মিহির কান্তি মজুমদার
ছিটমহল বিনিময় ও বিপন্ন মানবতার মুক্তি
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ৩১ জুলাই,সোমবার,২০২৩ | আপডেট: ০৫:৫২ এএম, ৭ ডিসেম্বর,শনিবার,২০২৪
ছিটমহল। দেশহীন, নাগরিকত্বহীন, আনুষ্ঠানিক পরিচয়হীন মানুষের অমানবিক জীবন ও জীবিকা এক কথায় প্রকাশ করা হলে নাম দাঁড়ায় ছিটমহল। এর ইংরেজি প্রতিশব্দ হচ্ছে- এনক্লেভ। দেশে দেশে ছিটমহল বা এনক্লেভ আছে। কোন দেশের অংশ ভিন্ন দেশ বা সত্তা দ্বারা আবদ্ধ থাকলে তাকে এনক্লেভ বলা হয়। সে হিসেবে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় এনক্লেভ বা ছিটমহল হচ্ছে আলাস্কা। যার সাথে যুক্তরাষ্ট্রের কোন ভৌগোলিক সংযোগ নেই। তেমনি যুক্তরাজ্যের ফকল্যান্ডও একটি ছিটমহল। দেশে দেশে ছিটমহল থাকলেও বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ১৬২টি ছিটমহলের মতো বিপন্ন মানবতা বিশ্বের কোথাও ছিল না। বাংলাদেশ ভারতের ছিটমহল যুগ যুগ ধরে ছিল বিপন্ন মানবতার এক জ্বলন্ত উদাহরণ। আর এ বিপন্ন মানবতার মুক্তি হয়েছে ২০১৫ সালের ১লা আগস্ট ছিটমহল বিনিময়ের ঐতিহাসিক মুহূর্তে।
বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার এ ছিটমহলের সূত্রপাত বেশ পুরানো। ব্রিটিশ রাজ ১৯৪৮ সালে ‘দ্য ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেনডেন্স অ্যাক্ট’ নামক আইন পাসের মাধ্যমে ভারত ও পাকিস্তান নামের দুটি রাষ্ট্রের সৃষ্টি করে। এ সময় বাংলা ও পাঞ্জাব ভাগ করার প্রয়োজনে সীমারেখা টানার পরিকল্পনা করেন লর্ড মাউন্ট ব্যাটেন। গঠন করা হয় সীমানা নির্ধারণ কমিশন। যার প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছিলেন ব্রিটিশ আইনজীবী সিরিল র্যাডক্লিফ। কমিশনের অন্য সদস্য ছিলেন ৪ জন বিচারক। সীমানা নির্ধারণের দায়িত্ব পেয়ে র্যাডক্লিফ ৮ই জুলাই ভারতের আসেন। দুটি রাজ্য ভাগ করে সীমানা নির্ধারণের জন্য সময় দেয়া হয় মাত্র ৬ সপ্তাহ। এটুকু সময়ের মধ্যে একজন বিদেশি আইনজীবীর নেতৃত্বে ০২টি প্রদেশের সীমানা ভাগ করা প্রায় অসম্ভব। তিনি র্যাডক্লিফ লাইন নামক জোড়াতালির এক সীমানা নির্ধারণ করেন, যার সাথে বাস্তবতার অনেক ক্ষেত্রেই মিল নেই। সে কারণে র্যাডক্লিফের সীমানা নির্ধারণী কার্যক্রমে কমিশনের সদস্যবৃন্দ একমত পোষণ করেননি। তা সত্ত্বেও সিরিল র্যাডক্লিফ ১৩ আগস্ট ১৯৪৭ সালে ‘র্যাডক্লিফ অ্যাওয়ার্ড’ নামে পরিচিত সীমানা নির্ধারণের প্রতিবেদন দাখিল করেন। এ প্রতিবেদন ১৬ আগস্ট ১৯৪৭ সালে জনসমক্ষে প্রকাশিত হয়। এ র্যাডক্লিফ অ্যাওয়ার্ডই ছিটমহল সমস্যার সূচনাকর্ম বলে গণ্য করা হয়।
র্যাডক্লিফের সীমানা নির্ধারণী ম্যাপে গোলযোগ অনেক। যেমন: কোন ব্যক্তির বসতঘর ও রান্নাঘরের মাঝখান থেকে সীমানা ভাগ হয়েছে। কোন কোন জায়গায় সীমারেখা টানা যায়নি বলে অমীমাংসিত থেকেছে। থেকেছে এক দেশের মধ্যে অন্য দেশের অনেক এলাকা ও জনগণ, যার নাম ছিটমহল। জীবন ও জীবিকার চরম অচল অবস্থার সৃষ্টি করেছে দু’দেশের মধ্যে ছিটমহল। কথিত আছে যে, ছিটমহল সমস্যার সূচনা হয় সপ্তদশ শতকে মোগল সম্রাট শাজাহনের শাসন আমলে। কোচবিহারের রাজা প্রাণ নারায়ণ মোগল সাম্রাজ্যের কিছু জায়গা দখল করে তার রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করেন। অপরদিকে, মোগল সুবেদার কোচবিহার রাজ্যের কিছু অংশ দখল করেন। যা পরবর্তীতে রংপুরের মহারাজার রাজ্যভুক্ত হয়। তবে দুই রাজ্যের মধ্যে থাকা এসব অঞ্চলের মানুষের জনজীবনে এ দখল-প্রতিদখলে তেমন কোন সমস্যা সৃষ্টি হয়নি। বিঘ্ন সৃষ্টি করেছে ভারত ও পাকিস্তান সৃষ্টির জন্য পাসকৃত আইন। এ আইনে করদ রাজ্যের রাজা/মহারাজা/নবাব/নিজামগণকে ভারত বা পাকিস্তানে যোগ দেবার স্বাধীনতা দেওয়া হয়। অবিভক্ত ভারতে তখন করদ রাজ্য, যা ‘পিন্সলি স্টেট’ নামে পরিচিত, এর সংখ্যা ছিল ৫৮৪টি। আইনে সুযোগ রাখা হয় এসব করদ রাজ্য ইচ্ছে করলে ভারত বা পাকিস্তানে যোগ দিতে পারবে। এমনকি তারা চাইলে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবেও থাকতে পারবে। ১৯৪৭ সালে দেশভাগকালে অধিকাংশ করদ রাজ্য ভারত ও পাকিস্তানে যোগ দেয়। বাংলাদেশ ও ভারতের ছিটমহল সম্পর্কিত কোচবিহারের রাজা এবং রংপুরের মহারাজা ভারত-পাকিস্তান স্বাধীনতার সময় কোন রাজ্যে যোগ দেননি। কোচবিহারের রাজা ১৯৪৯ সালের ১২ সেপ্টেম্বর কোচবিহার রাজ্যকে ভারতের অন্তর্ভুক্ত করার চুক্তি করেন। যা পরের বছর পশ্চিমবঙ্গের একটি জেলা হিসেবে ঘোষিত হয়। রংপুরের মহারাজা পাকিস্তানের সাথে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার চুক্তি করেন ১৯৫২ সালে। ছিটমহলে অমানবিক জনজীবনের রাস্তা তখন থেকেই শুরু।
ছিটমহল ও স্থল সীমানা নির্ধারণে অনেক সমস্যা থাকায় তা নিরসনে জওহরলাল নেহেরু ও ফিরোজ খান নুন ১৯৪৮ সালে চুক্তি করেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত চুক্তি বাস্তবায়িত হয়নি। ভারতের সুপ্রিম কোর্ট এ চুক্তি করার ক্ষেত্রে ভারতের সংবিধান সংশোধন করার পক্ষে মতামত ব্যক্ত করেন। এ চুক্তি বাস্তবায়নে তখন প্রণীত হয় ভারতের সংবিধান সংশোধনের নবম সংশোধনী। কিন্তু তা পাস হয়নি, আর ছিটমহল বিনিময়ও হয়নি। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী ১৯৭৪ সালে পুনরায় স্থল সীমানা নির্ধারণ চুক্তি করেন।
বাংলাদেশের মধ্যে ভারতের ছিটমহলের সংখ্যা ১১১টি, জনসংখ্যা ৩৭ হাজার ৩৩৪ জন এবং এলাকা ১৭ হাজার ১৬০ একর। অপরদিকে, ভারতের মধ্যে বাংলাদেশের ছিটমহল ৫১টি, জনসংখ্যা ১৪ হাজার ২১৫ জন এবং এলাকা ৭ হাজার ১১০ একর। বাংলাদেশের মধ্যে ভারতের ১১১টি ছিটমহলের মধ্যে লালমনিরহাট জেলায় ৫৯টি, পঞ্চগড় জেলায় ৩৬টি, কুড়িগ্রাম জেলায় ১২টি, নীলফামারী জেলায় ০৪টি। ভারতের মধ্যে বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহলের মধ্যে ৪৭টি কোচবিহার জেলায় এবং ৪টি জলপাইগুড়ি জেলায়। এমনিতে এসব ছিটমহলে লোকজনের কোন পাসপোর্ট নেই, রাস্তা নেই, স্কুল-কলেজ নেই, হাসপাতাল বা চিকিৎসা কেন্দ্র নেই, দেশে যাওয়ার জন্য কোন পথ নেই। জমি বৈধ দলিলে বিক্রি করার সুযোগ নেই। এসব কারণে শিক্ষা, চিকিৎসা, খাদ্যসহ-অধিকাংশ মৌলিক সুবিধাবঞ্চিত মানুষের জনজীবন প্রায় বিপন্ন ছিল যুগ যুগ ধরে। ছিটের লোক বলে পরিচিত এসব মানুষের মজুরিও কম। অধিকাংশের পেশা কৃষিকাজ।
ছিটমহলের এতো সমস্যা যেখানে, সেখানে আছে ছিটমহলের মধ্যে ছিটমহল বা কাউন্টার ছিটমহল। অর্থাৎ ভারতের মধ্যে বাংলাদেশ এবং সে বাংলাদেশের মধ্যে ভারত। যেমন: কুড়িগ্রামে ভারতের ছিটমহল দাশিয়ারছড়া। এ দাশিয়ারছড়ার মধ্যে আছে বাংলাদেশের ছিটমহল চন্দ্রখানা। কোন কোন ছিটমহল এতো ছোট যেখানে বসবাস করার সুযোগ নেই। কুড়িগ্রামের বড় গারালজোড়া ছিটমহলে বাস করে মাত্র ১০টি পরিবার। আর ছোট গারালজোড়া ছিটমহলে জমির পরিমাণ মাত্র ১৭.৭৮ একর।
ছিটমহলের মানুষের যুগ যুগ ধরে চলা অমানবিক এ জীবন-জীবিকা নিরসন ঘটে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্যোগে। মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি বাস্তবায়নে দু’দেশের পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ে আলোচনা শুরু হয়। গঠিত হয় জয়েন্ট বাউন্ডারি ওয়ার্কিং গ্রুপ। তাদের সুপারিশ অনুযায়ী ভারতের সংবিধানের ১০০তম সংশোধনী পাস হয়। সে ধারাবাহিকতায় স্বাক্ষরিত হয় ঐতিহাসিক স্থল সীমানা নির্ধারণ চুক্তি। তারিখটি ছিল ৬ জুন ২০১৫। দুই মাসের মধ্যে ১লা আগস্ট, ২০১৫ এর সূচনালগ্ন অর্থাৎ ৩১ জুলাই দিবাগত রাত্রি ১২.০১ মিনিটে ছিটমহলে স্ব-স্ব দেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলনের মাধ্যমে ছিটমহল বিনিময় সম্পন্ন হয়।
অবসান ঘটে যুগ যুগ ধরে চলা অমানবিক জীবন ও জীবিকা। ছিটমহলের জীবন ও জীবিকা নিয়ে ইতোমধ্যে সমীক্ষা হয়েছে অনেক। সমীক্ষা অনুযায়ী সেখানের অধিকাংশ মানুষ ছিল দিনমজুর, প্রধানত কৃষি শ্রমিক। রাস্তা, স্কুল-কলেজ ছিল না। প্রাথমিক চিকিৎসার কোন ব্যবস্থা ছিল না। ১৮ বছর বয়সের আগে ৯২% মেয়েকে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হতো। যৌতুকের প্রচলন ছিল শতকরা ৮৮ ভাগ বিবাহের ক্ষেত্রে। সেচ ব্যবস্থা, কৃষির উপকরণ, প্রশিক্ষণ- এসবের অভাবে কৃষি উৎপাদনও ছিল অনেক কম। কৃষি ফসল বিক্রয়েও ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তি হতো না। সেখানে এখন স্কুল, কমিউনিটি ক্লিনিক, রাস্তা, বিদ্যুৎ, পরিচয়পত্র সব সুযোগ এক সাথে এসেছে বিদ্যুতের গতিতে। ছিটমহলে শুরু হয়েছে অগ্রগতির প্রতিযোগিতা।
তাই তো ভূরুঙ্গামারী উপজেলার এক সময়ের ছিটমহল বাঁশজানী নামের গ্রাম থেকে আসা মেয়েরা দৃষ্টি কাড়ে বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিব জাতীয় গোল্ড কাপ টুর্নামেন্টে। ম্যান অব দ্য সিরিজ নির্বাচিত হয় বাঁশজানীর স্বরলিকা। ছিটমহলে বিপন্ন মানবতার মুক্তির প্রতীক স্বরলিকা ও তার সতীর্থরা। বিপন্ন জীবন-জীবিকার শৃঙ্খল ছিন্ন করে স্বরলিকারা উন্নয়নের সব ক্ষেত্র দৃশ্যমান অগ্রগতি করবে- এটাই প্রত্যাশা।
ড. মিহির কান্তি মজুমদার; সবেক সচিব।