন ।
যারা মারা গিয়েছেন, আমি তাঁদের সকলের আত্মার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করি ।
আমার এই বর্ধিত জীবনের জন্য মহান আল্লাহ্ এবং যারা মানুষের গড় আয়ু বৃদ্ধির জন্য প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে অবদান রেখেছেন
তাঁদের সকলের প্রতি আমার অশেষ কৃতজ্ঞতা ।
আমার আগে পৃথিবীতে কোটি কোটি মানুষ জন্মেছেন এবং নির্ধারিত সময় শেষে তাঁরা এই প্রথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন ।
কিন্তু আমার কেন যেন মনে হয়, সেই কোটি কোটি মানুষের মধ্যে আমি বা আমার জেনারেশনের মানুষ অনেক বেশি সৌভাগ্যবান । তাঁদের থেকে অনেক সার্থক জীবন আমাদের । তাই আমি আমার জীবন নিয়ে পরিতৃপ্ত একজন মানুষ ।
আমার জন্মের সময় দেশ পরাধীন ছিল । আমরা পূর্ব পাকিস্তানের বাসিন্দা ছিলাম । বুদ্ধিজ্ঞান হওয়ার পর থেকেই পরাধীন দেশের বঞ্চনার কথা শুনেছি আমরা । বঞ্চনার বিরুদ্ধে মানুষকে রুখে দাঁড়াতে দেখেছি । একজন নেতা যে কিভাবে সাধারণ মানুষের মনের মণিকোঠায় জায়গা করে নেয়, তা প্রত্যক্ষ করার সৌভাগ্য হয়েছে আমাদের । ১৯৭১ সালে আমার কিশোর বয়সে সেদিনের মুক্তিপাগল মানুষের সাথে গলা মিলিয়ে আমরাও বলেছি ‘জয় বাংলা’, ‘জয় বঙ্গবন্ধু’ । সেদিনের সেই দেশপ্রেমের উন্মাদনার রেশ আমার রক্তের হিমোগ্লোবিনের মধ্যে মিশে আছে যেন ।
আমাদের সময়ে মার্কনির রেডিও ছিল আমাদের কাছে বিস্ময়কর আবিস্কার । ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় এই যন্ত্রটি সবার অতিপ্রিয় যন্ত্রে পরিণত হয় । বিনা তারের যন্ত্র । তাই যে কেন্দ্র থেকে এই যন্ত্রের মাধ্যমে খবর ও গান পরিবেশন করা হত, তার নাম হয় বেতার কেন্দ্র । আমাদের ছোটবড় সবার তখন প্রিয় ছিল স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র । আমি অবাক বিস্ময়ে যন্ত্রের ভিতরটা দেখার চেষ্টা করতাম । ভিতরে কোন মানুষ দেখা যায় কিনা ।
আমাদের চোখের সামনে একটি নতুন স্বাধীন দেশের জন্ম হতে দেখেছি আমরা । দেশটি আমাদের প্রিয় এই বাংলাদেশ । কিছুদিন পরে শুনেছি একটি যন্ত্রের কথা, যে যন্ত্রের মাধ্যমে যারা গান গায়, খবর পড়ে- তাঁদের সবাইকে দেখা যায় । যারা শহরে গিয়ে যন্ত্রটি দেখে এসেছে, তাঁদের কাছে গল্প শুনেছি । আমার নিজের দেখার সৌভাগ্য হয় অনেক পরে । যন্ত্রটির নাম টেলিভিশন ।
গ্রামে আমাদের যাতায়াতের মাধ্যম ছিল পায়ে হাঁটা, গরু গাড়ি, ঘোড়া গাড়ি অথবা নৌকা । এই মাধ্যম হাজার বছরের পুরাতন । সেই হাজার বছরের পুরাতন মাধ্যম পার করে যারা অত্যাধুনিক বিমানে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ভ্রমনের সুযোগ পেয়েছে, আমি তাঁদের একজন । আমার ছেলেবেলায় যোগাযোগের মাধ্যম ছিল ডাকঘর । খবর আদান প্রদান করা হতো পোস্ট কার্ড, খাম অথবা টেলিগ্রামের মাধ্যমে । টেলিগ্রাম মানেই দুঃসংবাদ । সেদিনের সেই পোস্ট কার্ড, খাম, টেলিগ্রাম ব্যবহারের সুযোগ আমরা যেমন পেয়েছি, আজকের সর্বাধুনিক বিজ্ঞানের আবিস্কার হোয়াটস্যাপ চ্যাটিং, ফেসবুক, ই-মেইল একইভাবে ব্যবহারের সুযোগ পাচ্ছি আমরা । এটা আল্লাহর অশেষ রহমত ।
আমি সেই জেনারেশনের একজন যারা মাটিতে বসে পান্তাভাত খেয়েছি, যারা হারিকেন আর কুপির আলোতে পড়াশুনা করেছি । আবার আমরাই সেই জেনারেশন, যারা আধুনিক ডাইনিং টেবিলে বসে খাই, এসি, হিটার, ফ্রিজ, গ্যাস এবং মাইক্রোওভেনের পুরো সুবিধা ভোগ করি।
আমরা এনালগ যুগে ছিলাম । মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বে আমরা ডিজিটাল যুগ পেয়েছি । আমরা বিজ্ঞানের বিরামহীন জয়যাত্রা যেমন দেখেছি; করোনা মহামারিতে বিজ্ঞানের অসহায়ত্বও তেমন দেখেছি ।
প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ আমাদের দেখা হয়নি । মহান আল্লাহ্ বোধহয় আমাদের জেনারেশনকে সবকিছুই দেখাতে চান । হয়ত একারণেই রাশিয়া- ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হয়েছে । এই যুদ্ধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় মুদ্রাবাজারের ওঠানামা পৃথিবীকে এখনই আশনী সঙ্কেত দিচ্ছে । তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ যে কি ভয়াবহ হতে পারে, তা এখনই বোঝা যাচ্ছে । তাই বলি, এই জীবনে অনেক দেখেছি । মহান আল্লাহ্ দয়া করুন ! তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ যেন দেখতে না হয় । রাশিয়া- ইউক্রেন যুদ্ধের সম্মানজনক নিস্পত্তি যেন দেখতে পাই – এই প্রার্থনা করি ।
সত্য কথা এই যে, এই জীবনে আমার আর নতুন কিছু দেখার ইচ্ছে নেই । গত রাতে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডতে অগ্নিদগ্ধ মানুষের জন্য রক্তদানের আহবান জানান হয় । সেই আহবানে সাড়া দিয়ে রক্ত দেওয়ার জন্য চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে এক প্রতিযোগিতার সৃষ্টি হয়েছে । এই সংবাদটি পড়ে আমার মনটা ভরে গেছে ।
মানুষের জীবনে বেঁচে থাকার অপসান দেওয়ার দেওয়ার সুযোগ নেই । তবে এখন বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু হিসেবে আর দশ বছর আয়ু বোধহয় আমি পেতে পারি । মহান আল্লাহ্ যদি কবুল করেন, তাহলে আমার বাকি জীবনে আমি মানুষের মনোজগতকে নাড়া দেওয়ার মত কিছু কাজ করতে চাই । আমি স্বপ্ন দেখি, একদিন আমাদের ছেলেমেয়েরা শুধু রক্ত দেওয়ার জন্য নয় – মানুষের কল্যাণে সব ধরণের ভালো কাজ করার জন্য নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতা করবে । পবিত্র কোরআনের বিধানও তাই । বলা হয়েছে, মানুষের মধ্যে সৎকাজে কে এগিয়ে আছে, তা পরীক্ষা করার জন্যই আল্লাহ্ মানুষ সৃষ্টি করেছেন ( আয়াত ২, সূরা মূলক) ।
জন্মদিনে যারা আমাকে শুভেচ্ছা দিয়েছেন, তাঁদের সকলের প্রতি আমার অশেষ কৃতজ্ঞতা ।
শুভ কামনা সকলের জন্য ।
৫ জুন, ২০২২। ইস্কাটন, ঢাকা ।