তিন চাকার যান নিয়ে অসহায় পুলিশ
ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ৪ মার্চ,শনিবার,২০২৩ | আপডেট: ০১:৪১ পিএম, ২৪ ডিসেম্বর,মঙ্গলবার,২০২৪
উত্তরের মহাসড়কে বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে ত্রিচক্র যান। দূরপাল্লার যানবাহনের সঙ্গে মহাসড়কে প্রতিযোগিতা করতে গিয়ে হরহামেশা দুর্ঘটনার মুখে পড়ছে এই বাহনগুলো। প্রধান সড়কগুলোতে সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত থাকে তিন চাকার যানবাহনের রাজত্ব। শুধু তাই নয়, প্রশাসনকে ম্যানেজ করে এসব অবৈধ যানের স্ট্যান্ড করা হয়েছে মহাসড়কের ওপরেই।
উত্তরের বিভিন্ন জেলার মহাসড়কে গত তিন বছরে সিএনজিচালিত অটোরিকশা, ব্যাটারি অটোরিকশা ও ভটভটি দুর্ঘটনায় মারা গেছেন দুই শতাধিক মানুষ। আহত হয়েছেন সহস্রাধিক। অর্থাৎ প্রতি সপ্তাহে মারা যাচ্ছেন দু’জন মানুষ এবং আহত হচ্ছেন সাতজন। হাইওয়ে পুলিশ, যাত্রী কল্যাণ সমিতি ও বেসরকারি একাধিক এনজিওর পর্যালোচনা থেকে মিলেছে এসব তথ্য।
দেশের মহাসড়কগুলোতে দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি বেড়ে যাওয়ায় ২০১৫ সালের ১ আগস্ট থেকে সব মহাসড়কে থ্রিহুইলার অটোরিকশা, অটোটেম্পো ও সব শ্রেণির অযান্ত্রিক যানবাহন চলাচল নিষিদ্ধ করে আদেশ জারি করে সরকার। আদেশ জারির পর পুলিশ অভিযান চালালেও এখন তা অনেকটাই কমে এসেছে।
যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক জানান, সরকারি আদেশ না মেনে জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়কে অবাধে চলাচল করছে ইজিবাইক, সিএনজি অটোরিকশাসহ থ্রিহুইলার। এসব বাহন বেড়ে যাওয়ায় দুর্ঘটনায় হতাহতের সংখ্যা বাড়ছে। এটি বন্ধ করা না গেলে সড়কে অরাজকতা কমবে না।
সরেজমিন দেখা গেছে, বগুড়া-ঢাকা মহাসড়কের শাজাহানপুর অংশে মহাসড়ক দখল করে আছে সিএনজিচালিত অটোরিকশা। এ সড়কেই রয়েছে অটোরিকশার একাধিক অবৈধ স্ট্যান্ড। সেখানে এলোমেলো পার্ক করা হচ্ছে শত শত যান।
যাত্রীরা বলছেন, মহাসড়কে সিএনজিচালিত অটোরিকশা ওঠা নিষিদ্ধ হলেও সংশ্লিষ্ট দপ্তর তা বাস্তবায়নে ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে। আবার তিনজনের আসনে বসছেন পাঁচজন। যেখানে-সেখানে যাত্রী ওঠানামা করা হচ্ছে। এতে প্রায়ই ঘটছে দুর্ঘটনা।
সিএনজিচালিত অটোরিকশাচালক আবদুল কাদের বলেন, বিভিন্ন রুটের অন্তত তিনশ অটোরিকশা এই মহাসড়কে চলাচল করে। মহাসড়কের উভয় পাশ দিয়ে বগুড়া শহর এবং অন্য উপজেলার সঙ্গে যোগাযোগের শাখা সড়ক আছে। এতে সময় একটু বেশি লাগে, তবে দুর্ঘটনার আশঙ্কা কম থাকে।
উত্তরের জেলাগুলোর মধ্যে সিরাজগঞ্জের হাটিকুমরুল, বগুড়ার শেরপুর, নন্দীগ্রামের কুন্দারহাট ও গোবিন্দগঞ্জের ফাঁসিতলায় রয়েছে হাইওয়ে পুলিশের থানা ও ক্যাম্প। অভিযোগ রয়েছে, এসব থানা ও ক্যাম্পে দায়িত্বরত কিছু অসাধু পুলিশ সদস্য মাসিক চুক্তির ভিত্তিতে অবৈধ এসব যানবাহনকে মহাসড়কে চলাচলের সুযোগ করে দেয়। এ কারণে গোপনে নয়, বরং প্রকাশ্যে দূরপাল্লার যানবাহনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলে তারা। গতির দিক থেকেও বাস-ট্রাককে পেছনে ফেলে রীতিমতো ভীতিকর পরিস্থিতি তৈরি করে। আর বেপরোয়া গতির কারণে প্রায়ই বড় ধরনের দুর্ঘটনার মুখোমুখি হতে হয়।
অটোরিকশার যাত্রী শেরপুরের মির্জাপুর গ্রামের আবুল হোসেন বলেন, মহাসড়কে চালকরা কারও কথা শোনেন না। তাঁরা কেউই প্রশিক্ষিত নন। যাত্রীদের অনুরোধ উপেক্ষা করে দ্রুতগতিতে চালানোর কারণে দুর্ঘটনা ঘটে।
এনজিওকর্মী আমেনা বেগম বলেন, মহাসড়কে মাঝেমধ্যে পুলিশকে তৎপর হতে দেখি। এটা হঠাৎ কেন আবার বন্ধ হয়ে যায়? আসলে পুলিশের সঙ্গে চালকদের একটা মাসিক চুক্তি আছে। এটা অনেক চালক অবলীলায় স্বীকার করেন। পুলিশ ব্যবস্থা নিলে ঝুঁকি অনেক কমে যেত।
শেরপুরের ধুনট মোড় এলাকার বাসিন্দা আকবর মিয়া বলেন, সকাল থেকে রাত পর্যন্ত স্ট্যান্ড ও বাজারের মুখগুলোতে সিএনজিচালিত অটোরিকশা ঠাসাঠাসি করে থাকে। তিনজনের বসার আসন থাকলেও পাঁচজন যাত্রী নিয়ে চলাচল করে। যেখানে-সেখানে যাত্রী ওঠানামা করা হয়। বছরের পর বছর এ অবস্থা চলে আসছে। অথচ এই মহাসড়ক দিয়ে উত্তরাঞ্চলের ১১ জেলার শত শত ভারী যানবাহন চলাচল করে। পাশেই হাইওয়ে পুলিশ ফাঁড়ির সদস্যরা বিষয়গুলো দেখেও না দেখার ভান করেন।
বগুড়া জেলা অটোটেম্পো, অটোরিকশা ও সিএনজি পরিবহন মালিক সমন্বয় কমিটির সাবেক সভাপতি আসাদুর রহমান দুলু দাবি করেন, এ জেলায় সব মিলিয়ে অন্তত ২০ হাজার থ্রিহুইলার সড়ক ও মহাসড়কে চলাচল করে। এতে অন্তত ৩০ হাজার মানুষের জীবিকার ব্যবস্থা হয়। তবে আমরাও চাই, এটা চলাচলে শৃঙ্খলা ফিরে আসুক। এ ব্যাপারে সবার আগে মহাসড়কে দায়িত্বে থাকা পুলিশ সদস্যদের স্বচ্ছতার সঙ্গে কাজ করতে হবে।
বিআরটিএ বগুড়া অফিসের সহকারী পরিচালক মাইনুল হাসান জানান, দেশের ২২টি জাতীয় মহাসড়কে থ্রিহুইলার চলাচল বন্ধে সরকারি নির্দেশ রয়েছে। মাঝেমধ্যে তাঁরা ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে জরিমানা করে থাকেন। অনেক সময় মহাসড়কে গিয়ে কোনো থ্রিহুইলার গাড়ি দেখা যায় না। আবার কখনও এত গাড়ি থাকে যে, অভিযান চালাতে হিমশিম খেতে হয়।
বগুড়ার শেরপুর হাইওয়ে পুলিশ ফাঁড়ির ওসি জয়নাল আবেদিন বলেন, মাসিক কোনো চুক্তি করা হয় না। আমরা সিএনজির বিরুদ্ধে অভিযান চালাচ্ছি। মামলা দিচ্ছি। আসলে এরা পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে চলাচল করে।
হাইওয়ে পুলিশ বগুড়া রিজিয়নের পুলিশ সুপার হাবিবুর রহমান বলেন, প্রতিনিয়ত অভিযান চলছে, চালকদের সচেতন করা হচ্ছে। তবু এই যানের দৌরাত্ম্য কমছে না। মহাসড়ক নিরাপদ করতে হলে এখন পুলিশের পাশাপাশি সাধারণ মানুষের উদ্যোগ নিতে হবে