জালাল উদ্দিন আহমেদ
ভাবনাটা একান্ত
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ২১ ডিসেম্বর, বুধবার,২০২২ | আপডেট: ০৬:৪১ এএম, ১৯ ডিসেম্বর,বৃহস্পতিবার,২০২৪
প্রফেসর ডঃ মোহাম্মদ ফজলুল করিম ( ১৯৫৭ -২০২২)
মানুষের জীবন একটি নির্দিষ্ট সময়ের গন্ডিতে আবদ্ধ। সেই গন্ডির সীমানাতেই সীমাবদ্ধ তার জীবনচক্র। তবে সৃষ্টির বহুমুখীতায় স্রষ্টা কিছু কিছু ক্ষেত্রে তার সৃষ্টিকুলের মধ্যে ব্যতিক্রমী স্ফুরন ছড়িয়ে দেন যার আলোক ছটায় এই সুন্দর পৃথিবী আরো সুন্দর হয়ে বিকশিত হয়। এভাবেই মহান স্রষ্টা তার সৃষ্টির মধ্য দিয়েই এই ধরনীকে মানব জাতির সামঞ্জস্যপুর্ন এক বাসযোগ্য পৃথিবী হিসাবে আমাদের উপহার দিয়েছেন। পেশাজীবি মানুষ হিসাবে নিজের শিক্ষা ও শিল্প সেক্টর নিয়েই ভেবেছি। এখনো ভাবি। যতটুকু বিদ্যাবুদ্ধি আছে তা উজাড় করে দেয়ার চেষ্টা করি। কিন্তু ব্যাটে বলে ঠিকমত সংযোগ হয়না বলেই হয়তো ছক্কা হাঁকাতে পারি না। আর এখনকার ছক্কা হাঁকানো মানে তো সেই নামডাক গাড়ি বাড়ি শান শাওকাত ইত্যাদি ইত্যাদি। তবে ওটা সিকেই তুলে রেখেই আমার জীবন পথের নির্ঘন্টে আমি তৃপ্ত। নিভৃতে নীরবে আপন ভুবনে বেশ ভাল আছি। আলহামদুলিল্লাহ!
জীবনটা খুব সীমিত সময়ের জন্য বাঁধা। যখন ছোট ছিলাম তখন খেয়াল করেছি, পঁয়তাল্লিশ পঞ্চাশের পর আর কর্ম চাঞ্চল্য থাকেনা। মানুষ তখন পরকালের আশায় টুপি তসবিহ্ নিয়ে ঘর মসজিদ করা শুরু করে। পাশাপাশি সত্তোর্ধ কিংবা অশীতিপর তখনও ছিল। তবে তা অন্য ধাঁচে। পাড়ার মুরব্বী বা এলাকার মুরুব্বী হিসাবে তখন সেই ব্যক্তি সবার গুরুজন বা নমস্য হয়ে থাকতেন। সময় পাল্টেছে। এখন সত্তর আশি বছর বয়সেও কর্মক্ষম মানুষের আনাগোনা অহরহ। দিব্যি খাচ্ছেন ঘুরছেন। বাজার করছেন। আড্ডাও মারছেন। আসলে আমাদের বয়সের আয়ুষ্কাল বেড়েছে। তবে রবি ঠাকুরের ভাষায় "মরিতে চাহিনা আমি সুন্দর ভুবনে" বলে যতই প্রলাপ বকি না কেন, মাইকেলের উক্তিতে "জন্মিলে মরিতে হবে অমরকে কোথা পাবে" এই অমৃত পান করেই আমাদেরকে বিদায় নিতে হবে। আর পবিত্র গ্রন্থের সেই মহাকাব্যিক বিধান "কুল্লুমান আলাইহা ফানিও ওয়া ইয়াবক্বা ওয়াজহু রাব্বিকা যুলজ্বালালি ওয়াল ইকরাম" এর বাধ্যবাধকতায় গেঁথে রাখা আমাদের জীবনচক্র তো তার নিজস্ব গতিপথেই প্রবাহমান। এটাই বিধির বিধান। মহান সৃষ্টকর্তা এভাবেই আমাদেরকে জীবন নামের এই ঘুর্ণাবর্তে আঁটকে দিয়েছেন।
দায় নিয়ে নয়, দায় থাকার কথাও নয়। ক্ষেত্রভূমি আলাদা, বিচরন ক্ষেত্রও আলাদা। তারপরেও কেন যেন মনটা খছখচ করছে। কিছু করতে হয়তো পারবনা। তবে কিছু তো বলা দরকার।
একজন ফজলুল করিম। প্রফেসর ডঃ মোহাম্মদ ফজলুল করিম। স্নেহাস্পদ অনুজও বটে। তবে নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে থেকেও বন্ধু ভাবাপন্ন হয়েই আমাদের অবস্থান বিদ্যমান ছিল। ছাত্র জীবনের শেষ বর্ষে এসে তাকে নবীন হিসাবে বরন করে দেখেছিলাম তার তেজদীপ্ত আচরনের স্ফুরন। কেন যেন তার প্রতি আলাদা একটা আকর্ষন আমার জন্মেছিল। হয়তোবা ভাল ছাত্র ছিল বলেই এমনটা ঘটেছিল। লক্ষ্য করেছি, ক্যাম্পাস ছেড়ে কর্মক্ষেত্রে প্রবেশের পরও সে আমার সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছিল। পরে যখন কর্মক্ষেত্র এক হলো অর্থাৎ নিজ বিদ্যাপীঠে শিক্ষক হিসাবে ফিরে এলাম তখন সে কমনওয়েলথ স্কলারশীপের বৃত্তি নিয়ে লীডস বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার প্রস্তুতিতে ব্যস্ত। মনে পড়ে লন্ডন পাড়ি দেয়ার আগের রাতে আমার বাসায় হঠাৎ তার আবির্ভাব। ভাবীকে সালাম করতে এসেছে। যেন কত আপনজন। বাচ্চারা ঘুমিয়েছিল। ওদেরকে ঘুম থেকে উঠিয়ে ছবি তুলে নিল। আমাদেরও ছবি তুললো। পরে লন্ডন থেকে ছবিগুলো পাঠিয়েছিল বলেও মনে পড়ে। সেই থেকে আমার মেয়ে দুটো ওকে লন্ডন চাচ্চু বলেই ডাকতো। সেই করিম, প্রিয় ফজলুল করিম গত ২৭ নভেম্বর আমাদের ছেড়ে না-ফেরার দেশে চলে গেল। ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহির রাজিউন! একটি অধ্যায়ের সমাপ্তি হোল।
বাংলাদেশের চামড়া শিল্প ও শিক্ষার অগ্রগতি নিয়ে উচ্চারন করতে গেলে যেসব নাম উচ্চারনে আসে তার অগ্রভাগেই থাকবে ডঃ মোহাম্মদ ফজলুল করিমের নাম। ক্ষনজন্মা এই মানুষটি তার অসাধারন মেধা দিয়ে প্রশাসনিক ও একাডেমিক দুটি বিষয়েই দক্ষতার সহিত সামাল দিয়েছেন। আমাদের শ্রদ্ধেয় শিক্ষক এবং বাংলাদেশ কলেজ অব লেদার টেকনোলজির প্রথম অধ্যক্ষ ডঃ করম আলি আহমেদের হাত ধরে চামড়া খাতের শিক্ষা ব্যবস্থা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে। আর তারই সুযোগ্য ছাত্র এবং পরবর্তীতে কলেজ অব লেদার টেকনোলজির অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডঃ ফজলুল করিমের মাধ্যমে সে কলেজ আজ ফুলে ফলে পল্লবিত হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত রসায়ন ও ইঞ্জিনিয়ারিং ফ্যাকাল্টির একটি পুর্নাঙ্গ ইনস্টিটিউশনে দাঁড়িয়ে গেছে। এই দাঁড়িয়ে যাওয়ার ঘটনাপুঞ্জ বড়ই জটিল ও ঝড় ঝঞ্জাময় ছিল। তবে ফজলুল করিমের প্রজ্ঞা ও লীডারশীপের প্রশংসা না করার উপায় নেই। চারিদিকে বিরোধ, শুধুই না-সূচক কথাবার্তা আর সমালোচনার ঝড়। এমনকি আপন বিদ্যাশিক্ষার সহপাঠী ও সিনিয়র জুনিয়র সর্বক্ষেত্রের একটা প্রবল নেগেটিভিটি তার ইচ্ছা পুরনের জিদকে বোধ হয় আরো শক্তিশালী করেছিল।
ছিয়াশির শেষের দিকে বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়নে লেদার কলেজ থেকে উচ্চতর প্রশিক্ষনের জন্য ইউরোপের কয়েকটি দেশে যেতে হয়েছিল আমাকে। ওটা প্যাকেজ প্রোগ্রাম ছিল। ইংল্যান্ডের নর্দাম্পটনেও যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সময় স্বল্পতা ও বড়দিনের ছুটি সংক্রান্ত জটিলতায় সেখানে যাওয়া হয়নি। করিম সেটা জানতো। ইনটিউশনে মিলেনি বলে তার সঙ্গে দেখা হয়নি। সাতাশিতে ঢাকা ফিরে এসে কাজে লেগে পড়লাম। তখন চেন্নাইয়ের আন্না বিশ্ববিদ্যালয়ের ডঃ এম এস অলিভান্নান ট্রেনিং এক্সপার্ট হিসাবে লেদার কলেজে এসেছেন। একাডেমিক সাইডে ঝোঁক এবং টেনারী মালিকদের সঙ্গে সুসম্পর্ক ছিল বিধায় ডঃ করম আলি স্যার আমাকে ডঃ অলিভান্নানের কাজের সাথে ট্যাগ করে দিলেন। ফলে বিদেশ থেকে ফিরেই সেসব দেশে অর্জিত অভিজ্ঞতার আলোকে টেনারীতে কর্মরত টেকনিশিয়ান ও টেকনোলজিষ্টদের জন্য মডার্ন ট্রেনিং আয়োজনের সমস্ত দায়িত্ব আমার ঘাড়ে পড়লো। তবে বেশীদিন থাকতে পারিনি কলেজে। উচ্চতর পদ নিয়ে নির্বাহী প্রকৌশলীর পদমর্যাদায় বিষয় বিশেষজ্ঞ হিসাবে শিল্প মন্ত্রনালয়ের অধীনস্ত বিসিকে যোগদান করলাম।
নব্বইয়ের প্রথম দিকের কথা। একদিন হঠাৎ ফজলুল করিম আমার অফিসে হাজির। স্বভাবতই আমি উৎফুল্ল ও উচ্ছসিত হলাম। কবে দেশে ফেরা হোল, কলেজে যোগদান ইত্যাদি কুশল বিনিময় হওয়ার পর তাকে একটু বিমর্ষ মনে হল। তার হাতে একটা খাম ছিল। সেটা সে আমাকে দেখতে বলে একটু আনমনা হয়ে গেল। তার পদোন্নতির চিঠি। লেকচারার থেকে এসিস্ট্যান্ট প্রফেসর হিসাবে পদোন্নতির পত্র পেয়েই সরাসরি শিক্ষা মন্ত্রনালয় থেকে আমার কাছে চলে এসেছে। মনে পড়ে ঐদিন তাকে দুপুরের লাঞ্চ করিয়ে বিদায় দিয়েছিলাম। মুখরোচক ও রীচ ফুড খেতে সে খুব পছন্দ করতো। তার পছন্দের নান্না মিয়ার বিরিয়ানি আনিয়েছিলাম। ইতোমধ্যে করম আলি স্যার অবসর নিয়েছেন। ডঃ আজিজুর রহমানও অবসরে গেছেন। কলেজে প্রিন্সিপ্যাল হওয়ার জন্য সবাই দৌড়ঝাপ করছে। লেদার সেক্টর তখনও এত শক্তিশালী হয়নি যে ইচ্ছে করলেই একজন প্রফেসর বা এসোসিয়েট প্রফেসরকে লেদার কলেজে প্রিন্সিপ্যালের দায়িত্ব দেয়া যাবে। সবেধন নীলমনি সদ্য বিলেত ফেরত এবং কেবলমাত্র এসিস্ট্যান্ট প্রফেসর হওয়া ডঃফজলুল করিমই তখন ভরসা। কিন্তু অভ্যন্তরীন কলহ এবং আন্ডার কোয়ালিফায়েড জনবল থাকায় সেখানে অধ্যক্ষের দায়িত্বে কাউকে দেয়া যাচ্ছিল না। চামড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তরের অধীনে থাকায় জটিলতা আরো প্রকট আকার ধারন করে। কারন সেখানে এমনিতেই তখন পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট গুলো শিক্ষক সমস্যায় জর্জরিত ছিল। এভাবেই হজবরল অবস্থায় কয়েকটি বছর পেরিয়ে যায়। ইতিমধ্যে করিম তার যোগ্যতার বরাতে সময়কে কাজে লাগিয়ে পদোন্নতির পরবর্তী সিঁড়িতে পা রাখে। মনে পড়ে কলেজে টিচিং স্টাফদের কলহ ও দ্বন্দের জেরে বছর জুড়ে কলেজ ক্যাপাসে যেতে না পেরে সে কারিগরি শিক্ষা দপ্তরে অফিস করেছে। ফলে কারিগরি শিক্ষা ভবনে হাজিরা দিয়েই মাঝেমধ্যে সে আমার অফিসে চলে আসতো। আমার অফিসের কাছে যুব ভবনের(ওটা তখন জাতীয় পার্টির হেড অফিস) পিছনে একটা ভাল সিঙ্গাড়া ও পুরির দোকান ছিল। সে ওই সিঙ্গাড়া খুব পছন্দ করতো। অফিস রুমে ঢুকেই তার সেই প্রিয় ডাক, জালাল ভাই সিঙ্গাড়া খাব। মাঝেমধ্যে রুমে ঢোকার আগেই হাসিনাকে(আমার অফিস পিয়ন) সিঙ্গাড়ার অর্ডার দিয়েই রুমে ঢুকতো। তারপরে তো ইতিহাস। অধ্যক্ষের দায়িত্ব নিয়েই কলেজকে কিভাবে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে আনা যায় এই নিয়েই চিন্তা।
আগেই বলেছি ফজলুল করিম অত্যন্ত মেধাবী এবং ধীশক্তির অধিকারী ছিল। পরিবর্তিত সরকার ব্যবস্থার কোন এক যোগসূত্রে সে তার চলার কাঙ্ক্ষিত গলিপথ খুঁজে পেল। তার খুব ইচ্ছে এবং জেদ, শুধু লেদার টেকনোলজি কেন! ফুটওয়্যার ও প্রডাক্ট টেকনোলজির উপর বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রি চালু করতে হবে। দেরী না করে সে কাজে লেগে পড়লো। যথারীতি সরকারী বিধিবিধানের শত বাধা ও বেড়াজাল অতিক্রম করে লেদার কলেজ সরকারী উন্নয়ন প্রকল্পের খাতে নাম লিখালো। অভ্যন্তরীন গোলযোগ কলেজে লেগেই ছিল। শত বাধা ও ভ্রুকুটি উপেক্ষা করে ডঃ করিম সামনের দিকে এগিয়ে চললো। সে সময়টাও অনুকুলে ছিল না। দেশব্যাপী সন্ত্রাসী মস্তানী আর দাদাগিরির একটা প্রচ্ছন্ন বাতাবরনে চারিদিক আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিল। ফলে টেন্ডারবাজি থেকে শুরু করে সামাজিক ও দাপ্তরিক সর্ব অঙ্গনে একটা উটকো মস্তানী ইত্যাদির প্রাদুর্ভাব সমাজ জীবনকে বিষিয়ে তুলেছিল। তারপরেও করিম লেদার কলেজের উন্নয়নের অগ্রযাত্রার সারথি হয়ে এগিয়ে গেছে অকুতোভয়ে।
সম্ভবতঃ আঠানব্বই-নিরানব্বইয়ের দিকে একটা ফোন এল আমার কাছে। তার সেই পুরনো টোনের আওয়াজ 'জালাল ভাই শনিবার ছুটির দিনে একটু আসেন, চায়ের দাওয়াত'। কলেজের প্রকল্প সারসংক্ষেপ শুনিয়ে যেটা বলেছিল তাতে চিন্তিত না হয়ে পারি নি। তাছাড়া তার কর্মী বাহিনী বলতে তারই ছাত্র হিসাবে পাশ করে সদ্য কলেজে লেকচারার হিসাবে যোগ দেয়া গোটা চারেক তরুন সহকর্মী। যেহেতু এর আগে বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়নে লেদার কলেজের সিএফএফসি(common finishing facility centre) প্রকল্পে আমার কাজের অভিজ্ঞতা রয়েছে, ফলে প্রকল্প বাস্তবায়নে আমার সহযোগিতা চাইলো। তাছাড়া কলেজ উন্নয়নের একাডেমিক ও কারিগরি বিভিন্ন বিষয়ে আমাকে জড়াতে চাইলো। আমি তাকে বলেছিলাম, যা কিছু হবে সরকারী নিয়মে হবে। প্রয়োজনে শিল্প সচিব ও বিসিক চেয়ারম্যানের সাথে কথা বলে তুমি এগোতে পার। কেননা বিধি বিধানের ব্যতয় ঘটিয়ে আমি এখানে সময় দিতে পারবো না। পরে করিম সে কাজটি নিয়ম মোতাবেক করেছিল এবং আমাকে তার উন্নয়ন প্রকল্পের টেকনিক্যাল কমিটির মেম্বারসহ অন্যান্য কারিগরি ও প্রয়োজনীয় পেরিফেরিতে অন্তর্ভুক্ত করে স্বস্তি পেয়েছিল বলে মনে হয়। কারন আমার 'ধার' এর থেকে 'ভার'টাকেই সে কাজে লাগাতে পেরেছিল বলে মনে হয়। তাছাড়া লেদার কলেজের বাংলাদেশ প্রেক্ষিতের প্রথম ব্যাচের সেরা ছাত্র হিসাবে এবং সরকারী কর্মক্ষেত্রের বিভিন্ন দপ্তর ও অধিদপ্তরে আমার কাজের সুনামের জন্যও করিম একটা স্বাচ্ছন্দের জায়গা সৃষ্টি করতে পেরেছিল বলে আমার মনে হয়েছে। প্রচন্ড বৈরী পরিবেশে, শুধুমাত্র সেক্টরের প্রতি অগাধ ভালবাসা ছিল বলেই সে তার উন্নয়ন প্রকল্পের কাজগুলি এভাবেই এগিয়ে নিয়েছিল। পরবর্তীতে আমাদের সিনিয়র অর্থাৎ পাকিস্তান আমলের শেষ ব্যাচের ছাত্র বাসেদ ভাই ও আমার ব্যাচের স্থানীয় প্রভাবশালী দুই সহপাঠীকেও কলেজ উন্নয়নের বাস্তবতা আমি বুঝিয়েছিলাম এবং তাদের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় স্থানীয় মস্তানী ও গোলযোগের অনেকটাই স্তিমিত করা হয়েছিল। পরবর্তীতে একাডেমিক বিষয়েও করিম আমাকে কাজে লাগিয়েছিল। Examiner, Question setter, এমনকি Syllebus কমিটির মেম্বার হিসাবে আমাকে কাজ করতে হয়েছে।
লক্ষ্য করেছি তার এই কাজগুলো ত্বরান্বিত করার জন্য সে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি থেকে শুরু করে কাজ সংশ্লিষ্ট সম্ভাব্য বড় বড় প্রফেসরদের সাথে মিটিং ও আলোচনায় আমাকে জড়িয়ে রাখতো। তার এই লীডারশীপ ও সেকটরের উন্নয়নের চিন্তা চেতনার একাগ্রতায় মাঝেমধ্যে আমি অবাক হয়ে যেতাম। তাছাড়া ছাত্রদের প্রতি তার অগাধ বিশ্বাস এবং ভালবাসা তাকে স্মরনীয় করে রাখবে বলে আমার বিশ্বাস। ছাত্রদের কর্মসংস্থান ইত্যাদি নিয়ে সে সব সময় ভেবেছে। সরকারী ক্ষেত্রে তাদের কর্ম সংস্থান ও শিল্প সেক্টরে তাদের প্রয়োজনীয়তার আবশ্যকতা নিয়ে মালিক পক্ষ এবং সরকারী অধিদপ্তর,ব্যাংক বীমার সঙ্গেও তাকে কথা বলতে দেখেছি। এমনকি লেদার টেকনোলজিষ্টদের যোগ্যতার প্রতি বিশ্বাস ও প্রয়োজনীয়তার কথা অনুভব করানোর লক্ষ্যে ডঃ করিম শিল্প মালিক পক্ষের লোকজনকেও তার প্রকল্প কর্মধারায় সম্মানিত মেম্বার হিসাবে কাজে জড়িয়েছিল। কত সূদুর প্রসারী চিন্তাধারা থাকলে একজন শিক্ষাবিদ এধরনের কাজে বোল্ড হতে পারেন তা কি আমরা ভেবেছি! ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রহনযোগ্যতা ও আনুকুল্য পাওয়ার জন্য সে যখন তার একাডেমিক ফেরিফেরি ও সিলেবাস কমিটিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাঘা বাঘা দেশবরেন্য সাইনটিষ্ট ও শিক্ষাবিদকে জড়িয়ে সেসব কাজগুলি করিয়েছিল তখনই আমার মনে আর কোন সন্দেহ থাকেনি যে একসময় এই লেদার কলেজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি সেরা ইনস্টিটিউটে রূপান্তরিত হবে। তবে তার অপূর্ন স্বপ্নটি পুরন হয়নি। লেদার কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নীত করার সুপ্ত বাসনায় সে নীরবে কাজ করে গেছে। সে কর্মযজ্ঞে আমিও জড়িত ছিলাম। চারটি ডিভিশনে চারটি লেদার কলেজের প্রকল্প প্রস্তাব তৈরীর কাজও সম্পন্ন করা হয়েছিল। সম্ভবতঃ তা মন্ত্রনালয়ের অনুমোদনের টেবিল পর্যন্ত গিয়েছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্য! সময় ও স্রোত অনুকুলে ছিলনা বলেই হয়তো কলেজ থেকে তাকে অসময়ে বিদায় নিতে হয়েছিল। একটা মানসিক যন্ত্রনা নিয়েই সে নিভৃতচারী হয়ে গেল। বছর কয়েক সেখানে থেকে ছেলে মেয়ে দুটোকে কানাডার কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনায় থিতু করিয়ে সে আবার দেশে ফিরেছিল। ঢাকায় ফিরে সে বড় নিরিবিলি জীবন যাপন করেছে। অবসরের দিনগুলিতে তাকে স্বতঃস্ফুর্ত দেখতে চেয়েছিলাম। মনে পড়ে টেনারী সেক্টরের স্থানান্তর প্রক্রিয়ার ডামাডোলে শিল্প সেক্টর থেকে আমাকে আহ্বায়ক করে যখন একটি টেকনিক্যাল কমিটি গঠন করা হয়েছিল তখন মালিক পক্ষকে ডঃ করিমের এই কমিটিতে রাখার প্রয়োজনীয়তার কথা স্মরন করিয়ে দিয়েছিলাম। সেক্ষেত্রে ঢাকায় ডঃ করিমের অবস্থান সমন্ধে তাদের ধারনা ছিল না বলে বিটিএ (বাংলাদেশ টেনার্স এসোসিয়েশন) এর সম্মানিত চেয়ারম্যান আমাকে জানিয়েছেন। আবার টিভিতে প্রচারিত শিল্প সংক্রান্ত দু'একটি টকশোতেও তাকে নিয়েছি বলে মনে পড়ে। ডাইবেটিক সক্রান্ত জটিলতায় রোগে শোকে সে বেশ কাহিল হয়ে পড়েছিল বলেই তাকে মানসিকভাবে চাঙ্গা রাখার জন্য এসব উদ্যোগ নিয়েছিলাম।
ডঃ ফজলুল করিম বাংলাদেশের চামড়া শিল্প ও শিক্ষা জগতে এক ধুমকেতু। যতদিন এই ভূখন্ডে চামড়া শিক্ষা ও শিল্প সেক্টর থাকবে ততদিন এবং অনাদিকাল পর্যন্ত প্রফেসর ডঃ ফজলুল করিমের নাম উজ্জ্বল ধ্রুব তারার মত জ্বল জ্বল করবে। আমি তার বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি। আ'মীন!