রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বাল্যবিয়ে থামছেই না
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ৯ ডিসেম্বর,শনিবার,২০২৩ | আপডেট: ১০:০৭ এএম, ১০ অক্টোবর,বৃহস্পতিবার,২০২৪
বিয়ে হয়েছে মাত্র ১৩ বছর বয়সে। শিশু হয়েও আরেক শিশুকে পৃথিবীর আলো দেখাতে চেয়েছিলেন তিনি। ফলে বাধ্য হয়েই মাত্র ১৪ বছর বয়সে গর্ভপাত করাতে হয়েছে। গর্ভধারণের ৭ মাসের মাথায় ঘটে জীবনের বেদনাবিধূর এ ঘটনা। এতে অসুস্থ হয়ে পড়লেও শিশুটির মেলেনি আধুনিক চিকিৎসা। কবিরাজের ঝাঁড়-ফুঁকের ওপরই নির্ভর করতে হয়েছে তাকে।
এটি কক্সবাজারের উখিয়া ক্যাম্পে বসবাসরত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মুজালাফার গল্প। মুজালাফার স্বামী হিফজুর রহমান প্রাপ্তবয়স্ক। বয়স ২৬। গত বছর ক্যাম্প-৮/ডব্লিউ, এ-ব্লকের মাদ্রাসা শিক্ষক হিফজুর রহমানের সঙ্গে বিয়ে হয় মুজালাফার। এতো কিছুর পরও হয়তো আগামী বছর আবারও মা হতে হবে মুজালাফাকে।
কেন মুজালাফার বিয়ে হলো? স্বজনদের বক্তব্য
রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে বাল্যবিয়ে নৈমিত্তিক ঘটনা। কিন্তু কেন রোহিঙ্গা শিশুদের বিয়ের মাধ্যমে এভাবে ভয়ঙ্কর পরিণতির দিকে বাবা-মা ঠেলে দেন? প্রশ্নটি ছিল মুজালাফার মা মিনারা বেগমের কাছে। তিনি জানান, সামাজিক নিরাপত্তাহীনতার বোধ থেকেই মেয়েকে পাত্রস্থ করেছিলেন। তিনি মনে করেন- বিয়ের পর মুজালাফা সহিংসতা ও যৌন নিপীড়ন থেকে মুক্তি পেয়েছে।
মিনারা বেগম মনে করেন, মেয়েদের প্রথম পিরিয়ড হওয়ার পরপরই বিয়ে দিয়ে দিলে ভালো। কারণ ক্যাম্পে কোনো বাড়িতে অবিবাহিতা নারী থাকলে সহিংসতা ও যৌন হয়রানি বেড়ে যায়। সব সময় আতঙ্কে থাকতে হয় অভিভাবককে। নারীর গর্ভধারণ ক্ষমতা, প্রজনন স্বাস্থ্য, নবজাতকের মৃত্যু, মা ও শিশুর পুষ্টিহীনতাসহ কোনো ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকির বিষয়ে খুব ভালো জানাশোনা নেই মিনারা বেগমের।
মুজালিফার স্বামী হিফজুর রহমান মাদ্রাসা শিক্ষক। তাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল- কেন একটি শিশুকে বিয়ে করতে তিনি রাজি হয়েছিলেন? তার জবাব শুনে চমকে উঠবেন আপনিও। তার ভাষ্য অনুযায়ী নানা ধরনের গোনাহ থেকে রক্ষা করতেই শিশু মুজালাফাকে বিয়ে করেন তিনি।
‘আমার বোনদেরও মুজালাফার বয়সে বিয়ে দিয়েছি। ওরাও গুনাহ থেকে মুক্তি পেয়েছে।’ বলেন হিফজুর রহমান ।
বাল্যবিয়ে নিয়ে মিনারা বেগম এবং হিফজুর রহমানদের মতোই ধারণা প্রায় সবগুলো ক্যাম্পের বেশিরভাগ মানুষের। ২০১৭ সালে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসার পর ক্যাম্পগুলোর বাল্যবিয়ের খবর আসতে থাকে। তখন থেকেই বাল্যবিয়ের পেছনে এসব যুক্তি দেখান রোহিঙ্গারা।
বিয়ে মানেই বোঝামুক্ত পরিবার!
মুজালাফা যখন ছোট্ট শিশু তখন বাবা-মায়ের সঙ্গে ভালোই ছিল। ধীরে ধীরে বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মেয়েকে ঘিরে পরিবারের দুশ্চিন্তা বাড়তে থাকে। এই ভয় ক্যাম্পের কিছু দুষ্কৃতিকারীর কারণে। কারণ মুজালিফার বাবা-মা দেখেছেন অনেক মেয়েই দুষ্কৃতিকারীদের নিগ্রহ-নিপীড়নের শিকার হয়েছেন। তাদের হাত থেকে মেয়েকে রক্ষা করতেই বিয়ের আয়োজন করা হয়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে অনেক রোহিঙ্গা বলেছেন, ক্যাম্পের ভয়াবহ পরিস্থিতিতে বাড়িতে কন্যাশিশু থাকা অনেকের জন্য কাল হয়ে দাঁড়াচ্ছে। তাই অঘটন থেকে বাঁচতে বিয়ের বিকল্প দেখছেন না অভিভাবকরা। যেন আপদ বিদায় করতে পারলেই বাঁচেন বাবা-মা।
আবার পরিবারের আর্থিক অনটন থেকে কিছুটা মুক্তি মেলে মেয়েকে পরের বাড়ি পাঠাতে পারলে। কারণ মাথাপিছু যে পরিমাণ সাহায্য পাওয়া যায় তা দিয়ে সংসার চালানো কঠিন। ছেলে সন্তানকে তো আর ফেলে দেয়া যায় না, যায় কন্যা সন্তানকে। বিয়ের নামে আসলে রোহিঙ্গারা পরিবার থেকে কন্যাসন্তানের বোঝা কমিয়ে ফেলছেন।
শুক্রবারে বিয়ের ধুম!
বিয়ের জন্য সবাই শুক্রবার বা শনিবার বেছে নেন সরকারি ছুটি বিবেচনায় নিয়ে। কিন্তু রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আবার সরকারি ছুটি কিসের? এখানে তো কেউ আর সরকারি চাকরি করেন না। তারপরও প্রতি শুক্রবার ক্যাম্পগুলোতে বিয়ের ধুম পড়ে যায়। কারণ এখানে বাল্যবিয়ে ঠেকাতে এই দুই দিন কেউ থাকেন না।
কুতুপালং ক্যাম্প ১/ইস্ট এর সাবেক সাব মাঝি রোহিঙ্গা নেতা হামিদুর রহমান বলেন, ‘শুক্রবার ও শনিবার সরকারি বন্ধ। তাই ক্যাম্প ইনচার্জদের (সিআইসি) অফিসে না আসার সুযোগে প্রতিটি ক্যাম্পে বাল্যবিয়ের ধুম পড়ে। শনিবারের চেয়ে মুসলিমদের ধর্মীয় দিন শুক্রবারে বেশি বিয়ে হয়। এক মাসে চার শুক্রবার। এই চারদিনে ৩০টিরও বেশি ক্যাম্পে অর্ধশতের বেশি বিয়ে হয়।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে আরেক রোহিঙ্গা নেতা বলেন, শুক্রবার (৮ ডিসেম্বর) ক্যাম্প ১/ওয়েস্ট ডব্লিউ এর বাসিন্দা জকির আহমদের ছেলে আবুল ফয়েজসহ এ ক্যাম্পে ৫ থেকে ৬টি বাল্য বিয়ে হয়েছে।
শালবাগান ২৬ নম্বর ক্যাম্প (নয়াপাড়া এক্সটেনশন-বি) বি-১০ ব্লকের হেড মাঝি সিরাজুল্লাহ বলেন, ‘স্বাস্থ্যঝুঁকির ব্যাপারে অনেক বুঝানোর পরও বাল্যবিয়ের ধুম লেগে আছে ক্যাম্পে। সন্ত্রাসীদের তুলে নেয়ার ভয়ও আছে। আবার ভালো ছেলে পাওয়ার সুযোগটা হারাতে চান না অভিভাবকরা।’
গত ২ মাসে উল্লেখিত ব্লকে ১০টিরও বেশি বাল্য বিয়ে হয়েছে বলে জানান সিরাজুল্লাহ।
এ রকম শত শত অপ্রাপ্তবয়স্ক শিশুদের অনায়াসে বিয়ে হচ্ছে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে। দুর্বৃত্তরা তুলে নেবে এমন আতঙ্কে ১৭ নম্বর ক্যাম্প থেকে মিনু নামের এক নারী তার প্রথম পিরিয়ড হওয়া মেয়েটিকে পাঠিয়ে দিয়েছেন ২৬ নম্বর ক্যাম্পে বসবাসরত বাবার কাছে। তার দাবি, মেয়েটি বড় হয়েছে। যে কোনো মুহূর্তে তার উপর যৌন নিপীড়নকারীদের আক্রমণ আসতে পারে। তাই মেয়েকে বিয়ে দেয়ার জন্য বাবার কাছে পাঠিয়ে দিয়েছেন। মেয়ের শীঘ্রই বিয়ে দেবেন বলেও জানান তিনি।
ক্যাম্প ৮/ই এর সাব মাঝি আজিজুর রহমান বলেন, ‘২০১৭ সালে রোহিঙ্গা আসার এক বছর থেকে বাল্যবিয়ে শুরু হয়েছে। তখন পুরো ক্যাম্প থেকে মাসে দুই শতাধিক বাল্যবিয়ে হতো। এখন সরকারি ও বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার সচেতনতার মাধ্যমে তা কমে মাসে ৫০ থেকে ৬০টা হচ্ছে। তবে ওই ক্যাম্পের ৭৭ ব্লকে লোক সংখ্যা বেশি হওয়ায় সেখানে মাসে ১০-১২টি বাল্য বিয়ে হয়।’
অনেকেই হয়েছেন সচেতন
এদিকে বাল্যবিয়ের ব্যাপারে সচেতনতাও সৃষ্টি হয়েছে অনেকের মধ্যে। যেমন ক্যাম্প ৮/ই, ৭৫ ব্লকের বাসিন্দা ইয়াসমিন আক্তার। তিনি জানান, প্রাপ্তবয়স্ক না হওয়া পর্যন্ত তিনি মেয়েকে বিয়ে দেবেন না। অনেক শিশুকেই বাল্যবিয়ের শিকার হয়ে দুর্ভোগে পড়তে দেখে তার মধ্যে এই বোধ জন্মেছে যে, বাল্যবিয়ে সুফল বয়ে আনে না।
ইয়াসমিন আক্তার বলেন, ‘আমার মেয়েকে অল্প বয়সে বিয়ে দিয়ে সর্বনাশ করতে চাই না। অল্প বয়সে বিয়ে দিয়ে অনেকের ক্ষতি দেখেছি। তাই নিজের মেয়ের প্রতি যত্নবান হয়ে এখন বিয়ে না দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’
জামাল হোসেন-শওকত আরা দম্পতি তাদের মেয়ে রোকেয়াকে (১৬) অল্প বয়সে বিয়ে দেবেন না বলে জানিয়েছেন। জামাল হোসেন বলেন, ‘আমার মেয়ে আমার জন্য বোঝা নয়। পরিপূর্ণ বয়স এবং স্বাস্থ্যগতভাবে ভালো থাকলে তারপর ভালো পাত্র দেখে বিয়ে দেবো এর আগে নয়।’
তাদের মতো একই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ইসমাইল-আমেনা খাতুন দম্পতি। সাড়ে ১৬ বছর বয়সী সাহেরাকে অনেকে দেখতে এলেও তারা বিয়ে দেবে না বলে জবাব দিয়েছেন। ইসমাইল বলেন, ‘বিয়ের বয়স ২০ বছর পার হলে তখন তার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী চিন্তা করবো বিয়ে দেব কি না? অল্প বয়সে মেয়েকে বিয়ে দিয়ে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিতে পারব না। এই ভুল জীবনেও করব না। আমরা এখন সচেতন।’
কীভাবে বাড়ছে সচেতনতা?
ক্যাম্পগুলোতে সন্তান উৎপাদনের মতো বাল্যবিয়েও প্রায় মহামারি আকার ধারণ করেছিল। যার ভয়াবহতা অনুধাবন করতে পেরে সরকারি-বেসরকারি অনেক সংস্থা কাজ শুরু করেছে। যার প্রভাবও পড়ছে স্থানীয়দের মধ্যে।
পার্টনার্স ইন হেলথ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (পিএইচডি) জ্যেষ্ঠ উপ-পরিচালক ডা. মো. দানিয়েল হোসাইন বলেন, ‘সামাজিক নিরাপত্তাহীনতাজনিত সংকটের কারণে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বাল্য বিয়ের প্রবণতা ছিল। এটি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে স্বাভাবিক একটি বিষয় ছিল, এখনও আছে কোনো কোনো ক্যাম্পে। বাবা-মায়েরা চিন্তা করেন, তাদের মেয়ের তাড়াতাড়ি বিয়ে দিতে পারলেই মেয়েটা নিরাপদে থাকবে। এই প্রথার সঙ্গে তারা অভ্যস্ত। কিন্তু বাল্য বিয়ের বিভিন্ন ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে তাদের জ্ঞান ছিল না। আমরা তাদের মধ্যে বাল্য বিয়ের ঝুঁকি নিয়ে সচেতনতা সৃষ্টি করেছি। বাড়ি বাড়ি গিয়ে তাদের বুঝিয়েছি, সচেতন করেছি। কমিউনিটি নেতা, ধর্মীয় নেতাদের সঙ্গে নিয়ে অভিভাবকদের বুঝিয়ে বাল্য বিয়ের প্রথা অনেকটা কমিয়ে নিয়ে এসেছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘অল্প বয়সে বিয়ে হলে গর্ভধারণে সমস্যা ও বাচ্চা প্রসবে বাধাগ্রস্ত হয়। মা ও শিশুর শারিরীক দুর্বলতাসহ প্রতিটি ধাপে ধাপে অক্ষমতা সৃষ্টি হয়। পুষ্টিহীনতা সৃষ্টি হয়। এমনকি বাচ্চা প্রসবের সময় মা ও শিশুর মৃত্যুর ঝুঁকিও থাকে। সব মিলিয়ে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়তে হয়। এই বিষয়ে সচেতনতা গড়ে তোলার চেষ্টা করছি। এতে আমাদের সরকারিভাবে সহযোগিতা করছেন প্রতিটি ক্যাম্পের ইনচার্জ (সিআইসি)। এসব ঝুঁকির বিষয়গুলো রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী বুঝতে শুরু করেছে। ফলে প্রতিটি ক্যাম্পে আগের চেয়ে অনেক বাল্য বিয়ে কমে এসেছে।’
শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, ‘রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে আন্তরিকভাবে কাজ করে যাচ্ছে সরকার। আমরা ক্যাম্পের বাসিন্দাদের সর্বোচ্চ সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছি। সাধারণত ১৮ বছর বয়সের আগে কোনো মেয়ের বিয়ের অনুমতি দেয়া হয় না। এরপরও যারা সংশ্লিষ্টদের না জানিয়ে গোপনে বাল্যবিয়েতে জড়িয়ে পড়ছেন তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।’