মিহির কান্তি মজুমদার
বিশ্ব হার্ট দিবস- ‘USE HEART FOR EVERY HEART’
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ২৮ সেপ্টেম্বর, বুধবার,২০২২ | আপডেট: ১০:৪৯ এএম, ১৯ ডিসেম্বর,বৃহস্পতিবার,২০২৪
২৯ সেপ্টেম্বর। বিশ্ব হার্ট দিবস। বিশ্ব হার্ট ফেডারেশন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাথে ১৯৯৯ সালে প্রতি বছর ২৯ সেপ্টেম্বর ‘বিশ্ব হার্ট দিবস’ পালনের ঘোষণা দেয়। সে ধারাবাহিকতায় হৃদরোগ প্রতিরোধে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য ২০০০ সাল থেকে পালিত হচ্ছে ‘বিশ্ব হার্ট দিবস’। এবারের প্রতিপাদ্য- ‘Use Heart for Every Heart’. সারা বিশ্বে হৃদরোগে মৃত্যু ও পঙ্গুত্বের হার বাড়ছে। স্বাস্থ্য সচেতনতা ও স্বাস্থ্যসম্মত অভ্যাস এ অকাল মৃত্যু ও পঙ্গুত্বরোধে ভাল ভূমিকা রাখতে পারে।
বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন বিভিন্ন ক্ষেত্রে দৃশ্যমান হয়েছে। জনমিতিক পরিবর্তনে আছে অনেক সম্ভাবনার বাঁক। শিশুমৃত্যু, মাতৃমৃত্যু এবং অনুরূপ অনাকাক্সিক্ষত ও অকাল মৃত্যুরোধে অগ্রগতি হয়েছে অনেক। সংক্রামক রোগের সংক্রমণ ও মৃত্যু বহুলাংশে কমেছে। কিন্তু সমানতালে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে অসংক্রামক রোগের সংক্রমণ ও মৃত্যু। ১৯৮৬ সালে বাংলাদেশে অসংক্রামক রোগে মৃত্যুহার ছিল মাত্র ৮% ভাগ। ২০১৪ সালে এ হার ৫৯%-এ উন্নীত হয়েছে। এখন অসংক্রামক রোগে মৃত্যু আরো বেশি, এবং সেখানে হৃদরোগের ভূমিকাই প্রধান। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০২১ সালের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, অসংক্রামক রোগে এদেশে মৃত্যুর হার ৬৭%, এবং এর মধ্যে ৩০% মৃত্যুর জন্য দায়ী হৃদরোগ।
হৃদপিন্ডের রোগ বা হৃদরোগ প্রধানত ৪ প্রকার। এর মধ্যে আছে হৃদপিন্ডের রক্তবাহী নালী (করোনারি) সংক্রান্ত হৃদরোগ, হার্টের ভাল্ব সংক্রান্ত হৃদরোগ, হার্টের পাম্প করার অক্ষমতাজনিত হৃদরোগ এবং অনিয়মিত হৃদস্পন্দন সম্পর্কিত হৃদরোগ। তবে ৪ প্রকার হৃদরোগের মধ্যে করোনারি হৃদরোগে আক্রান্ত ও মৃত্যুর হার সবচেয়ে বেশি এবং এ মৃত্যুর হার প্রতি বছর বাড়ছে। করোনারি হৃদরোগ বৃদ্ধির গতি নারীদের মধ্যে আরো বেশি। ১৯৮৬ সালে এদেশে প্রতি ১ লক্ষ পুরুষের মধ্যে ১৬ জনের হৃদরোগে মৃত্যুবরণের চিত্র ছিল। ২০০৬ সালে তা বেড়ে ৪৮৩ জনে দাঁড়িয়েছে। মৃত্যুর হার বেড়েছে ৩০ গুণ। নারীদের মধ্যে এ হার বেড়েছে প্রায় ৪৭ গুণ। প্রতি লাখে বেড়েছে সাত জন থেকে ৩৩০ জনের মৃত্যু। সাম্প্রতিক সময়ে হৃদরোগে মৃত্যুহার কি সংখ্যায় বেড়েছে, তা নির্ধারণ করলে একটা আশঙ্কাজনক চিত্রই পাওয়া যাবে।
এদেশে হৃদরোগে আক্রান্ত ও মৃত্যুর হার কেন প্রতি বছর বাড়ছে? এর পেছনে কারণ অনেক। কিছু জানা, কিছু অল্প বা ভাসা ভাসা জানা। কিছু এখনো অজানা। হৃদরোগ বিশেষ করে করোনারি হৃদরোগ সবচেয়ে দক্ষিণ এশিয়ার মানুষের মধ্যে বেশি। বলা হয় জেনেটিক কারণ। কিন্তু দেহকোষের কোন জিন হৃদরোগের সৃষ্টি করে, তা এখনো শনাক্ত হয়নি। জেনেটিক কারণ ছাড়া অন্য যেসব কারণে হৃদরোগ হয়, তার মধ্যে প্রধান হচ্ছে- শরীরে ক্ষতিকর চর্বি বৃদ্ধি। খাদ্যাভ্যাস বিশেষ করে লাল মাংস ও চর্বিযুক্ত খাবার খাওয়া, ধূমপান, কায়িক পরিশ্রম বা ব্যায়াম না করা, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, খাবারে লবণ বেশি খাওয়া ইত্যাদির কারণে ক্ষতিকর চর্বি বৃদ্ধি হয় ও হৃদরোগ সৃষ্টি করে। হৃদরোগের প্রধান কারণগুলো তাই জেনেটিক ও অভ্যাসের মধ্যে বেশি ঘুরপাক খায়। আপাতত: জেনেটিক কারণ প্রতিরোধ না করা গেলেও খাদ্যাভ্যাস এবং জীবনযাত্রার পরিবর্তন ঘটালে হৃদরোগ বহুলাংশে প্রতিরোধ করা যায়। প্রয়োজন স্বাস্থ্য সচেতনতা ও স্বাস্থ্যসম্মত অভ্যাস। এজন্যই প্রতি বছর পালিত হয় ‘বিশ্ব হার্ট দিবস’।
করোনরি হৃদরোগের প্রাদুর্ভাব অহেতুকভাবে দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে বেশি। আবার দক্ষিণ এশিয়ার মানুষের মধ্যে আনুপাতিক হারে বাংলাদেশে এ রোগ বেশি। কারণ অজানা। ধরা হয় জেনেটিক কারণ। বাংলাদেশি মানুষ বিদেশে থাকলেও এর ব্যতিক্রম ঘটে না। নিউইয়র্কে বসবাসকারী বাংলাদেশিদের করোনারি হৃদরোগের হার সেখানের শে^তাঙ্গ মানুষের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ। যুক্তরাজ্যে বসবাসকারী বাংলাদেশি পুরুষদের মধ্যে শে^তাঙ্গদের চেয়ে করোনারি হৃদরোগ ১১২% বেশি এবং মৃত্যু হার ২২০% বেশি।
বাংলাদেশের মানুষের এ করোনারি হৃদরোগের ৪০% থেকে ৬০% কারণ জেনেটিক, উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া যায়। গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশ এবং দক্ষিণ এশিয়ার মানুষের শরীরে এলডিএল (লো-ডেনসিটি লাইপোপ্রোটিন) এবং ট্রাইগ্লাসারাইড বেশি। অপরদিকে, এইচডিএল (হাই-ডেনসিটি লাইপোপ্রোটিন) আনুপাতিক হারে কম। এলডিএলকে শরীরের জন্য খারাপ কোলস্টেরল এবং এইচডিএলকে ভাল কোলস্টেরল হিসাবে গণ্য করা হয়। অর্থাৎ, যে কোলস্টেরল খারাপ সেটা আনুপাতিক হারে বেশি এবং যেটা ভাল সেটি আবার কম। কোলস্টেরল ও ট্রাইগ্লাসারাইডের এ ভারসাম্যহীনতার জন্য দায়ী জেনেটিক কারণ। সাথে আছে সম্পৃক্ত চর্বি ও ট্রান্স ফ্যাট ব্যবহার, বেশি করে ভাজি করা খাদ্য খাওয়া, রান্নার তেল পুনর্ব্যবহার, অতিমাত্রায় সিদ্ধ করে খাওয়ার অভ্যাস।
বাংলাদেশে কম জন্ম ওজন নিয়ে শিশু জন্মানোর হার এখনও ২২.৫%। জন্মের সময় শিশুর ওজন ২.৫ কেজির নিচে থাকলে কম জন্ম ওজন (Low Birth Weight) হিসেবে গণ্য করা হয়। কম জন্ম ওজনের শিশু পরবর্তী জীবনে হৃদরোগসহ অনেক অসংক্রামক রোগের শিকার হয় বলে তথ্য পাওয়া যায়। করোনারি হৃদরোগের সাথে ভিটামিন ‘ডি’ স্বল্পতার সম্পর্ক আছে। সারা পৃথিবীতে ৫০% মানুষের ভিটামিন স্বল্পতা আছে। বাংলাদেশও ব্যতিক্রম নয়। শহরের বিশেষ করে সচ্ছল ও শিক্ষিত মানুষের মধ্যে ভিটামিন ‘ডি’ স্বল্পতার হার বেশি। আর্সেনিক দূষণের সাথেও হৃদরোগের সম্পর্ক পাওয়া যায়। বাংলাদেশে প্রায় এক কোটি মানুষ আর্সেনিক দূষণযুক্ত পরিবেশে বসবাস করে। পানি, তরিতরকারি, খাদ্যশস্যের মাধ্যমে তারা আর্সেনিক দূষণের শিকার হয়। দূষিত বায়ু বিশেষ করে বাতাসের ভাসমান অতি সূক্ষ্মকণা, সালফার-ডাই অক্সাইড, নাইট্রোজেন-ডাই অক্সাইড করোনারি হৃদরোগ সৃষ্টি করে বলে গবেষণায় পাওয়া যায়। এ দেশে ঢাকা ও বড় শহরের বায়ুদূষণ একটা মারাত্মক জনস্বাস্থ্য সমস্যা, যা হৃদরোগ সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখে। ক্যালসিয়াম কার্বাইড দিয়ে পাকানো ফল খেলে করোনারি হৃদরোগের ঝুঁকি আছে। ঝুঁকি আছে আর্থিক দুশ্চিন্তার সাথে, ডিপ্রেশান, বঞ্চনা ও সামাজিক বৈষম্যজনিত মানসিক দুশ্চিন্তার সাথে। এ ঝুঁকি সম্পর্কে যেমন বেশি করে গবেষণা প্রয়োজন, তেমনি প্রয়োজন সামাজিকভাবে এ সকল বঞ্চনা ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা।
হৃদরোগ চিকিৎসা বিশেষ করে করোনারি হৃদরোগ চিকিৎসায় এ দেশে সাম্প্রতিক সময়ে অগ্রগতি অনেক। জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে সর্বপ্রথম ১৯৮৭ সালে এনজিওপ্লান্টি শুরু হয়, বিদেশি চিকিৎসকদের অত্ত্বাবধানে। ১৯৯৫ সালে সম্পন্ন হয় প্রথম ওপেন হার্ট সার্জারি। করোনারি ধমনীতে স্টেন্টিং বসানো শুরু হয়- ১৯৯৭ সালে। ইতোমধ্যে হার্ট সার্জন ও চিকিৎসক তৈরি হয়েছে অনেক। সরকারি-বেসরকারি অনেক হাসপাতালেই এখন এনজিওগ্রাম, স্টেন্টিং এবং বাইপাস সার্জারির মাধ্যমে করোনারি হৃদরোগের ভাল চিকিৎসা হয়। সার্জারি ও চিকিৎসায় যে অগ্রগতি, সে তুলনায় এ রোগ প্রতিরোধে অগ্রগতি প্রায় নেই। এটি একটি ব্যয়বহুল চিকিৎসা এবং অধিককাংশ রোগী যথাযথ চিকিৎসা গ্রহণের সুযোগ পায় না। তাছাড়া হৃদরোগে আক্রান্ত হলে মৃত্যুর আশঙ্কা বেশি থাকে। পঙ্গুত্বের হারও অনেক। দেশে হৃদরোগ এক নম্বর মারণঘাতী রোগ হিসেবে চিহ্নিত। এ অবস্থা নিরসনে সচেতনতা বৃদ্ধি ও প্রতিরোধের কোন বিকল্প নেই। স্বাস্থ্য-শিক্ষা এবং পাঠ্যপুস্তকে এ রোগ প্রতিরোধের বিষয় অন্তর্ভুক্ত হওয়া খুবই জরুরি। মানুষই যদি না বাঁচে, তবে শিক্ষিত করে অগ্রগতি করা যাবে না। বিশ্ব হার্ট দিবসে এবং আগামী দিনগুলোতে হৃদরোগ প্রতিরোধে সচেতনতা বৃদ্ধি পাবে- সেটাই হোক অঙ্গীকার।