মূল্যবোধের চরম অবক্ষয় জীবন্ত নবজাতক ফেলে দেওয়ার ঘটনা বাড়ছে
ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ৭ সেপ্টেম্বর,বৃহস্পতিবার,২০২৩ | আপডেট: ০৮:৫০ এএম, ২৬ ডিসেম্বর,বৃহস্পতিবার,২০২৪
জন্মের পরপর জীবন্ত নবজাতককে ময়লার স্তূপে বা ডাস্টবিনে ফেলে দেওয়ার ঘটনা বাড়ছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে জলাশয়, ময়লা আবর্জনার স্তূপ, ডাস্টবিন, শৌচাগার, ড্রেন, খাল ও নালা-নর্দমায় নবজাতককে ফেলা দেওয়ার ঘটনা অহরহ ঘটছে। অনেক মা-বাবা তাদের অনৈতিকতা ও অপরাধ ঢাকার জন্য মূলত গর্ভপাত করে নিষ্পাপ ও নিরপরাধ নবজাতককে ফেলে দিচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
সদ্যোজাত ফুটফুটে শিশুর হাসি দেখে নিষ্ঠুর মানুষের হৃদয়ও কোমল হয়ে ওঠে। অথচ পরিত্যক্ত জায়গায় প্রায়ই মিলছে নবজাতক। ২৭ আগস্ট বগুড়ায় শপিংব্যাগ থেকে একটি মেয়ে নবজাতক উদ্ধার হয়েছে। ২৫ আগস্ট পাবনায় ডাস্টবিন থেকে এক নবজাতকের মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। গত ২৩ আগস্ট বিকালে ফতুল্লার মাসদাইর সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের সামনে থেকে একটি নবজাতকের মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ।
এর আগে ১৮ আগস্ট নারায়ণগঞ্জে ডাস্টবিনের ভেতর থেকে এক নবজাতকের মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। এর আগে ৩১ জুলাই গাজীপুরের শিল্পনগরী টঙ্গীতে এক নবজাতকের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। তার আগে ২৪ জুলাই ঢাকার রমনা উদ্যানের ভেতরে একটা কাগজের বাক্সের মধ্যে দুটি নবজাতক মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়।
এদিকে, সদ্যজাত শিশু বা নবজাতক ফেলে দেওয়ার ঘটনা ক্রমেই বাড়ছে। তার মধ্যে ভাগ্যবান কাউকে জীবিত আর হতভাগ্যদের পাওয়া যাচ্ছে মৃত অবস্থায়। নিষ্পাপ ও নিরপরাধ জীবিত নবজাতকের অনেকেই পরবর্তীতে অমূল্য মানবজীবন লাভ করে। অথচ মৃত শিশুটি দুনিয়ার সুখ ভোগ করার আগেই নির্মম ও নিষ্ঠুর পরিণতির শিকার হচ্ছে। মাঝে মধ্যে সংবাদপত্রের পাতা উল্টালে দেখা যায়, ডাস্টবিনে ফেলে দেওয়া নবজাতক কখনো কখনো শিয়াল-কুকুরের খাবারে পরিণত হচ্ছে। তখন শিশুটি বুক ফাটা চিৎকার করে বেঁচে থাকার আপ্রাণ চেষ্টা করে। শিশুটি বলতে পারে না আমাকে বাঁচাও আমি নষ্ট জীবনের এক অনাগত আগামী, আমি বাঁচতে চাই। হতভাগ্য শিশু মৃত্যুর সময় পায় না মায়ের বুকের এক ফোটা দুধ বা পানি। নবজাতক ফেলে দেওয়ার পর, তাকে মৃত বা জীবিত উদ্ধারের পর নবজাতকের অদৃশ্য জন্মদাত্রী মা নিজের বুকের ধন কীভাবে রাস্তায় ফেলে দিলেন, তার জন্য কি একবারও মন কাঁদে না।
এদিকে, দেশে প্রতিবছর এমন কত নবজাতক পাওয়া যায়, তার পরিসংখ্যান নেই কোনো সংস্থা বা মানবাধিকার সংগঠনের কাছে। ফেসবুক, মোবাইলের অপব্যবহার, আকাশ সংস্কৃতির প্রভাবে এসব ঘটছে বলে দায়ী করছেন অনেকে।
সমাজবিজ্ঞানীরা বলেন, সমাজে এই নবজাতকদের পরিচয় দিতে পারছে না বলে তারা ফেলে দিচ্ছে, হত্যা করছে। পারিবারিক বন্ধন ঢিলে-ঢালা ও অনৈতিক সম্পর্কে জড়িয়ে যাওয়াই মূলত দায়ী। পরিবার সমাজব্যবস্থার মূলভিত্তি। সামাজিক অস্থিরতায় পারিবারিক কলহের ঘটনা বেড়ে গেছে। বেড়েছে পরিবারের এক সদস্যের হাতে আরেক সদস্যের খুন হওয়ার ঘটনা। স্বামী-স্ত্রীর কলহের কারণে জীবন দিতে হচ্ছে নিষ্পাপ শিশুদের।
তারা আরও বলেন, পারিবারিক দ্বন্দ্বে পরিবারের সবাই একসঙ্গে আত্মহত্যা করছে। মানুষ এখন শুধু ঘরের বাইরেই নয়, তার আপনজনদের কাছেও নিরাপদ নয়। সামাজিক অপরাধ প্রবণতা দিনের পর দিন বাড়ছে। হত্যা ও ধর্ষণের মতো ঘটনাগুলো থেকেই বুঝা যাচ্ছে, সামাজিক অবক্ষয় কোন পর্যায়ে পৌঁছেছে। ধর্মীয় মূল্যবোধের পাশাপাশি দেশের যুব সমাজের মধ্যে নীতি নৈতিকতা বোধের অভাব বাড়ছে। নবজাতকদের রাস্তায় ফেলে দেওয়া সামাজিক মূল্য বোধের অবক্ষয়।
সমাজবিজ্ঞানী অধ্যাপক ডক্টর রিজিয়া সুলতানা বলেন, সামাজিক অবক্ষয়ের কারণেই বিয়ে বহির্ভূত অনেক ধরনের সম্পর্কে জড়িয়ে যাচ্ছে নারী-পুরুষ। ফলে এসব নবজাতকদের জন্ম যেমন বেড়ে যাচ্ছে, তেমনি বেড়ে যাচ্ছে জীবন্ত নবজাতককে ফেলে দিয়ে সব দায় থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার ঘটনা। এতে করে নবজাতকের জন্মদাতা বাবা-মা হয়তো নিষ্কৃতি পাচ্ছেন, কিন্তু ফেলে দেওয়া নবজাতকের কপালে কী ঘটছে- তা কি কেউ এবার ভেবেছেন। ডাস্টবিন, ফুটপাত, ঝোপ ও শৌচাগার এসবই যেন অনাকাক্সিক্ষত শিশুগুলোর ঠিকানা হয়ে উঠছে। কান্নার শব্দে আঁতকে ওঠা লোকজন দ্রুত উদ্ধার করে কাউকে নিয়ে যায় হাসপাতালে। আর মৃত উদ্ধার হলে স্থান হয় মর্গে। এরপর পুলিশ দায়ের করে হত্যা মামলা। কিন্তু এ পর্যন্ত একজনও আটক হয়নি। এদিকে, পুলিশ বলছে, জাতীয়ভাবে ডিএনএ ব্যাংক করা গেলে, ফেলে যাওয়া শিশুর পরিচয় জানা যাবে। এরপর ফেলে যাওয়া নবজাতকের মাতৃ ও পিতৃ পরিচয় গণমাধ্যমে প্রচার করতে হবে।
এতে নবজাতক হত্যা এবং রাস্তা-নর্দমায় ফেলে যাওয়ার প্রবণতা কমবে। রাজধানীর তেজগাঁও এলাকার একটি মসজিদের ইমাম হাজী আক্কাছ আলী বলেন, দেশ আধুনিকতার দিকে যতই যাচ্ছে ততই বাড়ছে এ ধরনের ঘটনা। যৌনশিক্ষা বাধ্যতামূলক করাসহ এই বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির উপর জোর দিতে হবে। অনৈতিক সম্পর্ক এবং কিশোর-কিশোরীদের আবেগের ফলে জন্মানো এসব শিশুকে ডাস্টবিনে, রেলস্টেশন ও বাসস্ট্যান্ড এবং গণশৌচাগার থেকে পাওয়া যায়। এসব ঘটনা থেকে পরিত্রাণে সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধ বাড়াতে হবে। আমরা যতই আধুনিক হই না কেন, পরিবারকে সন্তানের দায়িত্ব নিতে হবে। মা-বাবা পেশার কারণে যত ব্যস্ত থাকুন না কেন, জীবন সম্পর্কে সন্তানকে শিক্ষা তাদের দিতে হবে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, সাধারণত বিয়ে বহির্ভূত সম্পর্ক, স্বামী পরিত্যক্ত কিংবা ধর্ষণ থেকে জন্মানো শিশুগুলোর ক্ষেত্রেই এমন পরিণতি বেশি হচ্ছে বলে জানান ভোক্তভোগীরা। এছাড়া ছেলে শিশু প্রত্যাশা করার পর মেয়ে শিশু জন্মানোর কারণেও অনেক পরিবার শিশুদের রাস্তায় ফেলে দিচ্ছে। জন্ম নিয়ন্ত্রণ বা জন্ম নিরোধ বিষয়ে সচেতনতার অভাবও একটা বড় কারণ।
এ বিষয়ে অ্যাডভোকেট আব্দুল মোবিন বলেন, দেশের আইনানুযায়ী কোনো শিশু মাতৃগর্ভে ৪ মাস পার করলে শিশুটি পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে গণ্য হয়। এবং জন্ম হওয়ার আগে তার নামে সম্পত্তিও লিখে দেওয়া যায়। তাই নবজাতক শিশুদের হত্যা করার বিষয়ে সুষ্ঠু তদন্ত হওয়া রাষ্ট্রের দায়িত্ব।