স্বাস্থ্যঝুঁকি সত্ত্বেও নিষিদ্ধ ‘গোল্ডেন রাইস’ অনুমোদনে তৎপরতা কার স্বার্থে
ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ৭ মে,মঙ্গলবার,২০২৪ | আপডেট: ০৩:২৯ এএম, ২৯ ডিসেম্বর,রবিবার,২০২৪
দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে ‘গোল্ডেন রাইস’ উৎপাদনে কাজ করেছে ইন্টারন্যাশনাল রাইস রিসার্চ ইনস্টিটিউট (ইরি)। কিন্তু পৃথিবীর কোনো দেশেই চাষের অনুমোদন মেলেনি। ২০২১ সালে ফিলিপাইনে বাণিজ্যিক চাষের অনুমোদন পেলেও গত এপ্রিলে দেশটির আদালত গোল্ডেন রাইসে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন। এই ধান পরিবেশ এবং মানবদেহের জন্য মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ বলে জানিয়েছেন ওই দেশের আদালত। কিন্তু বাংলাদেশে এ ধানটি নিয়ে এক দশকেরও বেশি সময় ধরে পরীক্ষা-নিরীক্ষা হচ্ছে। গোল্ডেন রাইস কৃষক পর্যায়ে চাষাবাদের অনুমোদনের জন্য তৎপর হয়ে উঠেছে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) ও ইরি। কিন্তু পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের ছাড়পত্র না পাওয়ায় জাতটি ছাড় দিতে পারছে না কৃষি মন্ত্রণালয়। এমন পরিস্থিতিতে পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো উদ্বেগ জানিয়ে বলছে, গোল্ডেন রাইস চাষের ব্যাপারে কৃষকদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে। বহুজাতিক কোম্পানির সিদ্ধান্ত কৃষকদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া যাবে না।
গোল্ডেন রাইস নিয়ে তৎপরতা
ইরি ও মার্কিন দাতব্য সংস্থা বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশনের সহায়তায় ব্রি গোল্ডেন রাইস উদ্ভাবন করে। সাধারণত চালের রং সাদা হলেও বিশেষ এই জাতের চালের রং হলদে সোনালি। তাই নাম দেওয়া হয়েছে গোল্ডেন রাইস। এটি জেনেটিক্যালি মডিফায়েড শস্য। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে বিআর-২৯ জাতের ধানের সঙ্গে ভুট্টার জিন মিলিয়ে এই গোল্ডেন রাইসের জাতটি উদ্ভাবন করা হয়েছে। ব্রি বলছে, এটি ‘ভিটামিন-এ’ সমৃদ্ধ ধানের জাত। ২০০৬ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত আট বছর এই ধান নিয়ে গবেষণা করে ব্রি। কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে ২০১৭ সালে কৃষি মন্ত্রণালয়ের কাছে গোল্ডেন রাইসের জৈব নিরাপত্তা (বায়োসেফটি) বিষয়ক অনুমোদনের জন্য আবেদন করে ব্রি। পরিবেশ ছাড়পত্রের জন্য জাতটি এখন পরিবেশ অধিদপ্তরে আটকে আছে। জাতটি অনুমোদনের বিষয়ে সর্বশেষ গত ৪ মার্চ কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আব্দুস শহীদের সঙ্গে সচিবালয়ে সাক্ষাৎ করেছেন ব্রি ও ইরির শীর্ষ কর্মকর্তারা।
ফিলিপাইনসহ বিশ্বব্যাপী উদ্বেগ
জেনেটিক্যালি মোডিফায়েড অর্গানিজম বা জিএমও নিয়ে বিশ্বব্যাপী এরই মধ্যে ব্যাপক উদ্বেগ রয়েছে। বার্তা সংস্থা এএফপির এক সংবাদে ফিলিপাইনের ক্যামারাইনস সুর প্রদেশের ধান চাষি ও জিএমও-বিরোধী জোটের সম্মুখসারির নেতা মেলানিয়া গুয়াভেজ বলেন, গোল্ডেন রাইস আমাদের জমি বিষাক্ত করে তুলবে। এর আগে ২০১৩ সালে তাঁর প্রদেশেই পাইলট প্রকল্পের আওতায় গোল্ডেন রাইসের আবাদ শুরু করা হয়েছিল। সে বছরের আগস্টে গুয়াভেজসহ শত শত কৃষক বহু জমি থেকে ধানের চারা উপড়ে ফেলে দিয়েছিলেন।
ফিলিপাইন কলেজ অব সায়েন্সের ডিন ও অ্যাডভোকেটস অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি ফর দ্য পিপলের চেয়ারম্যান জিওভান্নি তপাং বলেন, কৃষিক্ষেত্রে উন্নয়নের বিষয়গুলো চলে গেছে কৃষি রাসায়নিক বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর হাতে। চার কেজি গোল্ডেন রাইসে যে পরিমাণ ভিটামিন এ রয়েছে, তা একটি গাজরেই পাওয়া যায়।
উদ্বিগ্ন দেশের পরিবেশ কর্মীরাও
গোল্ডেন রাইস নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করছে বাংলাদেশের পরিবেশ কর্মীরাও। উন্নয়ন বিকল্পের নীতি-নির্ধারণী গবেষণার (উবিনীগ) নির্বাহী পরিচালক ফরিদা আখতার বলেন, এ বীজ বাংলাদেশে আনতে কৃষি রাসায়নিক ও বীজ কোম্পানি সিনজেন্টা নিয়মিত অনুদান দিচ্ছে। গোল্ডেন রাইসে ভিটামিন ‘এ’র অভাব দূর করার দাবিটি হলো করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর একটি বানানো গল্প, তাদের মূল উদ্দেশ্য নতুন পণ্য থেকে অর্থ উপার্জন করা। গোল্ডেন রাইস খেলে ক্যান্সার-অটিজম হতে পারে।
বীজ বিস্তার ফাউন্ডেশনের সভাপতি ড. এম এ সোবহান বলেন, বাংলাদেশে গোল্ডেন রাইস প্রবর্তনের জন্য বহুজাতিক কোম্পানি সিনজেন্টার এবং ব্রির মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এসব চুক্তিতেও বাণিজ্যিক ও মেধাস্বত্ব অধিকার কোম্পানির। এসব গণবিরোধী চুক্তি বাংলাদেশের হাজার বছরের লোকায়ত জ্ঞান, বীজ সম্পদসহ সামগ্রিক কৃষি ব্যবস্থাকে বহুজাতিক কোম্পানির করপোরেট নিয়ন্ত্রণে নিয়ে যাবে।
শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষিতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. পরিমল কান্তি বিশ্বাস বলেন, গোল্ডের রাইস পরিবেশ ও মানবস্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ কিনা– তা নিয়ে সারা পৃথিবীতেই সন্দেহ আছে। এই ধান নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে কিনা– তা যতক্ষণ পর্যন্ত একেবারে নিশ্চিত হওয়া যাবে না, ততক্ষণ পর্যন্ত এটি বাংলাদেশে অনুমোদন দেওয়া ঠিক হবে না।
পরিবেশবিদদের সংবাদ সম্মেলন
গতকাল সোমবার জাতীয় প্রেস ক্লাবে ‘জিএম শস্য গোল্ডেন রাইস এবং বিটি বেগুন: বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তনের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় প্রশ্নের নিরসন জরুরি’ শীর্ষক মতবিনিময় সভার আয়োজন করে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা), উবিনীগ, জিএমও-বিরোধী মোর্চা, নয়া কৃষি আন্দোলন ও নাগরিক উদ্যোগ।
বেলার প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, জিনগত পরিবর্তন করা খাদ্যশস্য নিয়ে উন্নত ও উন্নয়নশীল বিশ্বে বিতর্ক চলছে। জিএমও প্রযুক্তির কোনো শস্যে অন্য কিছু জিন ঢুকিয়ে দিলে এটার বিক্রিয়া, প্রতিক্রিয়া কী হবে– সেটা সুনির্দিষ্ট করে বিজ্ঞান বলতে পারেনি। এমন বিপদযুক্ত জিনিসের প্রতি হ্যাঁ বলে ফেললে, বিপদ ঘটলে সামাল দেওয়া অসম্ভব হতে পারে।
বাংলাদেশ কৃষক ফেডারেশনের সভাপতি বদরুল আলম বলেন, বীজ ঐতিহ্যগতভাবে সংরক্ষণ করেন কৃষক। এখন সেই বীজ সংরক্ষণের দায়িত্ব নিয়েছে বহুজাতিক কোম্পানি।
কী বলছে ব্রি
ব্রির উদ্ভিদ প্রজনন বিভাগের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. আবদুল কাদের ২০১৫ সাল থেকে গোল্ডেন রাইসের প্রধান গবেষক হিসেবে কাজ করছেন। তিনি বলেন, পরিবেশবিদদের বক্তব্য বিজ্ঞনসম্মত নয়। অন্যান্য জাতের মতোই এ ধান, সারাজীবনই বীজ হবে। এটি বিটা ক্যারোটিন সমৃদ্ধ।