জালাল উদ্দিন আহমেদ
অস্তিত্ব বিড়ম্বনায় বাঙালী
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ৫ জানুয়ারী,বৃহস্পতিবার,২০২৩ | আপডেট: ০২:১০ পিএম, ২০ ডিসেম্বর,শুক্রবার,২০২৪
বাঙালীর কপাল বড় পোড়া। কোন্ কুক্ষনে যে তার জন্ম ঠিকুজি আবিস্কারের পথচলা শুরু হয়েছিল আল্লাহ মালুম। আবিস্কার বলছি এই কারনে যে, বেশ তো ছিলাম সেইসব বাউল ভাটিয়ালী হরিণ ডাঙ্গার মাঠে ঘাটে। হাটে মাঠে ঘাটে সর্বত্রই এক আদিত্ব নিংড়ানো আদিমতা নিয়ে জনপদের চাঞ্চল্য ছিল। ছিল অকৃত্রিম প্রাকৃতিক পরিবেশের এক হৃদয় ছোঁয়া কলকাকলি। আজ নেই কোন কোলাহল, ইচিং বিচিং ডাংগুল্লির কিশোর কিশোরীর অভয়ারন্যের উদ্যমতা। চারিদিকে শুধুই শুন্যতা। জনপদের বাঙালী আজ রূদ্ধশ্বাস উর্দ্ধপানে জঠরের জ্বালা নিবারনে যুদ্ধরত। দূর্বৃত্তের অবাধ গতিময়তায় জনপদের বেহাল অবস্থা। মানুষ নামের মনহুশদের বিচরনে সমাজের শাশ্বত আবাহন আজ ছত্রাখান হয়ে যাচ্ছে। সমাজে সম্মান ও নৈতিক বচনের সামান্যতম কদর নেই। কাকেদের একপক্ষীয় কা কা শব্দে আকাশ বাতাস ভারী হয়ে গেছে। সেই মধ্যযুগীয় রাজা জমিদারি প্রথার আলখেল্লা আজ ডিজিট্যাল স্মার্ট নামের নতুন চাদরে আমাদের গ্রাস করতে বসেছে।
বাঙালীর ভাগ্যান্নয়নে শুধু কাঁচিই চালানো হয়েছে। একের পর এক চলেছে পরীক্ষা নিরীক্ষা। পুরনো প্রাচীনের আদিখ্যেতায় না গিয়ে বিগত এক শোয়া'শ বছরের ঠিকুজি খুঁজলেই পাওয়া যাবে আমাদের না পাওয়া ইতিহাসের খড়কুটোগুলো। হয়তো রাজা ছিল, জমিদার ছিল, নবাব সুলতান ছিল, ছিল বৃটিশ গভর্নর ডেপুটিরা। কিন্তু বাঙালীর কি ছিল? রাজদন্ডের অধিকারে বাঙালী কখনোই মুক্তমনে বিচরন করেনি। ঊনবিংশে শিল্প সাহিত্যে বাঙালীর বিকাশ ঘটেছিল বটে তবে তা ছিল একপেশে অসম্পুর্ন। বৃটিশ শাসনের devide and rule এর খেসারতে বাঙালীর ঘরে একচক্ষু দৈত্য হয়ে প্রকৃত বাঙালী(!) হয়ে বেড়ে উঠা একটি সম্প্রদায়ের অতিমর্দনে শাসক গোষ্ঠীর দিব্য চক্ষু খুলে যায়। সেক্ষেত্রে দেশ শাসনের কর্তা হিসাবে কিছুটা করনীয় তো থেকেই যায়। ফলে বাংলার সামগ্রিকতার সুষমতা আনয়নে ও পুর্ব বাংলার ভাগ্যান্নয়নে বৃটিশরা বাংলা ভাগ করে দেয়। আবারও সেই মা ও মাসীর গল্পটা সামনে চলে আসে। শাসকের আশেপাশে বিচরন করা ক্ষুদ্র রাজন্য গোষ্ঠী ও জমিদারীয় সম্প্রদায় তাদের চেলা চামুন্ডা নিয়ে কলকাতার রাজপথ, "আমরা বাঙালী ভাই ভাই" এর শ্লোগানে মুখরিত করে তোলে। বাঙলা ও বাঙালীর অখন্ডতা রক্ষার মায়াকান্নায় তাদের চোখের জলে কোলকাতার রাজপথে প্লাবন দেখা যায়। এ কান্না যে কোলকাতায় থিতু হওয়া পুর্ব বঙ্গীয় ব্রাহ্মন্য উঁচুতলার বনেদীদের তা হয়তো বৃটিশরা টেরও পেয়ে যায়। নতুন কোন অনাচার যাতে মাথাচাড়া না দেয় এই আশংকায় বৃটিশরা বাঙালী বাবুদের এই ছদ্মবেশী মায়াকান্নায় সাড়া দিয়ে আবার বাংলাকে এক করে দেন মাত্র ছ'বছরের মাথায়। এরকম ঘটনা ঘটেছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা শুরুর সময়টাতেও। বাংলাকে এক করার মায়া কান্নায় তারাই চোখ ভাসিয়েছিলেন, যারা সাতচল্লিশে এসে শুধুমাত্র আপতকালীন ক্ষমতার লালসায় কোলকাতার জৌলুষতাকে মানদন্ডে নিয়ে এবং ধর্মকে সামনে এনে বাংলাকে দু'টুকরো করেছিলেন। ১৯০৫ এর চিন্তায় তারা তাদের পুর্ব বাংলার জমিদারী ও রাজ রক্ষার স্বপ্ন দেখেছিলেন। আর ১৯৪৭ এ এসে তারা একটি ভগ্নাংশের শাসন কর্তা হতে চেয়ে বাংলাকে দু'টুকরো করতেও দ্বিধান্বিত হননি। সব ক্ষেত্রেই মূল বিষয় ছিল উঁচুতলার হিন্দু নামধারী একটি বনেদী গোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষার ব্যাপার। স্বার্থ একটাই,, তা হোল ধর্মের নামে সাম্প্রদায়িক ক্যাইজা ফ্যাসাদ সৃষ্টি করে নীচুতলার বর্ন গোত্রের হিন্দুদের মাঠে নামিয়ে ফায়দা তোলা। এটা আমার কথা নয়। নয় কোন সাম্প্রদায়িক খোঁচা মারা বচন। বর্তমানের কোলকাতা কেন্দ্রিক মিডিয়া ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের পাতাগুলো উল্টালেই এর যথার্থতা খুঁজে পাওয়া যায়। যারা ধর্ম কর্মের অজুহাত তুলে পঁচাত্তর বছর আগে বাংলা ভাগের সারথি হয়েছিলেন আজকে একবিংশে এসে তাদেরই উত্তর পুরুষেরা এখন নিজ ধর্মের সাম্প্রদায়িক বিষাক্ত আচরনে ত্যক্ত বিরক্ত। তাদের বর্তমানের ধর্মীয় অশান্তির অসহ্য যন্ত্রনার ছটপটানি দেখলে জাতি ধর্ম নির্বিশেষের বাঙালীকে বিমর্ষ হতে হয় বৈকি!
বাঙালী জ্ঞান গরিমা ও শক্তিমত্তায় কোনদিনই পিছিয়ে ছিল না। কিন্তু সেই বাঙালী ধর্ম ভিত্তিক বিভক্তির অবয়বে কিছুটা হলেও দুর্বল হয়েছিল। তাদের মূল দুর্বলতা ছিল নেতৃত্ত্বের অসম্পুর্নতা। সেটা হয়তো উৎরে যেত কিন্তু সর্ব ভারতীয় নেতৃত্ত্বে আসা সেই বাঙালী মহাপুরুষ যখন গুজরাঠী মারাঠীদের পাশার চালে ভারত আন্দোলনের দর কষাকষির ফ্রন্ট লাইন থেকে ছিটকে গেলেন, তখন বাঙালীর রাজশক্তি হওয়ার স্বপ্ন ধর্ম ভিত্তিক সাম্প্রদায়িক চোরাগলিতে আঁটকে গেল। তাছাড়া গ্রেটার বাংলার সামগ্রিকতায় তৎসময়ে মুসলিম নেতৃত্ত্বের ভার বেশী থাকায় আবারও সেই ব্রাহ্মন্য কুটকৌশলের ধর্মীয় কোঠারীর প্রসঙ্গটা প্রাধান্য পায়। ফলে সেই ভাঙ্গনের নিয়তি নিয়েই বাংলার পথচলা শুরু হয়। বাঙালীর একভাগ গেল ব্রাহ্মন্য সর্ব ভারতীয়ের দিল্লির উঠানে আর অন্যরা উর্দুভাষী রাওয়ালপিন্ডির বগলদাবা হলো। এভাবেই বাঙালী সাম্প্রদায়িক যাঁতাকলে দু'ভাগ হলো। ভাইয়ে ভাইয়ে ভিনু হয়ে বাঙালী দুই শক্তিশালী রাষ্ট্র কাঠামোর ছায়াতলে দুই নামে আত্মপ্রকাশ করলো। বাঙালী নামের অস্তিত্বে যদিওবা একটু আধটু অবশিষ্ট ছিল, এবার তাও মুছে গেল। একদল ভারতীয় নামে পরিচিতি পেল আর অন্যরা পাকিস্তানী জাতীয়তায় আত্মপ্রকাশ করলো। আত্ম পরিচয়ের বিড়ম্বনায় বাঙালী এভাবেই বার বার করে বঞ্চিত হয়েছে।
আগেই বলেছি বাঙালীর জ্ঞান গরিমা ও শক্তিমত্তার কথা। কিন্তু যেটার অভাবে বাঙালী বার বার গতিপথ হারিয়েছে তা হলো তার নেতৃত্ব। সঠিক ও সময়োপোগী নেতৃত্বের শুন্যতায় বাঙালী বার বার হোঁচট খেয়েছে। বিংশ শতাব্দীর প্রথমভাগে নেতৃত্বের স্ফুরন ঘটেছিল বটে তবে ততদিনে বঙ্কিমীয় বন্দে মাতরমের ধর্মীয় মাতমে বাঙালীর অস্তিত্বে ফাটল ধরা শুরু করে। তাছাড়া বাংলাকে নিজের অস্তিত্বে না ভেবে তৎসময়ের একটি সম্প্রদায়ের মেধাবীরা অযেভাবে ভারতীয় হওয়ার রেসে সামিল হয়েছিলেন সেক্ষেত্রে বৃহৎ সম্প্রদায়ের বাঙালী সেসময় সত্যিই প্রমাদ গুনেছিলেন। যদিও আপোষ কামিতার মানসিকতায় তারা গ্রেটার বাংলার জন্য অনেকদূর হেঁটেছিলেন। তবে সময়টা তখন অনুকুলে ছিলনা। একদিকে সাম্প্রদায়িক ঝগড়াঝাঁটি অপরদিকে বৃহৎ ভারতের নেতৃত্বে আসার এক সোনার হরিন তখন একটি সম্প্রদায়ের বাঙালীকে বুঁদ করে রেখেছিল। সে সময়ে সর্বভারতীয় আঙ্গিকে ধর্মীয় কারিশমায় স্বামী বিবেকানন্দের জয়জয়কার, শিল্পকলা সংস্কৃতি ও সাহিত্যে বাঙালী আধিপত্য, ভারতীয় রাজনীতির ক্ষেত্রেও কংগ্রেসে বাঙালীদের ফ্রন্ট লাইনে থাকা ইত্যাদি বিষয়গুলো তৎসময়ের বাঙালী বাবুদের ভারতীয় হওয়ার তারাজে উঠিয়েছিল বলে মনে হয়। ফলে অস্তিত্ব বিড়ম্বনায় বাঙালীর ডিগবাজি ঘটলো।
অবশেষে নেতৃত্বের স্ফুরন ঘটলো। পলি বিধৌত কাদামাটির কোটালী পাড়ার ছেলে মুজিব, বাঙালীর কান্ডারী হয়ে আমাদের প্রিয় বঙ্গবন্ধু হলেন। তবে তা শুধু টুকরো হওয়া বাংলার পুর্বাংশের জন্য। পুর্ব পাকিস্তানের বাঙালী তাদের নিজ পরিচয়ে বাংলাদেশী হোল। কিছুটা হলেও অস্তিত্ব বিড়ম্বনার হাত থেকে বাঙ্গালী মুক্ত হোল। ওদিকে ধর্মীয় তাওয়ায় স্যাঁকা রুটি হয়ে টিকে থাকা পশ্চিমের বাঙালীরা ভারতীয় তকমা গলায় ঝুলিয়ে আপন অস্তিত্বের প্রমাদ গুনছে। আপন অস্তিত্বের বাংলাদেশ দাঁড়িয়ে থাকলেও তার চলার পথে মাঝেমধ্যেই অস্তিত্ব সংকটের সৃষ্টি হয়েছে। ভূরাজনীতির ছোবল এবং অভ্যন্তরীন রাজনীতির তঞ্চকতায় বাঙালী এখনও কিছুটা সংকটে রয়েছে বলে মনে হয়। নইলে রাজনীতি সমাজনীতি ও রাষ্ট্রনীতির সর্বস্থলে যেখানে বাঙালীর শতভাগ উপস্থিতির গ্যারান্টি রয়েছে, সেখানে কেন আজ স্বপক্ষ বিপক্ষের কাইজ্যা ফ্যাসাদ বাঙালীকে উড়ন চন্ডি করছে! কেন আজ চেতনা ও চেতনা বিরোধী শব্দ নিয়ে রাজনীতি কলুষিত হতে চায়? স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পেরিয়ে গেলেও বাঙালী কেন এখনো একই শ্লোগানে উচ্চকিত হয়ে বাংলার মর্যাদায় একাট্টা হতে পারছেনা! রাজনীতির বিড়ম্বনার সাথে 'বাংলাদেশ ও বাংলাদেশী'র অস্তিত্বকে গুলিয়ে ফেলাটা অর্বাচীনের কাজ নয় কি? সেক্ষেত্রে চলার বিড়ম্বনা, সমাজ গঠনের বিড়ম্বনা এবং রাষ্ট্র পরিচালনার বিড়ম্বনায় কিছুটা হলেও তো চাপ থেকে যায়। বাঙালী তার আপন বিচক্ষতায় নিজের অস্তিত্ব বিড়ম্বনার গলিপথ মেরামতে একাট্টা হবে এই আশাই ব্যক্ত করছি।