জালাল উদ্দিন আহমেদ
বাঙালীর নয় বছর
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ১৭ সেপ্টেম্বর,শনিবার,২০২২ | আপডেট: ০৩:৪০ এএম, ২১ ডিসেম্বর,শনিবার,২০২৪
নড়াইলের ঘটনা মনকে নাড়া দেয়। বিশেষ করে মাশরাফির মত ইয়ং জেনারেশনের একজন আইকন যখন জনতাকে নিজেদের বিবেককে জিগ্যাসা করার জন্য প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন তখন সত্যিই বাঁচার তাগিদ অনুভূত হয়। কারন সেই যুক্তফ্রন্ট আমলে যে বাঙালী হয়ে আমার জন্ম হয়েছিল সেই চারিত্রিক বৈশিষ্ঠে বেড়ে উঠে পই পই করে আজ সত্তর ছুঁই ছুঁই এক বৃদ্ধের তো এখন ওই তরুন প্রজন্মের দিকেই তাকাতে হবে।
আঙ্গুলি ছাপের নিয়মে (thumb rule) পুর্ব বাংলার মানুষ সেই ১৯৫৪ সালে তখনও বাঙালী। এই বাঙালদের বা প্রকৃত বাঙালীর একটা নিজস্ব স্বকীয়তা রয়েছে। ইতিহাসে তারা সাতচল্লিশের পর পাকিস্তানী নামে ঘোষিত হলেও শেকড়ের বাঙালীয়ানায় তারা দীর্ঘ নয়টি বছর তাদের চলার স্বাচ্ছন্দ ও স্বকীয়তা পেয়েছে। অর্থাৎ পাকিস্তান ঘোষিত রাষ্ট্র হলেও পুবের অংশের বাঙালীরা তখনও তাদের তিলকে সরকারীভাবে পাকিস্তানী তকমা ঠেঁসে দিতে পারেনি। সাংবিধানিক বলুন বা আইনগত অনুশাসন বলুন, সেই তরীতে পা রাখতে বঙ্গদেশের বাঙালদের ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছে। অর্থাৎ বাঙালী তার বাঙালীয়ানার ঐতিহ্যে ট্রানজিট পিরিয়ড হিসাবে ১৯৪৭ হতে ১৯৫৬ পর্যন্ত এই নয়টি বছর সময় পেয়েছে। সম্ভবতঃ পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রশাসকদের অবিমৃষ্যকারিতা কিংবা অপরিপক্কতার ফল হিসাবেই বাঙালী এই ঈশ্বর প্রদত্ত ব্রিদিং টাইমটা (breathing time) পেয়েছিল। ফলে ধর্মীয় জাতিস্বত্ত্বা তৈরীর অশুভ সূচনার প্রথম নয়টি বছর পুর্ববাংলার বাঙালী বাঙালীয়ানার উঠানেই বিচরন করেছিল। তবে সাম্প্রদায়িক আচরন ততদিনে যে বিষাক্ত রূপ ধারন করেছিল তা থেকে বেরিয়ে আসা বাঙালীর জন্য কঠিনই হয়েছিল বলে ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়। বাঙালী নেতৃত্বের একটি বড় অংশ হিন্দুপ্রধান হওয়াতে তাদের ভারতীয় হিন্দুত্ববাদে মিশে যাওয়ার অহংবোধে স্থানীয়ভাবে সংখ্যা গরিষ্ঠ মুসলিম বাঙালী সে সময় কিছুটা হলেও অসহিষ্ণু হয়ে পড়েছিল। ইতিহাসের খেরোখাতা একচক্ষু দৈত্য নয় বলেই হয়তো কোলকাতার ছেচল্লিশের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা আমাদের কাছে বেশ সরল আকারেই ধরা দেয়। ভারত ভূ-ভাগে বৃটিশ শাসনের পত্তন যেহেতু এই কোলকাতা কেন্দ্রিক ছিল বিধায় ঊনিশ ও বিংশ শতকের মিশেলে কোলকাতাই ছিল বৃটিশ ভারতের ব্যবসা বানিজ্য ও শিল্প সংস্কৃতির পীঠস্থান। ফলে তৎসময়ে কোলকাতায় গড়ে উঠেছিল মুসলিম আভিজাত্যের সমন্বয়ে একটি মিশ্র বাঙালী কালচার। পাশাপাশি হিন্দু ব্রাহ্মন্য জমিদার ও ক্ষুদ্র রাজন্য বর্গের আভিজাত্যের মিশেলে হিন্দু বাঙালী সম্প্রদায়ের একটি প্রচ্ছন্ন হিন্দু বাঙালীয়ানা তাদেরকে আলাদাভাবে চিহ্নিত করেছিল। আর সে সময়ের কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের ধর্মীয় জাতিস্বত্ত্বা তৈরীর সেই অশুভ উস্কানীমূলক কর্মকান্ডেই ইতিহাসের সেই জঘন্যতম ৪৬ এর দাঙ্গা সংঘটিত হয়েছিল।
১৯৪৭ এর বাঙলা বিভাজনের দৃষ্টিকোন থেকে একটা জিনিস স্পষ্ট হয়ে যায়। বাঙালীর বাঙালীয়ানার যে নিজস্ব স্বকীয়তা এবং অনুভব তা পুর্ব বাংলাতেই স্পষ্টীকরন হয়। কারন তারা পাকিস্তানী হলেও হাজার মাইল ব্যবচ্ছেদের ফলে পাকিস্তান রাষ্ট্র যন্ত্রের নিউক্লিয়াস ওই করাচি লাহোর ইসলামাবাদেই গচ্ছিত ছিল। ফলস্বরূপ পাকিস্তানীয় পুর্ব বাংলার বাঙালী ধর্ম নির্বিশেষে নিজেদের অস্তিত্বের আয়নায় বাঙালী হয়ে দাঁড়ানোর একটি সুযোগ পেয়েছে। অপর দিকে এক ভূখন্ড বেষ্টিত হওয়ার বিড়ম্বনায় ভারত অঙ্গীভূত বাংলার পশ্চিমাংশ দম ফেলার সময় না পেয়ে বন্দে মাতরম আর জয় হিন্দ নিয়েই ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। ফলে তাদের মধ্যে বাঙালীয়ানার আপন স্বত্ত্বা নিয়ে ভাববার সময়টুকু তারা খুব বেশী পেয়েছিল বলে মনে হওয়ার কোন কারন দেখিনা। তাছাড়া দাঙ্গা বিদ্ধস্ত ও শরণার্থীয় নয় ছয়ের মধ্যে সাতচল্লিশ থেকে পঞ্চাশের এই স্বল্প সময়টুকু, তাদের দম নেয়ার সুযোগও কমিয়ে দেয়। অপরপক্ষে সর্বভারতীয় মুখ হওয়ার উদগ্র বাসনায় বাঙালী হিন্দু নেতা ও মাথারা দিল্লি বোম্বাই মাদ্রাজ করে করে মেধার সিংহভাগই ততদিনে ভারতীয় উঠানে বিনিয়োগ করে ফেলেছেন। বলা যায় মহান ভারতীয় মুখ হওয়ার প্রতিযোগিতায় নিজেদেরকে ন্যস্ত করে ফেলেছেন। আপন উঠানের মুসলিম গরিষ্ঠের জুজুর ভয়ে তারা ভারতীয় তকমা গলায় ঝুলিয়ে মৌলবাদী উচ্চারন 'বন্দে মাতরমে'র ভারতীয় হওয়ার দৌড়ে গুজরাঠী মারাঠী পাঞ্জাবী বা বিহারীদের সঙ্গে পাঞ্জা লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়েছেন। অপরদিকে মুসলিম গরিষ্ঠের পাকিস্তানীয় পুর্ব বাংলার বাঙালীরা নিজেদেরকে বাঙালী ভাবার সময়টুকু কিঞ্চিত হলেও পেয়েছে। এবং এভাবেই পাকিস্তানী পুর্ব বাংলায় দৃশ্যমান no man's land এর বাঙালীরা বাঙালী হয়ে বেঁচে থাকার স্বপ্নে আপন হালখাতা খোলার সুযোগ করে নিয়েছে। তাছাড়া অখন্ড বাঙালী চেতনার প্রবক্তা বলে খ্যাত অধিকাংশ নেতা মাথারাই ছিলেন তখন পুর্ব বাংলার রাজনীতির প্রথম সারির মুখ।
প্রসঙ্গ, নয়টি বছর। হাঁ, এই নয়টি বছর বাঙালীর আপন অস্তিত্ত্ব বিনির্মানের কয়েক ধাপ সিঁড়ি বলে ধরে নেয়া যায়। কারন বিধিবদ্ধ আইন কানুনে পাকিস্তানী হলেও সাতচল্লিশ থেকে ছাপান্ন পর্যন্ত তারা বাঙালীয়ানার আপন সৌষ্ঠবে নিজেদের উঠান সাজিয়েছে। কথিত পুর্ব বাংলার বাঙালীয়ানায় তারা নিজেদেরকে নিয়ে ভাববার গলিপথ পেয়েছে। ফলে প্রথম ধাপ হিসাবে তারা নিজেদের মুখের ভাষা নিয়ে চিন্তা ভাবনা করে সেই পথে হেঁটেছে। বলা যায় ভাষার সূত্র ধরেই বাঙালীর জাতিগত অস্মিতার সূচনা পর্ব অঙ্কিত হয়েছে। এভাবেই বাঙালী জাতীয়তাবাদের সূচনা পর্ব তৈরী করে পাকিস্তানী তকমা নিয়েও তারা নিজেদের জাতিগত উঠান তৈরীর অনুশীলনে একটি ফ্রি স্পেস করে নিয়েছে এবং নিজেদের মধ্যে ধারন করার সক্ষমতা অর্জনে এগিয়েছে। অবশ্য সৃষ্টি করা কিছু জাতিগত বৈসাদৃশ্যও বাঙালীকে নিজেদেরকে নিয়ে ভাববার রসদ যুগিয়েছে। সেক্ষেত্রে ধর্মতত্ত্বের উপর ভর করে মুসলিম রাষ্ট্র গঠন পূর্বক তার আঙ্গিনায় বিজাতীয় ও বিভাষীয় মুসলমান আমদানী করা, বাঙালীর কাছে অস্বস্তির ব্যাপার ছিল বৈকি! শাশ্বত বাঙালীয়ানার উঠানে শংকর জাতিস্বত্ত্বার উলোট করা গন্ধে আম বাঙালী তাদের নিজস্ব স্বকীয়তায় সম্বিত ফিরে পেয়ে নিজেকে নিয়ে ভাববার ফুরসৎ পেয়েছে। তড়িঘড়ি করে পাকিস্তান রাষ্ট্র কাঠামো বিচ্ছিন্নভাবে গঠিত হওয়ায় পশ্চিম অংশের শাসক শ্রেনী তখনও নিজেদের পশ্চিমাংশ গুছিয়ে আনতে পারেনি। ফলে পুর্বাংশের বাঙালী অধ্যুষিত পাকিস্তানীরা নিজেদেরকে সাচ্চা পাকিস্তানী হিসাবে উপস্থাপনে স্বতঃস্ফুর্ত হয়নি। বাঙালী জাতীয়তাবাদের হিন্দু-মুসলমান হয়ে শান্তি ও সম্প্রীতির বাতাবরনেই তারা সচল ছিল বা থাকার চেষ্টায় মানসিক ভাবে স্বচ্ছ্ব ছিল। যদিও তা ধর্মীয় জাতিস্বত্ত্বার তোড়ে ম্লান হয়ে যায়। কারন রাষ্ট্রীয় ঘোষনায় পাকিস্তান ছিল মুসলিম রাষ্ট্র। ফলে নীতিগত আচরনে এবং শাসক শ্রেনীর প্রচ্ছন্ন মদদে সে সময়টায় হিন্দু মুসলিম বিভাজনের লক্ষ্মন রেখাটি প্রকাশ্য ও গাঢ় বর্ণ ধারন করেছিল যা এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ সাধারন মানুষ পায়নি।
যাহোক পুর্ব বাংলার মুসলমান বাঙালী সমাজ সে সময়টায় ক্ষণকালের পাকিস্তানী আমেজে মুসলমান অস্তিত্ত্বের ঘ্রান নিলেও, বাঙালীয়ানার অনুশীলনে তারা সব সময় সজাগ ছিল। যে মুসলিম লীগ ভারতীয় মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষার্থে পুর্ব বাংলার বাঙালীর মস্তিষ্ক প্রসূত হয়ে ঢাকার মাটি থেকে আত্মপ্রকাশ করেছিল, পাকিস্তান সৃষ্ঠির পর সেই মুসলিম লীগের চেহারা বদলে গেল। চর দখলের কায়দায় পাকিস্তান রাষ্ট্রের সমস্ত অলিগলিতে তখন পশ্চিম পাকিস্তানী শাসক ও প্রশাসকদের অবাধ বিচরন। ছাত্র আন্দোলনের ভাষার দাবি এক সময় রাজনীতিতেও উপাত্ত যোগান দিল। ফলে বছর ঘুরতেই মুসলিম লীগের মোহ বাঙালী রাজনীতির মহারথীদের বিচলিত করলো। তারা নিজস্ব স্বকীয়তায় অবিচল থেকে আওয়ামী মুসলিম লীগ ভেঙ্গে আওয়ামী লীগ গঠন করে জনতার দরবারে হাজির হোল। তাছাড়া সে সময়ে বাঙালী মুসলমানের মুরুব্বী শেরে বাংলা, ভাসানী, সোহরাওয়ার্দী এবং বাংলার ক্ষনজন্মা সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালী শেখ মুজিবর রহমানরা তখন সামনের সারিতে। এবার বাঙালী তার বাঙালীয়ানার আঙ্গিকে রাজনীতি করার প্রতিজ্ঞায় শক্তি সঞ্চয়ে মনোযোগী হোল। বাহান্ন পেরিয়ে চুয়ান্নতে তারা নিজেদের আপনত্ব প্রকাশে প্রকাশ্য হোল। যদিও সবকিছু পাকিস্তান কাঠামোতে এগিয়েছে, কিন্তু পাকিস্তানী হয়েও বাঙালীয়ানার উঠান বিনির্মানে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ সাতচল্লিশ থেকে ছাপান্ন পর্যন্ত একটি প্রচ্ছন্ন ব্রিদিং টাইম পেয়েছে। ফলে পরবর্তী সময়টুকুর পনের বছরে তারা কোমর শক্ত করেছে। অবশেষে ক্ষনজন্মা মহান নেতার একছত্র নেতৃত্ত্বের কারিশমায় একাত্তরে বাঙালী, মুক্ত জমিনে লাল সবুজের পতাকা উড়িয়েছে। সুতরাং পাকিস্তানী হওয়ার প্রথম নয়টি বছর পুর্ব বাংলার বাঙালী ধর্ম নির্বিশেষে তার বাঙালীয়ানার ঘর মেরামতের সময়টুকু কাজে লাগিয়েছিল বলে বিদগ্ধজনেরা বলে থাকেন। বাঙালী জাতীয়তাবাদের বিনিসুতো গাঁথার মহেন্দ্রক্ষন হিসাবে বিবেচিত হয় এই নয়টি বছর, যা ইতিহাসবিদেরাও একবাক্যে স্বীকার করেন বলে শ্রুতি আছে।
–--০–--