মিহির কান্তি মজুমদার
নিপাহ ভাইরাস সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতি
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ১১ ফেব্রুয়ারী,শনিবার,২০২৩ | আপডেট: ১০:৪৮ এএম, ১৯ ডিসেম্বর,বৃহস্পতিবার,২০২৪
প্রায় তিন বছর করোনা ভাইরাসের তা-বে জনজীবন পর্যুদস্ত অবস্থা থেকে জাগতে শুরু করেছে। তখন চীনসহ বিভিন্ন দেশে নতুন করে ব্যাপক পর্যায়ের করোনা সংক্রমণে আবার দিগন্তে আতঙ্কের মেঘ সৃষ্টি হয়েছে। এরমধ্যে ভিন্নমাত্রার গতিতে এদেশে হাজির হয়েছে নিপা ভাইরাস। সেই ২০০১ সাল থেকে প্রথমে মেহেরপুর, পরে নওগাঁ, ফরিদপুর এভাবে দেশের অর্ধেক জেলায় নিপাহ ভাইরাসের সংক্রমণ বৃদ্ধি ঘটছে। সংক্রমণের এলাকা প্রতিবছর বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর দেশের ৫০ শতাংশ জেলাকে ঝুঁকিপূর্ণ বিবেচনা করেছে। সে প্রক্ষিতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ তারিখ প্রেরিত চিঠিতে রোগী দেখার সময় হাসপাতালে মাস্ক ব্যবহার ও সর্তকতা অবলম্বনের জন্য পরামর্শ দিয়েছে। মহাখালী কোভিড-১৯ ডেডিকেটেড হাসপাতালে ১০ বেডের আইসোলেশন ওয়ার্ড এবং ১০ বেডের আইসিইউ প্রস্তুত রাখার ব্যবস্থা করেছে।
বাংলাদেশসহ তৃতীয় বিশ্বের দেশসমূহে যখন ডায়রিয়াসহ সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণে দৃশ্যমান অগ্রগতি করেছে। সে সময় জীবনযাত্রার পরিবর্তন এবং সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন কারণে বাড়ছে উচ্চরক্তচাপ, ডায়াবেটিসসহ অসংক্রামক রোগের তালিকা। এরই মধ্যে পাখি বা প্রাণী থেকে আসা সংক্রামক রোগ ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি করছে। পাখি বা প্রাণী থেকে মানুষের মধ্যে সংক্রমণের এসব রোগকে বলা হয় জুনোটিক ডিজিজ। যেসব জুনোটিক ডিজিজ সারা বিশ্বে বর্তমান সময়ে অনেক মারণঘাতী হয়েছে তার মধ্যে এইচআইভি, এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা, নিপাহ এবং কোভিড-১৯ অন্যতম।
নিপাহ ভাইরাস হেনিপাভাইরাস গোত্রের সদস্য। এ গোত্রের প্রথম সদস্য হেনড্রা ১৯৯৪ সালে অস্ট্রেলিয়ার মানুষের মধ্যে সংক্রমণ ঘটিয়েছেন। দ্বিতীয় সদস্য নিপাহ ভাইরাস ১৯৯৮ মালয়েশিয়ায় সুনগাই নিপাহ নামের একটি গ্রামে প্রথম সংক্রমণ ঘটায়। সেই গ্রামের নাম থেকেই এটি নিপাহ ভাইরাস নামে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করে। পরীক্ষা-নিরীক্ষায় পাওয়া যায় মালয়েশিয়ার দক্ষিণাঞ্চলে এক শুকরের খামার থেকে ১৯৯৮ সালে সর্বপ্রথম এ সংক্রমণের সূত্রপাত। খামারের মধ্যে গাছের ফল সংক্রমিত বাদুর খেয়ে খামারে ফেলেছে। সে আধা খাওয়া ফল খেয়ে খামারের শুকর সংক্রমিত হয়েছে। সংক্রমিত শুকর সিঙ্গাপুরে স্থানান্তর করায় সিঙ্গাপুরে সংক্রমণ বিস্তার লাভ করেছে। ১৯৯৮ সালের জানুয়ারি থেকে ১৯৯৯ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরে ২৭৬ ব্যক্তি এভাবে বাদুড় ও শূকর থেকে সংক্রমিত হন। এদের মধ্যে মৃত্যুর হার ছিল প্রায় ৪০%। এ দুটি দেশে এরপরে আর কোন সংক্রমণের তথ্য পাওয়া যায়নি।
বাংলাদেশে নিপাহ ভাইরাসের প্রথম সংক্রমণ শুরু ২০০১ সালে। এরপর থেকে বিরতি না দিয়ে প্রতিবছর ডিসেম্বর, জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে খেজুরের রস প্রাপ্তির সময়কালে সংক্রমণ ঘটছে। মৃত্যুর হারও অনেক। ৭০%এর বেশি। প্রথম সংক্রমণের ঘটনা ঘটে মেহেরপুর জেলায়। সংক্রমিত ব্যক্তি মারা যাওয়ার পরে ওই পরিবারের আরও ০৫জন আক্রান্ত হন। খেজুরের কাঁচা রস খেয়ে প্রথম ব্যক্তি সংক্রমিত হন। পরে সংক্রমিত ব্যক্তি থেকে আরও ১২ জনের মধ্যে এ রোগ বিস্তার লাভ করে। নওগাঁ জেলায় ২০০৩ সালে খেজুরের রস খেয়ে প্রথম এক ব্যক্তি সংক্রমিত হন এবং মৃত্যুবরণ করেন। পরে ঐ ব্যক্তির স্ত্রী ও তিন কন্যাও নিপাহ ভাইরাস সংক্রমণে মারা যান। গোয়ালন্দে ২০০৪ সালে সংঘটিত চিত্রে দেখা যায়- একই পরিবারের প্রথমে একজনের সংক্রমণ ঘটে। পরে তা পরিবারের অন্য সদস্যের মধ্যে দ্রুত বিস্তার লাভ করে।
২০০৪ সালে ফরিদপুরে ঘটা সংক্রমণের চিত্র আরও মারাত্মক। প্রথমে এক ব্যক্তি আক্রান্ত হন। সেখান থেকে তার মা, পুত্র, পরিবারের সদস্য ও প্রতিবেশীর মধ্যে সংক্রমণের ঘটনা ঘটে। স্থানীয় একজন মৌলভী একজন রোগীর সেবা শুশ্রসা করেন। সেই মৌলভী সংক্রমিত হন। তাকে দেখতে আসা বা তার সেবা করা অনুসারীদের ২২ জন নিপাহ ভাইরাসে সংক্রমিত হন। সেই সংক্রমিত ব্যক্তির সংস্পর্শে আসা ব্যক্তি থেকেও সংক্রমণের তথ্য আছে। এভাবে ০১ জন থেকে সেখানে ৩৪ জনের শরীরে সংক্রমণের চেইন আবর্তিত হয়েছে। ৫ বা ৪ স্তরের এ সংক্রমণে মানুষ থেকে মানুষে সংক্রমণের সংখ্যারই আধিক্য। ২০০৭ সালে টাঙ্গাইলে ঘটা সংক্রমণের একই চিত্র পাওয়া যায়। গ্রামে একজন আক্রান্ত হন। পরে ঐ আক্রান্ত ব্যক্তি থেকে ৬ জন পরিবারের সদস্য ও আত্মীয়দের শরীরে সংক্রমণ ঘটে।
মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরে যেমন আক্রান্ত শুকরের মাধ্যমে নিপাহ ভাইরাসের সংক্রমণ ঘটেছে। এদেশেও সংক্রমিত গরু ও ছাগলের মাধ্যমে মানুষের মধ্যে সংক্রমণের চিত্র আছে। মেহেরপুরে সংক্রমিত গরুর মাধ্যমে এবং নওগাঁয় সংক্রমিত ছাগলের মাধ্যমে মানুষের শরীরে সংক্রমণের ঘটনা ঘটেছে। তবে সংক্রমণের প্রথম মাধ্যম বাদুর এবং উৎস বাদুরের খাওয়া ফল বা খেজুরের রস। বাদুরের লালা ও মুত্রে নিপাহ ভাইরাসের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। ভারতে ২০০১ সালে শিলিগুরিতে এবং ২০০২ সালে নদীয়া জেলায় একই ফল খেকো বাদুরের মাধ্যমে সংক্রমণ হয়। মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়াসহ দক্ষিণ পূর্ব দেশসমূহেও নিপাহ ভাইরাস ছড়ায় ফল খেকো বাদুর। তবে কম্বোডিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও পাপুয়া নিউগিনিতে-এ প্রজাতির বাদুর ছাড়াও ফ্লাইং ফক্স নামের ভিন্ন প্রজাতির বাদুরের মাধ্যমে নিপাহ ভাইরাস সংক্রমণের ইতিহাস আছে।
নিপাহ ভাইরাস মিষ্টি জাতীয় তরলে বেশ কয়েকদিন বেঁচে থাকতে পারে। সে হিসেবে পাকা ফল এবং খেজুরের রসে ভাইরাস টিকে থাকতে পারে বেশ কিছুদিন। কাঁচা খেজুরের রস বা বাদুরের খাওয়া ফল খেলে মানুষ, পাখি ও প্রাণী নিপাহ ভাইরাসে সংক্রমিত হতে পারে। এ ভাইরাস মস্তিস্কে সেন্ট্রাল নার্ভাস সিস্টেমকে আক্রান্ত করে প্রদাহের সৃষ্টি করে। সাথে থাকে শ্বাসনালিতে সংক্রমণ। আক্রান্ত ব্যক্তির ফুসফুস, হার্ট, লিভার, কিডনীসহ সংবেদনশীল ও গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ-প্রতঙ্গে নিপাহ ভাইরাসের উপস্থিতি পাওয়া গেছে।
এমনিতে ভাইরাসের বিরুদ্ধে কোন এন্টিবায়োটিক কাজ করেনা। নিপাহ ভাইরাসের কোন টিকা বা প্রতিষেধক আবিষ্কার হয়নি। মস্তিস্কে প্রদাহ হলে যেসব ওষুধ দিয়ে চিকিৎসা হয়, এ ক্ষেত্রেও তাই ব্যবহার করা হচ্ছে। ফলে মৃতে্যুর হার সর্বাধিক। আমাদের দেশে ৭০% এর বেশি। কেউ অসুস্থ হলে অসুস্থ ব্যক্তিকে কাছে রাখা, শিশু হলে চুমু দিয়ে বা মুখে, মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করা, অসুস্থ ব্যক্তির সাথে একই বিছানায় ঘুমানো, একই থালা-বাসন ব্যবহার করা এসব আমাদের সংস্কৃতির অংশ। আক্রান্ত ব্যক্তির বা প্রাণীর লালা, থুথু ও কাশি, মুত্রের সাথে ভাইরাস থাকছে। আক্রান্ত ব্যক্তির পরিবারের সদস্য বা আত্মীয়-স্বজন এভাবে সংক্রমিত হচ্ছেন। গৃহপালিত গরু-ছাগলের নৈকট্য এভাবে সংক্রমণ বৃদ্ধি করছে । আমাদের দেশে বাদুরে যে পরিমাণ সংক্রমণ ঘটিয়েছে, তার থেকে বেশি সংক্রমণ হয়েছে আক্রান্ত মানুষ থেকে সুস্থ মানুষে।
অসচেতনতা, অসাবধানতা এবং অসুস্থ ব্যক্তির সানিধ্যে থাকার বিদ্যমান সংস্কৃতির কারণেই বর্তমানে দেশের ৩১ টি জেলায় নিপাহ ভাইরাসের সংক্রমণ হয়েছে বিগত কয়েক বছরে। মালয়েশিয়া বা সিঙ্গাপুরে সংক্রমণ বন্ধ হলেও নিপাহ ভাইরাস আমাদের রেহাই দেয়নি সেই সংক্রমণের শুরুর বছর থেকেই। সময় এসেছে এ বিষয়ে মানুষকে সচেতন করার। খেজুরের কাঁচা রস, বাদুরে খাওয়া ফল না খাওয়াসহ ব্যক্তি থেকে ব্যক্তি সংক্রমণের পথ বন্ধ করতে হবে। না হলে ভবিষ্যতে সকল জেলায় সংক্রমণ ঘটতে সময় লাগবে না। সাথে থাকবে মহামারি আকারে অসুস্থতা ও মৃত্যুর মিছিল। সংক্রমণের পথ বন্ধ করতে সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে। এর বিকল্প নেই।
---------------------------------------------------
ড. মিহির কান্তি মজুমদার, সাবেক সচিব।