জালাল উদ্দিন আহমেদ
বাঙালীর অর্জন
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ৯ অক্টোবর,রবিবার,২০২২ | আপডেট: ০৭:০২ এএম, ২১ ডিসেম্বর,শনিবার,২০২৪
(১)
নিজেকে দিয়েই শুরু করি। সেই যুক্তফ্রন্ট আমলের ১৯৫৪ সালের সময়কালে বাংলা ভূখন্ডে আমার জন্ম হয়েছিল। ততদিনে অবশ্য বাংলা খন্ডিত অবয়বে পুর্ব পশ্চিমে দাঁড়িয়ে গেছে। বাংলার পশ্চিমাংশ ভারতীয় সিদ্ধতা পেয়ে পশ্চিমবঙ্গ নাম নিয়ে ভারতবর্ষের অঙ্গীভূত রাজ্যের স্বীকৃতি পেয়ে গেছে। পুর্বাংশ তখনও বাঙালীর ছিটেফোঁটা নিয়ে পুর্ব বাংলা হিসেবে টিমটিম করছে। যদিও তা বছর দুয়েক পর পাকিস্তান রাষ্ট্রের সীল নিয়ে প্রশাসনিক উপায়ে পাকাপোক্ত ভাবে পুর্ব পাকিস্তানে নাম লিখিয়েছে। হিসেব কষে দেখা যায় বাঙলা ও বাঙালীর বন্ধ্যাত্বের বয়স মাত্র পনের বছর। কারন কেবলমাত্র ঐ পনেরটি বছর কাগজ কলমে বা সাংবিধানিকভাবে পুবের বাঙালী পাকিস্তানী পরিচয়ে স্বতঃসিদ্ধ ছিল। ১৯৭১ সালে গনেশ উল্টে গেল। পুর্ব বাংলা বা তথাকথিত পুর্ব পাকিস্তানের বাঙালী আপন অস্মিতার ঝাঁঝ ছড়িয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ সৃষ্টি করলো। কাগজ কলমও নতুন আঙ্গিকে বাঙালীর বাংলাকে সাজিয়ে নিল। মুক্ত বাংলার মুক্ত বাঙালী আপন ঘাটে নৌকা নোঙ্গর করলো। বাঙালী মাঠে নেমে পড়লো সোনাফলা বাংলায় খদ্যশস্য উৎপাদনের মহোৎসবে। দেশের অর্থনীতি মেরামতে শিল্প বানিজ্যে বিনিয়োগের ধুম পড়ে গেল। শিক্ষা স্বাস্থ্য ও অন্যান্য খাতগুলিকে বাঙালীয়ানার হালখাতায় সাজাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো সবাই। আর রবীন্দ্র কথিত,"বাঙালীর একমাত্র প্যাশন রাজনীতি", সেটারও পোষ্ট মর্টেমে মনযোগী হোল বাঙালী।
যদিও বলা হয়ে থাকে বাঙালীর বাঙালীয়ানার ফুল ফুটেছে বিংশ শতাব্দীতে। তারপরেও তো আমরা বাঙালীর হাজার বছর নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি ক'রে আপন অস্তিত্বের খোঁজে হন্যে হয়ে ফিরি। বাঙালীর হাজার বছরের উঠান তৈরীতে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ি। তবে যতই যা বলি না কেন, আসলে বাঙলা নামক ভূখন্ডের অস্তিত্বের শেকড় অঙ্কুরিত হয় এতদাঞ্চলে মুসলিম আগমনের পর থেকে। এর আগে যা কিছু বাংলার মাটিতে ঘটেছে সেগুলো শুধুই আর্য অনার্য শাসন শোষনের কাহিনী চিত্র। বাঙালীয়ানার উঠান তৈরীর কোন চিত্র সেখানে পাওয়া যাবেনা। আদিবাসীয় আবাস ভূমির কাদা মাটির মানুষকে আর্য ব্রাহ্মন ও দ্রাবিড়ীয় শাসন ও শোষনের চারন ভূমি বানিয়ে এই জনপদে একপক্ষীয় ব্রাহ্মন্য অবয়বে পরিচালনা করা হয়েছিল। তবে প্রাচীনকালে শান্তির ধর্ম হিসাবে সমাদৃত, যা রাজ সিংহাসন ত্যাগী রাজপুত্রের মাধ্যমে ছড়িয়ে মানুষকে শান্তি ও সহমর্মিতার শিক্ষা দিয়ে এই জনপদে স্বস্তি এনে দিয়েছিল তা হোল বৌদ্ধ ধর্ম।
ভারতীয় উপমহাদেশ তথা বাংলার প্রকৃত সনাতন ধর্মই হচ্ছে ওই বৌদ্ধ ধর্ম। কিন্তু এশিয়া মাইনরের আর্য ব্রাহ্মন্য ক্ষমতা ও বুদ্ধিমত্তার তোড়ে ভারতবর্ষ থেকে বৌদ্ধ ধর্মের নির্মুলের কাজটি ভালভাবেই সেরে নিয়েছিল আর্য ব্রাহ্মন্যবাদী শাসক চক্র। তারপরেও দিশেহারা নিষ্পেষিত ভারতীয় তথা বাঙালীরা বার'শ শতকের পর মুসলমান আগমনে একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলার সুযোগ পেল। জাতপাতের কলুষিত ব্রাহ্মনীয় আচরনে অতিষ্ঠ হয়ে তারা ইসলামের শান্তির পতাকাতলে দলে দলে সামিল হওয়া শুরু করে। ইসলামে ভেদাভেদ নাই, উঁচু নীচু নাই, জাতপাতের বৈশ্য শুদ্রের বালাই নাই। একজন নৃপতি যেমন মসজিদে গিয়ে নামাজ আদায় করেন, তেমনি একজন মুঠে দিনমজুরও তার পাশে দাঁড়িয়ে মসজিদে জামাতে নামাজ আদায় করতে পারে। একপাতে পাশাপাশি বসে উজির নাজির সাধারন মুঠে দিনমজুর মসজিদে ইফতার করেন স্বতঃস্ফুর্তভাবে। ইসলামের এই সাম্য ও সহমর্মিতার শিক্ষায় অভিভূত হয়ে নিষ্পেষিত ও উপেক্ষিত ভারত ও বাংলার আমজনতা দলে দলে ইসলামের পতাকা তলে সামিল হন।
(২)
আমার আলোচনার মূল প্রতিপাদ্য হচ্ছে আমাদের অর্জন। অর্থাৎ বাঙালীর অর্জন। তো, কোন্ নিক্তিতে ফেলে আমি আমার অর্জনকে উচ্চকিত করবো সেটাই ভাবনার বিষয়। শত বর্ষের বাংলাকে ধরে যদি আলোচনায় যেতে চাই, তবে একটি মুখই তো সামনে চলে আসে ঘুরেফিরে। হ্যাঁ, পুর্ব পুরুষের কীর্তিময়তার সংলাপে কিছু নাম তো থাকবেই অমোচনীয় কালির আঁচড়ে যা শাশ্বত ও স্বতঃসিদ্ধও বটে। তবে তা কতটুকু পজেটিভ হবে বলা মুস্কিল। বাঙালীর রাজনীতি, রাষ্ট্রনীতি, সমাজনীতি ও আনুপার্বিক অন্যান্য নীতি ও গতিধারার পোষ্ট মর্টেম করলে দেখা যায়, রাজনীতি,রাষ্ট্রনীতি ও সমাজ গতিধারায় বাঙালীর একটি নিজস্ব কৃষ্টি কালচার ছিল যা সর্বোতভাবে বাঙালীয়ানার গৌরবে সমুজ্জ্বল ছিল। কিন্তু ধর্মীয় জাতিস্বত্ত্বা তৈরীর একদল উচ্চাভিলাষী গন্যমান্যের করতলে পড়ে বাঙালীর সর্বময়তার ভষ্মে ঘি ঢালা হোল। সময়ের চক্রে ধনে-জনে-জ্ঞানে সমৃদ্ধ হিন্দুরা বাঙালী সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থায় সামনের সারিতেই অবস্থান করছিলেন। অবশ্য এটাও ঘটেছিল একটি জটিল অবস্থানগত প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে। ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর ভারত দখল যে রক্তাক্ত স্রোতধারায় সম্পন্ন হয়েছিল তার মূল প্রতিপক্ষ ছিল দুটি, একটি মুসলিম ভারত আর অন্যটি বৃটিশ রাজের মদতপুষ্ট বেনিয়া শক্তি ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী। বিগত দিনের পাঁচ- ছয়'শ বছরের মুসলিম শাসনের জ্বালা ভারতীয় হিন্দু ব্রাহ্মন্য রাজা জমিদারদের কাছে অসহ্য যন্ত্রনা হয়ে ঘুরপাক খাচ্ছিল। অথচ বৃহত্তর ভারত সংঘ বিনির্মানে বিচ্ছিন্ন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজন্যবর্গের হিন্দুস্তানে ওইসব রাজা রাজড়াদের কোন সংঘবদ্ধ বিচরন ছিল না। জাত পাতের আর্য অহংবোধের ভগ্নাংশ হয়ে সর্ব ভারতীয় আঙ্গিকে কর্তার আচরনেই তারা বিচরন করতো। ফলে হিন্দুস্তানের হিন্দু হয়ে বেঁচে থাকার একটা প্রচ্ছন্ন তাগিদ তাদের আচার আচরনে বিদ্যমান ছিল।
কালক্রমে ভারতবর্ষ তথা বাঙলায় মুসলিম শাসনের অবসান ঘটে। সেটাও ঘটেছিল প্রাসাদ ষড়যন্ত্র এবং হিন্দু রাজা ও মহাজনী ত্রয়ীর যৌথ প্রযোজনায়। কোলকাতার পথ ধরে পলাশীর প্রান্তরে বাংলার শেষ নবাবের রাজ্যচ্যুত হওয়ার মধ্য দিয়ে বাংলা তথা ভারতের স্বাধীন স্বত্ত্বার সুর্য অস্তমিত হয় ১৭৫৭ সালে। ভারতকে ভারতবর্ষ হিসাবে একাট্টা করে মহান ভারত বিনির্মানের মূল কারিগর তো ওই বিজাতীয় মুসলিম মোঘল পাঠানরাই। সেই মোঘল ও মুসলিম শাসকেরা যখন নিজেদের শক্তিমত্তা ও শৌর্যে বীর্যে ক্ষীন হয়ে পড়লো তখন বর্ণবাদের উদগাতা হিন্দু ব্রাহ্মন্য রাজা আমত্যরা বৃটিশদেরকে নমঃ নমঃ শংখ নিনাদে বরন করে নিল। আর ক্ষমতার ভোল পাল্টে গেলে মুসলিম শাসকেরা সহ গোটা ভারতীয় মুসলিম সমাজ রাতারাতি ভারতীয় হিন্দু সমাজের শত্রু হিসাবে চিহ্নিত হয়ে গেল। অবশ্য বাঙালী মস্তিষ্ক প্রসূত অনুশীলনের মাধ্যমেই তা প্রাতিষ্ঠানিক রূপে সামনে আসে যা রাজনৈতিক আচরনেই প্রকাশ্য রূপ নেয়।
ভারতীয় হিন্দু সম্প্রদায় তাদের বিগত বছরগুলোর মুসলিম অধীনস্ততার জ্বালা মিটানোর খায়েসে বৃটিশদের মিত্র বনে যান। এমনকি, তাদের প্রচার প্রচারনায় সাহেবদের দেবতুল্য সম্মানে রেখে ভারতবর্ষে বৃটিশ শাসনের দীর্ঘায়ু কামনায় পুজা অর্চনা ও স্তুতিমূলক বানী বিবৃতি প্রচার করতেও তারা কুন্ঠিত হয়নি। শাসন ক্ষমতার নিরঙ্কুশতার দন্ডে বৃটিশরাও তাই চেয়েছিল। ভারতীয় জাতিগোষ্ঠীকে ধর্মের গ্যাঁড়াকলে ফেলে devide and rule এর নির্মম বাস্তবতায় তারা মিত্রপক্ষ হিসাবে জ্ঞানে জনে সমৃদ্ধ হিন্দুদেরকে ইস্কাপনের টেক্কা বানিয়ে নিজেদের রাজদন্ড মসৃন করতে চেয়েছিল। ফলে বৃটিশ রাজ কর্মচারী থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় সর্বক্ষেত্রে শিক্ষাদীক্ষায় অগ্রসরমান হিন্দু বাঙালীরা বৃটিশ প্রশাসনের অলিগলিতে নিজেদের প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করে নেয়। সেক্ষেত্রে বাঙালী হিন্দুয়ানীর কুট কৌশল ও বৃটিশ সখ্যতার মাশুল হিসাবে বাঙালী মুসলমানেরা সর্বক্ষেত্রেই রাষ্ট্রীয়ভাবে খাদের কিনারে গিয়ে ছিটকে যায়। ফলে হিন্দুদের ইন্ধন ও বৃটিশ রাজের প্রত্যক্ষ অবহেলায় মুসলমানরা শিক্ষাদীক্ষা ও জ্ঞান বিজ্ঞান চর্চায় অবহেলিত জনপদে রূপান্তরিত হয়। সেসব অবহেলা ও কষ্টের ইতিহাস বড়ই মর্মন্তুদ।
(৩)
প্রাচীন বাংলার ইতিহাস পর্যন্ত না গিয়ে আমরা এক'শ বছরকে ধরেই না হয় বঙ্গ বাঙালীর পোষ্ট মর্টেম করে দেখি। তবে তার আগের শিল্প সংস্কৃতির কিছু উলোট পালটের কথা বলা দরকার বলে মনে করছি। কারন বাঙালীর সমগ্রতায় আর্থ সামাজিক ও শিল্প সংস্কৃতির গতিধারায় যখন তার চরিত্র নির্মানে অগ্রসর হতে হোল তখন দেখা গেল জাতিগত ব্যাখ্যায় না থেকে, একদল উগ্র ধর্মান্ধ গোষ্টি তাদের ধর্ম তত্ত্বের যুক্তিতে বাংলার শিল্প সংস্কৃতির বিনির্মানে উড়নচন্ডি হয়ে উঠলো। এটা অবশ্য ঘটেছিল সিপাহী বিপ্লবের করুন পরিনতির পর। কারন সারা ভারত বর্ষের প্রেক্ষিতে যুদ্ধ করে দেশকে স্বাধীন করার শক্তি ও সাহস হিন্দু সমাজের মধ্যে কখনোই ছিলনা। আর যাদের মধ্যে এই সাহস ও শক্তি ছিল তারা তো তাদের ধর্মীয় প্রফাইলে ছ্যুৎ অছ্যুতের গ্যাঁড়াকলে পিছনের সারিতে অস্তিত্ত্ব টিকিয়ে রাখার হুকুম পালনের দল। অপরদিকে শাসকের জাতি কিংবা যোদ্ধার জাতি হিসাবে খ্যাতি পাওয়া মুসলমানরা অস্ত্র হাতে বৃটিশদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অবতীর্ন হয়েছিল যা সিপাহী বিদ্রোহ, ফকির বিদ্রোহ ইত্যাদি নামে বৃটিশদের মাঝে ভীতি ছড়িয়েছিল। ধর্ম বিভাজনের এসব ঘটনা চক্রে বাংলা ও বাঙালীর মধ্যেও দুটি স্রোত অর্থাৎ হিন্দু সংস্কৃতি ও মুসলিম সংস্কৃতির উদ্ভব তাদের অর্জনের খেরোখাতায় ভিন্ন ভিন্ন ভাবে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে।
বাংলার জাগরনের উত্থান সেই মুসলিম শাসনের সময় হতেই শুরু হয়েছিল। মুসলমান শাসকদের আন্তরিকতা ও বাঙালী কৃষ্টি ও কালচারের সাথে মিশে যাওয়ার সক্ষমতায় তারা বাঙালীদের আপন করে নিতে পেরেছিলেন। সমাজকর্ম ও শাসন কার্যের গুরুত্বপুর্ন স্থানগুলিতে তারা ধর্মভেদের উর্ধে থেকে বাঙালীদেরকে সামনে এনে বাংলাকে সমৃদ্ধ রাজ্য বানানোর কাজে মনোযোগী হয়েছিলেন। এমনকি বাংলার শিক্ষা সংস্কৃতির সুত্রপাত তাদের পৃষ্ঠপোষকতায় হয়েছিল। ফলে ইসলামী ভাবধারা নিয়েই তার সূচনা হয়। আগেই বলেছি, হিন্দু ব্রাহ্মন্য আচরন কখনোই মুসলিম শাসকদের রেখে যাওয়া জনহিতৈষী কোন কাজ মনে প্রানে হজম করতে পারেনি। তাদের মনের সুপ্ত বাসনায় পুষে রাখা আর্য ব্রাহ্মন্যের সেই সংস্কৃত ভাষাকে তারা ভুলতে পারেনি কারন ওটা ছিল বেদ-পুরানের ভাষা যা পারস্য ককেশীয় অঞ্চল থেকে ভারতে আনা হয়েছিল ওই আর্য যাযাবরদের মাধ্যমে। সংস্কৃত কখনোই ভারতীয় ভাষা নয়। জনমানুষের ভাষা নয়। বাংলার ভাষা তো নয়ই। যাহোক, মুসলিম শাসনের পুর্ন মেয়াদে বাঙালীর শিক্ষা সংস্কৃতি মুসলিম ভাবধারার আলোকেই চলমান ছিল। তবে তা কখনোই গরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর উপর চাপিয়ে দিয়ে নয়। দেখা যায় সে সময়কালে বাল্মিকীর রামায়নও বাংলায় অনুবাদ হয় মহাকবি কৃত্তিবাসের হাত ধরে। তখন বাংলার সুলতান ছিলেন জালাল উদ্দিন মোহাম্মদ শাহ্। লক্ষ্যনীয়, সুলতান জালাল উদ্দিন মোহাম্মদ শাহ ছিলেন রাজা গনেশের পুত্র। তিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহন করে হিন্দু মুসলিম সম্প্রীতির দৃষ্টান্ত গড়ে তুলে বাংলার শিল্প সাহিত্যের বিকাশে অনেক জনহিতকর কাজ করে গেছেন। ইসলামের শিক্ষাই বোধ করি তাঁকে একজন সার্থক সুলতান হিসাবে স্বীকৃতি দেয়।
(৪)
আর্য ব্রাহ্মন্য ভাবধারায় মোহাচ্ছন্ন বাঙালীর হিন্দু সম্প্রদায় বৃটিশ সানিধ্যের পুষ্টতায় তাদের ধর্মীয় চেতনার আলোকে বাংলা ভাষা সংস্কৃতি ও সামাজিক কাজে কর্মে মনোনিবেশ করে। যখন তারা দেখলো সিপাহি বিপ্লবের করুন পরিনতিতে মুসলমানদের সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় আবেদনে ভাটা পড়েছে, তখন থেকেই তারা মুসলিম বিদ্বেষী হাল খাতায় শান দেয়া শুরু করলো। ঊনিশ শতকের প্রারম্ভে তাদের উগ্রবাদিতা প্রকাশ্য রূপ ধারন করলো। কারন ততদিনে তারা সংঘবদ্ধভাবে বৃটিশদের গুডবুকে ঠাঁই নিয়ে মুসলমানদের ছন্নছাড়া করে ফেলেছে। ফলে সাংস্কৃতিক অগ্রাসনের মোক্ষম সুযোগ হিসাবে সেই সময়টিকে তারা বেছে নিয়েছিল। ঊনিশ শতকের প্রথম দিকের কথা। বাঙালীর ধর্মীয় চেতনাকে চাঙ্গা করে তাদের মধ্যে ধর্মীয় জাতিস্বত্ত্বা তৈরীর এক সূদুর প্রসারী কার্যক্রমের অংশ হিসাবে বেনিয়া ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের মাধ্যমে বাংলা বিভাগ চালু করলো। সেখানে লক্ষ্যনীয়ভাবে দেখা মিললো এক ঝাঁক হিন্দু পন্ডিতের সমারোহ। আর বৃটিশদেরকে এমনভাবে বশীভূত করা হয়েছিল যে তারা বাংলা ও বাঙালী বলতে হিন্দুদেরকেই সামনে রাখতে স্বাচ্ছন্দ বোধ করতো। কারন বাঙালী হোক, ইউপি বিহারের কিংবা মাদ্রাজী কেরলের হোক না কেন, কাগজ কলমে ও দৃশ্যমানতায় তখন ভারতীয় মুসলমানেরা ছিল বৃটিশদের শত্রু। সেই সুযোগটা আসমুদ্র হিমাচলের ভারতীয় হিন্দু সম্প্রদায় বিশেষ করে ব্রাহ্মন্য সমাজপতি ও রাজনীতিবিদরা লুফে নিয়েছিল। সমাজপতি থেকে শুরু করে রাজনৈতিক কর্মী এবং সমাজের অগ্রনী বুদ্ধিজীবিরাও সেই পথেই হেঁটেছিলেন। সেক্ষেত্রে ধর্মীয় জাত পাতের বর্ন বৈষম্য বাঙালী হিন্দু সমাজে মৃদু অসন্তোষের কারন হয়ে থাকলেও ব্রাহ্মন্য ক্যারিশমাটিক নেতৃত্বে বরাবরই তারা এক গোয়ালের গরু হয়েই বিচরন করেছে। তো, ফোর্ট উইলিয়ামে যখন বাংলা ভাষা চালু হোল তখন সেখানে রামরাম বসু, মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালংকার, শ্রীপতি মুখোপাধ্যায়, রামনাথ বিদ্যাবাচস্পতি, কাশীনাথ ও পদ্মলোচন চূড়ামনির মত বাঘা বাঘা হিন্দু পন্ডিতকে নেয়া হয়। সেখানে বিদ্যাসাগর মশাইও ছিলেন। তবে তিনি বাংলা বিভাগে না গিয়ে সংস্কৃতি বিভাগের পন্ডিত থাকতে স্বাচ্ছন্দ বোধ করেছিলেন। সবচেয়ে চমকপ্রদ ব্যাপার হোল ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের সেই বাংলা বিভাগের প্রধান হিসাবে কোন বাঙালী সামনে এলেন না। তাই এক ইংরেজ পাদ্রী উইলিয়াম কেরিকে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের বাংলা বিভাগের প্রধানের দায়িত্ব নিতে হোল। আর বাঙালী নামের হিন্দু পন্ডিতেরা তাদের পরিকল্পনা মাফিক বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে হিন্দুর ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে ফুলিয়ে ফাঁফিয়ে সামনে তুলে আনার মহাযজ্ঞে মনোনিবেশ করলেন। পাশাপাশি এতদিন ধরে বাঙালীর উঠানে চর্চিত মুসলিম আদলের বাংলা গদ্য রীতিকে বাতিল করে তারা সংস্কৃত ধারা চালু করে বাংলার আদলটাই বদলে ফেললেন। বাঙালী হিন্দু পন্ডিতদের এই বুজরুকি গোটা বাঙালী সমাজ বুঝতে পারে প্রায় এক'শ বছর পর। তবে ততদিনে বাংলার এই সংস্কৃতমাখা আদল বাঙালীর ঘরে ঘরে ছাপা অক্ষরে পৌঁছে গেছে। অন্যদিকে বাঙালীর মুসলমান সমাজ কালু গাজীর কেচ্ছা, পুঁথি পাঠ কিংবা পীর ফকিরের মাজারে মিলাদ পাঠ আর মুর্শিদি গেয়েই দিন কাটিয়েছে। যারা অগ্রনী ও মধ্যবিত্ত সমাজের প্রতিনিধি, তারা ইংরেজ বিরোধিতা করে আরবী ফার্সি মিশেলের বাংলা ছকেই দিনাতিপাত করেছেন।
তাহলে ঊনবিংশ শতাব্দীতে কি বাঙালী মুসলিম সাহিত্যিক বা বোদ্ধা ছিলেন না।? ঊনবিংশ শতাব্দীতে মুসলিম কবি সাহিত্যিক বা সমাজ সংস্কারক যে ছিলেন না, তা কিন্তু নয়। যেহেতু মুসলমানেরা বৃটিশ বিরোধী এবং ভারত আন্দোলনের সক্রিয় যোদ্ধা হিসাবে বিবেচিত ছিলেন বিধায় সেক্ষেত্রে মুসলমানদের প্রকাশ ও বিকাশে অযুত পরিমান কড়াকড়ি ইংরেজ শাসকদের মাধ্যমে আরোপিত ছিল। ফলে নিয়মের বেড়াজালে থেকে বাঙালীর মুসলমান বুদ্ধিজীবি সমাজ আরব্য মাহাত্ম্য ও মুসলিম যোদ্ধা এবং মনীষীদের নিয়েই লেখালেখি করে তাদের শিল্প সাহিত্যের চর্চা করেছেন। এভাবেই বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে বাঙালীর মুসলিম সমাজ তাদের বিচরন নিশ্চিত করেছেন। তবে প্রচার প্রসারে হিন্দু বুদ্ধিজীবিদের ন্যায় উগ্রতা তারা দেখাননি। সে সময়ের মুসলিম লেখক ও সাহিত্যিকের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন - নবাব আব্দুল লতিফ, নবাব ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী, দুদ্দু শাহ, মীর মশারফ হোসেন, সৈয়দ আমির আলি, দাদ আলি, কায়কোবাদ, নাজিবুর রহমান সাহিত্যরত্ন, মুনশি মেহেরুল্লাহ, জমিরুদ্দিন, আব্দুল করিম সাহিত্য বিশারদ প্রমুখ। আবার লক্ষ্য করলে দেখা যাবে মুসলমান বাঙালীরা পুস্তক ও পত্রিকা প্রকাশনায় হাতে খড়ি দিয়েছে বিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে। সেটাও এক লম্বা পথ পরিক্রমার ইতিহাস।
(৫)
লক্ষ্যনীয় ভাবে দৃষ্টিকটু হলেও ঊনিশ শতকের প্রথম ভাগ থেকে শেষ অব্দি হিন্দু বাঙালীর একঝাঁক পন্ডিত ও বরেন্য বুদ্ধিজীবি একতরফা ভাবে হিন্দু ধর্ম ও সংস্কৃতির মাহাত্ম্য প্রচারে আদাজল খেয়ে মাঠ গরম করে ফেললেন। পাশাপাশি ইসলাম ধর্ম ও মুসলমানদের মুন্ডুপাত করার কাজেও ব্রতী হলেন। তাদের এই ব্রত পালনে সেদিন যেসব হিন্দু ব্রাহ্মন্য পন্ডিত বাংলা ভাষা সংস্কৃতির ব্যবচ্ছেদে মাঠ গরম করে রেখেছিলেন তাদেরই উত্তর পুরুষ হিসাবে এই আমরা বিংশ শতাব্দীর বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের উত্তরাধিকারীর প্রদীপ জ্বালিয়ে রেখছি। তাদেরই লেখা প্রতাপাদিত্য, বত্রিশ সিংহাসন, রাজাবলী, অঙ্গুরি বিনিময় ইত্যাদি পড়ে আমরা বাংলা ভাষা সাহিত্য চর্চায় হাত লাগিয়েছি। এই সমস্ত পন্ডিতস্মন্য ব্যক্তিদের রচনা ও প্রবন্ধ পড়ে বাঙালী হিন্দু সমাজে এক নতুন ধরনের উৎসাহ ও উদ্দীপনা সৃষ্টি হয়। ফলে সেই ১৮১৮ থেকে ১৮৩০ সালের মধ্যে বৃটিশ মদদপুষ্টে সাত আটটি সাময়িকী, মাসিক, সাপ্তাহিক কিংবা দৈনিক পত্রিকা আকারে নিয়মিত প্রকাশ হতে থাকে। বাংলা ভাষায় প্রকাশিত এই সব সাময়িকী ও দৈনিকের প্রতিটির মুলমন্ত্রই ছিল হিন্দু জাতি ও ধর্মের স্তুতি এবং মুসলিম জাতি ও ধর্মের প্রতি ডালি ভর্তি বিষদগার।
এই ধাবাহিকতা যখন প্রতিরোধহীন ভাবে চলতে থাকলো, তখন অবির্ভাব হোল এক অতি ধর্মান্ধ বাঙালী হিন্দু পন্ডিতের। তার ইতিহাস বিকৃতির উপন্যাস ও প্রবন্ধ সমূহ হিন্দু জাতীয়তাকে উড়নচন্ডি বানালো। তার রচিত 'রাজ সিংহ' ও 'আনন্দ মঠ' হিন্দু বাঙালীদের প্রকৃত বাঙালী(?) তথা হিন্দুস্তানী হতে ইন্ধন যোগালো। তিনি বাঙালীর একটি অংশের রাজনীতি ও ধর্মীয় আইকন হিসাবে বিবেচিত হতে থাকলেন। হিন্দু ধর্মের মাহাত্ম্য প্রচারে তিনি বাংলা তথা ভারত বর্ষের হিন্দুদের কাছে ঋষি নামে আখ্যায়িত হলেন। তার রচিত 'আনন্দ মঠের' বন্দে মাতরম ভারতবর্ষের জাতীয় শ্লোগানে পরিনত হলো। আর বঙ্কিমের এই অতি হিন্দুয়ানীর খেসারতে কোলকাতা কেন্দ্রিকতার আঁতেল বাঙালী থেকে পুর্ব বাংলার বাঙালীরা মুখ ফিরিয়ে নিল। ফলে বাঙালীদের মধ্যে ধর্মগত বিভাজনের লক্ষন রেখাটি স্পষ্ট আকার ধারন করলো। এজন্যই হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে অনেক বুদ্ধিজীবি বঙ্কিম চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে বাংলা খন্ডিত হওয়ার মূল রূপকার বলে দোষারোপ করেন। বঙ্কিমের সাহিত্য প্রতিভা অবশ্যই বাঙালীর শিল্প সাহিত্যে অগ্রনী ও অমূল্য। মতান্তরে তিনি বাংলা উপন্যাসের আধুনিক রূপকার হিসাবেও সম্মানিত। তবে তার ধর্মীয় রাষ্ট্রচিন্তায় গ্রন্থিত মুসলিম বিদ্বেষী রচনা সমূহ তাকে ঋষির যোগ্যতম স্থানে রেখে সাধু সন্তদের মৌলবাদী মুখিয়া বানিয়েছে, এতে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই।
শুধু বঙ্কিমকেই বা বলি কেন, ঊনবিংশের সেই হাওয়ার তোড়ে বাংলার শিল্প সাহিত্যে মোটামুটি হিন্দু বলয়ের অধিকাংশ পন্ডিত, কবি, সাহিত্যিক হিন্দুত্ববাদের মাহাত্ম্য প্রচারে এবং মুসলমান বিদ্বেষী প্রচারনায় তাদের মেধা ও শ্রমের শ্রাদ্ধ করেছেন এবং তার ধারাবাহিকতা সাতচল্লিশের মধ্য আগষ্ট পর্যন্ত সমান গতিতে চলেছে। এব্যাপারে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথেরও নামটি এসে যায়। রবীন্দ্র সৃষ্ট বহু কবিতা ও গল্প প্রবন্ধ মুসলিম বিদ্বেষী হিন্দু ধর্মান্ধতার প্রতীক হয়ে আমাদের সাহিতাঙ্গনে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। অবিভক্ত বাংলার প্রথম শিক্ষামন্ত্রী খান বাহাদুর নওয়াব আলি চৌধুরী সাহেব কোন এক অনুষ্ঠানে ভাষন দিতে গিয়ে মুসলিম বিদ্বেষী সাহিত্য চর্চা বন্ধের জন্য রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টি আকর্ষন করেন। তখন ভারতী পত্রিকার মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথ শিক্ষা মন্ত্রীর সেই প্রশ্নের জবাব এভাবেই দিয়েছিলেন "মুসলমান বিদ্বেষ বলিয়া আমরা আমাদের জাতীয় সাহিত্য বিসর্জন দিতে পারিনা। মুসলমানদের উচিত নিজেদের জাতীয় সাহিত্য নিজেদেরই সৃষ্টি করা"। লক্ষ্য করুন, বাঙালীর জাতীয় শিক্ষা সংস্কৃতি ও সাহিত্য বলতে কবিগুরু কি বুঝাতে চেয়েছেন! তাঁর এই বক্তব্যে "মুসলমান জাতীয় সাহিত্য" বলতে তিনি কি আলাদাভাবে ধর্মীয় জাতিস্বত্ত্বাকে ইঙ্গিত করেন নি? ধর্মীয় জাতিস্বত্ত্বার সুত্রপাত তো তাঁর এই কথা থেকেই বেরিয়ে এসেছে। সুতরাং বাংলার শিল্প সাহিত্য ও সংস্কৃতির অর্জনের গতিবিধি কোন্ পাটাতনে রেখে অর্জিত হয়েছে তা ভাবলেই চমকিত হতে হয়!
ভাবতে অবাক লাগে যখন দেখি বাংলা ও বাঙালীর শিক্ষা সাহিত্য বলতে ঊনবিংশ শতাব্দী জুড়ে তৈরী করা হিন্দুয়ানী ভিতের উপর দাঁড়িয়ে আছে। কোথায় যেন পড়েছিলাম, মুসলমান যোদ্ধার জাতি। আর হিন্দুরা বোদ্ধার। সত্যিই তো তাই। ছোটবেলায় দেখেছি স্কুলে ভাল অংকের শিক্ষক মানেই অমুক মুখার্জী, চ্যাটার্জি বা ব্যানার্জি। ইংরেজীর চৌকস শিক্ষক বলতে সেনগুপ্ত বা দাসগুপ্ত বাবু । আর ভূগোল ইতিহাস পড়াচ্ছেন হোসেন বা রহমান স্যারেরা। এ অবশ্য বিংশ শতাব্দীর পঞ্চাশ ষাটের দিকের ঘটনা। তবে শুনেছি, সাতচল্লিশের আগে স্কুল কলেজে মুসলমান শিক্ষক বলে কাউকে খুঁজে পাওয়া যেত না। তাহলে ঊনবিংশের পুরোটায় কত গতি সঞ্চার করে বাঙালী হিন্দু বুদ্ধিজীবিরা তাদের হিন্দু ইজমের ভিতকে মজবুত করেছেন তা ভাবলেই শিহরিত হতে হয়। অবশ্য এক্ষেত্রে মুসলিম বাঙালী সমাজের অগ্রবর্তী বা সামনের সারিতে যারা ছিলেন তাদের সিংহ ভাগই বৃটিশ বেদ্বেষী যুদ্ধংদেহী আচার আচরনে তৃপ্ত ছিলেন। জাতি গঠনে তৃনমূল পর্যায়ে বিদ্যাচর্চা বা শিক্ষা বিস্তারে তারা উদাসীন ছিলেন। তারা অধিকাংশ ক্ষেত্রে আরবি ফার্সি কিংবা মোঘলীয় চলন বলনের বাংলা ভাষা সাহিত্য নিয়ে যতকিঞ্চিৎ সময় ব্যয় করতেন। তারা সাধারন বাঙালী মুসলমানদের বৃটিশ বিরোধী যোদ্ধা বানানোর প্রতি মনোযোগী ছিলেন। তারা মক্তব মাদ্রাসা বানিয়ে মুসলিম বাঙালী প্রতিভাকে আরব দেশীয় পাপ পুন্যের হিসাবে ইমাম মোয়াজ্জিন বানানোকেই শ্রেয় মনে করেছেন। ফলে সমাজের সাধারন স্রোতের মুসলমান বাঙালীরা বৃহত্তর বাঙালী সমাজে অকেজো প্রমানিত হয়েছে। বাংলার কৃষ্টি কালচার থেকে সাধারন বাঙালী মুসলমান অচেনা অতিথি হয়েছে। তারা প্রশাসক প্রফেসর হওয়ার চেয়ে সিপাহি মিলিশিয়া হওয়ার মন্ত্রে মুসলিম সমাজপতিদের মাধ্যমে উৎসাহ পেয়েছে।
(৬)
এই যখন অবস্থা তখন চোখ বন্ধ করে একটু ভাবলে যা পাওয়া যায় তার সারমর্ম হোল হিন্দু বাঙালীরা প্রশাসনের মদদপুষ্ট হয়ে জ্ঞান গরিমায় সামনের দিকে এগিয়েছেন। পাশাপাশি মুসলমান বাঙালী সমাজ যুদ্ধংদেহী মনোভাবে থেকে বৃটিশ নিপীড়নের লক্ষ্যবস্তুতে পরিনত হয়েছেন। ফলে তাদের বিকাশ বাংলার কাদামাটির খাল বিল নদী নালার সম্পৃক্ততায় সমৃদ্ধ হয়েছে। এবং এটাই হয়তো মুসলিম সমৃদ্ধ বাঙালদের বাঙালী হওয়ার পথ খুলে দিয়েছে। অখন্ড বাংলায় মুসলিম বাঙালীরা কত্তা মশাই, জি, আজ্ঞে, নমস্কার ইত্যাদির চলনে হাঁপিয়ে উঠেছিলেন। পরবর্তীতে ধর্ম তত্ত্বের মুসলিম রাষ্ট্রের বিজাতীয় শাসনের যাঁতাকলে নিষ্পেষিত বাঙালী অতিষ্ঠ হয়ে পড়ে। এরই ধাবাহিকতায় অল্প শিক্ষিত ও স্বশিক্ষিত বাঙালী নিজেদের রাজনৈতিক ও সামাজিক বিচক্ষনতায় নিজের মাটিতে নিজের পা ফেলার অনুশীলনে আত্মনিয়োগ করার মন্ত্র পাঠে শিরদাঁড়া সোজা করেছে। ফলশ্রুতিতে সোনাফলা বাংলায় হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালীর আবির্ভাব হয়েছে। তাঁর মাধ্যমে বাঙালী অখন্ড বাঙালী স্বত্ত্বায় বুক ভরে নিঃশ্বাস নেয়ার মন্ত্র শিখেছে। বিংশের বটতলায় এসে বাঙালী তার নিজের উঠান তৈরী করে নিয়েছে। তাইতো বাঙালী স্বত্ত্বা নিয়ে বাঙালী আজ স্বমহিমায় পৃথিবীর বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে।
পরাধীনতার গ্লানি নিয়ে শুধুমাত্র নিজের ধর্মীয় স্বত্ত্বার উৎকর্ষতা বিনির্মানে যারা একটি জাতির অস্তিত্ত্বের বুকে বিভাজনের ছুরি বসিয়ে অপর পক্ষকে হেয় প্রতিপন্ন করতে চেয়েছিল; সেই তারাই এখন পরাধীনতার অন্তর্জ্বালায় বাঙালীর "জয় বাংলা" শ্লোগানে উচ্চকিত হতে চায়। তারা বঙ্কিমের যবন ম্লেচ্ছ বাঙালীর, রবীন্দ্রনাথের চাষাভূষা বাঙালীর স্বকীয়তার আবেগে আপ্লুত হন, পুলকিত হন। শুধু কি তাই! সর্ব ভারতীয় আগ্রাসনে জাতে উঠার বাঙালী আজ জর্জরিত, অপমানিত এবং অপাংতেয় হয়ে এক ক্ষুদ্র জাতিস্বত্ত্বা হয়ে নিজেদের শেকড়ের অন্বেষনে হা-পিতাশ করছে। তারাও যে এখন পুর্ব বাংলার মত বিজাতীয় আধিপত্যের শাসন শোষনের যাঁতাকলে পড়ে খবি খাচ্ছেন সেটাও তাদের বিভিন্ন রাজনৈতিক ভাষন বক্তৃতায় আমরা অহরহ শুনতে পাই। পাশাপাশি "শ্যামা প্রসাদ বাবু মশাইরা না থাকলে আমাদেরকে এখন ঢাকার মুসলিম শাসনের অধীনে থাকতে হোত"- এ ধরনের ঊনবিংশীয় বক্তৃতা বিবৃতি এখনও ভারতীয় বাংলায় সগৌরবে উচ্চারিত হয় যা আমরা মিডিয়ার কল্যানে শুনতে ও দেখতে পাই। হিন্দু ইজমের চোঙ্গায় ফু দেয়া সেদিনের সেই শ্রীযুক্ত সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী বা শ্যামা প্রসাদ মুখার্জী বাবুদের উচ্চারনের প্রতিধ্বনি নয় কি এটি? সুতরাং যে ভিতের উপর দাঁড়িয়ে পশ্চিমাংশের বাঙালী বাবুরা তাদের বাঙালীয়ানার মাথায় জল ঢেলে সর্ব ভারতীয় হিন্দু হওয়ার ছড়ি হাতে নেয়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন তার রেশ তো সহজে মিটবার নয়।
(৭)
বাঙালী বাংলার। বাঙালীর আবার হিন্দু মুসলমান কি? আজ স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ তার অসাম্প্রদায়িক চরিত্রে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে ধরনীতে বাঙালী জাতির ডংকা বাজিয়েছে। এটাই বাঙালী জাতি হিসাবে আমাদের গর্বের অর্জন। এ অর্জন এমনি এমনি আসে নি। প্রাচীনকাল থেকে শুরু হওয়া আর্য ব্রাহ্মন্য শাসন শোষন, মধ্যযুগীয় সেন-পাল ও মোঘল পাঠানদের চর্বিত চর্বন এবং ইদানীংকালের বৃটিশ বেনিয়াদের লুটপাট, অত্যাচার, অবিচার এবং সর্বশেষে ধর্মীয় লেবাসের পশ্চিম পাকিস্তানীয় শাসন শোষন বাঙালীকে আপন অস্তিত্ব বিনির্মানের রসদ যুগিয়েছে। বৃহত্তর বাঙালীয়ানায় ধর্মগত ভেকদাভেদে হিন্দু ব্রাহ্মন্যবাদের বৈমাত্রীয় আচরনে বাঙালীর মুসলমান সম্প্রদায় যবন, ম্লেচ্ছ এবং তাদের নিজ ধর্মের মানুষ জাত পাতের ছ্যুত-অছ্যুত ডাকে হেয় প্রতিপন্ন হয়েছে। এমনকি হিন্দু সাহিত্য সংস্কৃতি এতটাই প্রভাবশালী যে তার সমগ্রতার নিরিখে এখনো পুর্ব বাংলা তথা স্বাধীন বাংলার বাঙালীরা পশ্চিমের হিন্দু সম্প্রদায়ের বাঙালীদের কাছে "মুছলমান" হিসাবেই আখ্যায়িত বা পরিচিত। ভারত বেষ্টিত তথাকথিত হিন্দুয়ানীর বাঙালী পশ্চিমবঙ্গে সেখানকার সাধারন মানুষকে জিগ্যেস করলে এখনো তারা পুবের বাঙালীকে "মুসলমান" ডাকেই চিনে। কতটা নীলে আকন্ঠ হলে একটি জাতিস্বত্ত্বার বিভাজন ধর্মীয় আদলে যুগ পরম্পরায় সাম্প্রদায়িক আচরনে বিচরন করে - বলতে পারেন? লজ্জার বিষয় সেটাই যে একবিংশের এই আলো ঝলমলে ডিজিট্যালের বটতলায় দাঁড়িয়ে এখনো আমরা ধর্মকে সামনে এনে জাতি বিভাজনের সেই মহাজনদের নামে উলুধ্বনি দিই এবং পুজা অর্চনা করি। কি দুর্ভাগ্য আমাদের!
-এ হতাশার যবনিকা চাই-