মিহির কান্তি মজুমদার
ক্যান্সার চিকিৎসায় নতুন দিগন্তে- ভাইরাস
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ৪ সেপ্টেম্বর,রবিবার,২০২২ | আপডেট: ১০:১১ এএম, ২১ ডিসেম্বর,শনিবার,২০২৪
আমাদের শরীরে ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া, প্রোটোজোয়া, ফাঙ্গাস, এলগি, প্যারাসাইট প্রভৃতি কোটি কোটি অণুজীব আছে। এর মধ্যে অধিকাংশ উপকারী অনুজীব, কিছু আছে ক্ষতিকর। এর ওজন প্রায় ১ থেকে ২ কেজি। শরীরে খাদ্য হজম প্রক্রিয়া, ভিটামিন উৎপাদন, রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা তৈরী, ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ বিনষ্ট করা- এসব কাজে অণুজীবের ভূমিকা অনেক। তবে ভাইরাস মানেই খারাপ কিছু এমন দৃষ্টিভঙ্গি গেঁথে আছে আমাদের মানসিকতায় ও সমাজে। সে কারণে কম্পিউটারের সফটওয়্যার, যা কম্পিউটার প্রোগ্রাম, ডাটা এবং সিস্টেমকে ক্ষতিগ্রস্ত করে, তার নাম হয়েছে ভাইরাস। ভাইরাসের নাম ছাড়া যার অন্য কোন কিছুই মিল নেই। ভাইরাস সৃষ্ট রোগের মধ্যে হেপাটাইটিস, ইনফ্লুয়েঞ্জা, জলবসন্ত, হাম, এইড্স প্রভৃতি। সর্বশেষ সংযোজন বৈশ্বিক মহামারী কোভিড-১৯। ১৯৮০ এর দশকে এইডস রোগের ভাইরাস এইচআইভি যখন শনাক্ত হয়, তখন এ ভাইরাস বেশ আতঙ্ক সৃষ্টি করেছিল। সে আতঙ্ক এখনও আছে। এর মধ্যে চলমান মহামারীর করোনা ভাইরাস সৃষ্টি করেছে মহাতঙ্ক। জনজীবন ও জীবিকা প্রায় অচল করে অর্থনীতিকে পর্যদুস্ত করে ছেড়েছে। কিছু কিছু ভাইরাস যেমন- হেপাটাইটিস-বি, হেপাটাইটিস-সি, হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস মারাত্নক পর্যায়ের জীবন বিপন্নকারী ক্যান্সার সৃষ্টি করে।
ক্যান্সার একটি ভয়াবহ মারণঘাতী রোগ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সমীক্ষা অনুযায়ী সারা পৃথিবীতে প্রায় ২ কোটি মানুষের ক্যান্সার রোগ আছে। প্রতিবছর এ তালিকা দীর্ঘ হচ্ছে। বাংলাদেশে ক্যান্সার রোগীর সংখ্যা প্রায় ১৫ লক্ষ এবং প্রতি বছর প্রায় ২ লক্ষ মানুষ নতুন করে ক্যান্সার রোগীর তালিকায় যুক্ত হচ্ছেন। ক্যান্সার রোগের অস্তিত্ব ছিল সেই প্রাচীনকাল থেকেই। মিশরের মমির শরীরে হাড়ের ক্যান্সার রোগের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০ অব্দে মিশরে পেপিরাসে লিখিত বর্ণনায় স্তন ক্যান্সার এবং তা অপসারণে ফায়ার ড্রিল নামের আগুনের অস্ত্র ব্যবহারের তথ্য আছে। পৃথিবীতে সভ্যতা ও জীবনযাত্রার মান যত উন্নত হয়েছে, ক্যান্সারের ব্যপ্তি ও তান্ডব ততই বেড়েছে। পরিবেশ দূষণ, বিশেষ করে বায়ু দূষণ, জীবনযাত্রার পরিবর্তন, খাদ্যাভাস, মাদকদ্রব্য গ্রহণ, ধূমপান, ক্ষুদ্র অনুজীব যথা ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ এবং জেনেটিক উত্তরাধিকার ইত্যাদি কারণে ক্যান্সার রোগের প্রাদুর্ভাব দিন দিন বাড়ছে। রোগের প্রাথমিক পর্যায়ে ক্যান্সার শনাক্ত করা গেলে নিরাময় সহজ হয়। কিন্তু প্রথম পর্যায়ে শনাক্ত হয় এমন রোগীর সংখ্যা অনেক কম। পরে যখন শনাক্ত হয়, তখন এটি শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রতঙ্গে ছড়িয়ে যায়, রোগের তীব্রতা বাড়ে। ব্যয়বহুল চিকিৎসার জন্য রোগী এবং পরিবার উভয়ের পরিণতি দাঁড়ায় অবর্ণনীয় ও মর্মান্তিক।
ক্যান্সার রোগের ক্রমবর্ধমান প্রাদুর্ভাব এবং পরিণতির মধ্যে হঠাৎ করে সম্প্রতি একটা খবরে অনেকেরই চোখ পড়েছে। নিউইয়র্কের স্লোয়ান ক্যাটারিং ক্যান্সার সেন্টারে ১৮ জন মলদ্বারের ক্যান্সার রোগী ছয় মাসের চিকিৎসায় সম্পূর্ণ সুস্থ্য হয়েছেন। শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা (Immune System) ব্যবহার করে ক্যান্সার নিরাময়ের এ পদ্ধতির নাম দেওয়া হয়েছে ইমিউনোথেরাপি। শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার একটি অংশ জন্মগত বা সহজাত (Immune System)। এবং আরেকটি অংশ অর্জিত (Acquired Immunity)। রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা শরীরের একটি জটিল মিথস্ক্রিয়া। শরীরের অনেক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, কোষ, কোষ-কলা এবং শ্বেতকণিকা এ রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা সৃষ্টি করে। যেসব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সরাসরি এ মিথস্ক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করে- তার মধ্যে আছে থাইমাস, প্লীহা বা স্প্লীন, অস্থিমজ্জা, টনসিল, অ্যাপেন্ডিক্স এবং শরীরের গলা, বগল, কুঁচকি, বুক, পেট ইত্যাদি স্থানের শতাধিক লসিকা গ্রন্থি। শরীরের শিরা-উপশিরা যেমন-দেহকোষে রক্ত পৌঁছে দেবার জন্য নেটওয়ার্ক তৈরী করে। তেমনি শরীরের লসিকা গ্রন্থির সাথে সংশ্লিষ্ট অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের নেটওয়ার্ক শ্বেত রক্ত কনিকাসহ এক প্রকার তরল পদার্থ প্রবাহিত রাখে। যা শরীরের কোনো সংক্রমণ বা ক্ষতিকর কিছুর অনুপ্রবেশ ঘটলেই তা ধ্বংস করার অঘোষিত যুদ্ধে লিপ্ত হয়।
শরীরের এ ইমিউনোথেরাপি সব ধরণের ক্যান্সার নিরাময়ে অবদান রাখবে কিনা, তা ভবিষ্যতেই জানা যাবে। তবে ক্যান্সার নিরাময়ের সম্ভাবনার দরজায় অবস্থান করেছে- ভাইরাস। ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের এফডিএ (Food and Drug Administration) ২০১৫ সালে এইচএসভি (HSV-Herpes Simplex Virus) ভাইরাসের মিউট্যান্ট T-Vac কে মেলানোমা নামের মারণঘাতী ত্বক ক্যান্সার নিরাময়ের অনুমোদন দিয়েছে। ২০১৬ সালে অনুমোদন দিয়েছে অস্ট্রেলিয়া ও ইউরোপীয়ান ইউনিয়ন। চীন ২০০৫ সালেই এডিনো ভাইরাসের মিউট্যান্টকে জরায়ু ক্যান্সার চিকিৎসায় ব্যবহার করছে। এডিনো ভাইরাসের জেনেটিক পরিবর্তন ঘটিয়ে অনকোরাইন নামে মাথা ও গলার ক্যান্সার কোষ ধ্বংসে ব্যবহৃত হচ্ছে। যেসব ভাইরাসের ক্যান্সার কোষ ধ্বংস করার ক্ষমতা আছে, তাদের বলা হচ্ছে অনকোলাইটিক ভাইরাস। এবং নিরাময় পদ্ধতির নাম অনকোলাইটিক ভাইরোথেরাপি। অনকোলাইটিক ভাইরাস ক্যান্সার কোষ ধ্বংস করে, কিন্তু সুস্থ্য কোষের কোনো ক্ষতি করে না। ক্যান্সার কোষ ধ্বংসে বর্তমানে রিগভির নামে পরিবর্তিত ভাইরাসের ব্যবহার দেখা যায়।
এমনিতে যে ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়ার কারণে রোগ হয়, সেই ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়াকে নির্বিষ বা নিস্ক্রিয় করে ঐ রোগ প্রতিরোধের ভ্যাকসিন তৈরী করা হয়। তবে ক্যান্সার নিরাময়ে ভাইরাস ব্যবহারের সম্ভাবনা জাগে শত বছর আগে। ১৯০৪ সালে লিউকেমিয়া বা রক্ত ও অস্থিমজ্জার ক্যান্সারে আক্রান্ত এক নারী ভাইরাসজনিত ফ্লু রোগে আক্রান্ত হলে তার ক্যান্সার কোষ ধ্বংস হয়। ১৯১২ সালে একজন জরায়ুমুখ ক্যান্সারে ভোগা অপর এক নারী রেবিস ভাইরাসে আক্রান্ত হলে অনুরূপভাবে তার ক্যান্সার কোষও ধ্বংস হয়। তখন থেকেই ভাইরাস দিয়ে ক্যান্সার রোগ সারানোর গবেষণা ও ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শুরু। ১৯৫০ থেকে ১৯৮০ এর দশক পর্যন্ত ভাইরাস দিয়ে ক্যান্সার নিরাময়ের প্রচেষ্টা, গবেষণা ও ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল হয়েছে বিস্তর। বিশেষ করে হেপাটাইটিস, ওয়েস্ট নাইল ভাইরাস, ইয়োলো ফিবার ভাইরাস, ডেঙ্গু ভাইরাস এবং এডিনোভাইরাস দিয়ে ক্যান্সার নিরাময়ের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল বা পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়েছে অনেক। কিন্তু ভইারাসকে যথাযথ নিয়ন্ত্রণের কোন পদ্ধতি আবিষ্কৃত না হওয়ায় এসব প্রচেষ্টা লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হয়।
১৯৮০ এর দশকে ভাইরাস বা কোন কোষের ডিএনএ পরিবর্তন করার (Recombinant DNA) প্রযুক্তি আবিষ্কার এর সাথে সাথে রোগ নিরাময়, খাদ্য উৎপাদনসহ অনেক বিষয়ে সম্ভাবনার নতুন দ্বার উন্মোচিত হয়। ভাইরাসের ক্ষতিকর জিন অপসারণ ও ভাইরাসকে গতিশীল করার নতুন জিন অন্তর্ভুক্তি ইত্যাদি বিভিন্ন জিন প্রযুক্তির উদ্ভাবন ঘটে। ইতোমধ্যে ক্যান্সার সেল ধ্বংস করার ক্ষমতা আছে- এমন অনকোলাইটিক ভাইরাস শনাক্তের তালিকাও বৃদ্ধি পেয়েছে। এর মধ্যে এডিনোভাইরাস, ভ্যাকসিনিয়া ভাইরাস, হারপিস সিমপ্লেক্স ভাইরাস-টাইপ-১ (HSV-1), মিজেলস ভাইরাস, পোলিও ভাইরাস, পক্স ভাইরাস, নিউক্যাসল ডিজিস ভাইরাস, রিও ভাইরাসের নাম উল্লেখযোগ্য। এমনকি জিনগত পরিবর্তন না ঘটিয়ে শুধু ভাইরাসের মারণঘাতী ক্ষমতা নির্বিষ করে ক্যান্সার নিরাময়ের আরএনএ (RNA) ভাইরাসও আবিষ্কৃত হয়েছে। যার মধ্যে আছে হেপাটাইটিস-সি ভাইরাস, হিউম্যান টি সেল, লিম্ফোট্রপিক ভাইরাস প্রভৃতি। ভাইরাসের জিনগত পরিবর্তন ঘটিয়ে ক্যান্সার সেলকে সরাসরি আক্রমণ, প্রয়োজনে প্রতিলিপি তৈরির গতি বৃদ্ধি এবং ক্যান্সার সেল ধ্বংস করার ক্ষমতা বৃদ্ধির বিষয়ে অগ্রগতি হয়েছে অনেক ।
ভাইরাস দিয়ে ক্যান্সার নিরাময় এখন আর শুধুমাত্র গবেষণা বা পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। এইচএসভি-১ (HSV-1) ভাইরাসের মিউট্যান্ট T.Vec ইতোমধ্যে তিন ধাপের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল সম্পন্ন করে মেলানোমা নামের ক্যান্সার নিরাময়ে ব্যবহৃত হচ্ছে। স্তন ক্যানসার নিরাময়েও এ ভাইরাস এবং রিওলাইনিন নামের ভাইরাসের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল চলছে। এডিনোভাইরাস মূত্রথলির ক্যান্সার সেল ধ্বংসে ব্যবহার করা যাবে। রিওলাইসিন ভাইরাস মাথা ও গলার ক্যান্সার কোষ ধ্বংস করে। এডিনোভাইরাস এবং ভ্যাকসিনিয়া ভাইরাস লিভার ক্যান্সার কোষ ধ্বংসে কাজ করে। এদের কার্যক্রম ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল বা পরীক্ষাধীন আছে। প্রোস্টেট ক্যান্সার কোষ ধ্বংস করার জন্য এডিনোভাইরাস, রিওলাইনিন, ভ্যাকসিনো, এইচএসভি-১ এবং ফাউলপক্স ভাইরাসের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল দ্বিতীয় পর্যায়ে আছে। তৃতীয় পর্যায় অতিক্রম করলেই এফডিএ-এর অনুমোদন মিলবে। কোলন ও মলদ্বারের ক্যান্সার সেল ধ্বংসে ভ্যাকসিনিয়া ভাইরাসের পরীক্ষা কার্যক্রম অনেক দূর এগিয়েছে। গ্লিওব্লাসটোমা নামের দ্রুত বর্ধনশীল ব্রেইন ক্যান্সার নিরাময়ে এইচএসভি, ভ্যাকসিনিয়া, পোলিও ভাইরাস এবং রিওভাইরাসের পরীক্ষায় আছে অনেক অগ্রগতি।
বিদ্যমান ক্যান্সার চিকিৎসা পদ্ধতির সাথে ভাইরাস যুক্ত করে ক্যান্সার চিকিৎসার পরীক্ষা-নিরীক্ষা অনেকটা পথ পাড়ি দিয়েছে। বিদ্যমান কেমোথেরাপির সাথে এডিনোভাইরাস যুক্ত করায় ক্যান্সার সেল ধ্বংস করার ক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে। রেডিও থেরাপির সাথে এইচএসভি বা ভ্যাকসিনিয়া ভাইরাস যুক্ত হলে ক্যান্সার সেল দ্রুত ধ্বংস হয় বলে পরীক্ষায় প্রমাণিত হয়েছে। এমনকি ইমিউনোথেরাপির সাথে অনকোলাইটিক ভাইরাস ব্যবহার করায় ক্যান্সার কোষ ধ্বংসের গতি বেড়েছে। এসব পরীক্ষা-নিরীক্ষা কোনটি গবেষণা পর্যায়ে, আবার অনেকগুলো ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল পর্যায়ে আছে। প্রতি ৮ জন নারীর মধ্যে ১ জনের স্তন ক্যান্সার হওয়ার আশঙ্কা থাকে। উন্নয়নশীল দেশে অল্প বয়সী নারীরা বেশি জরায়ুমুখ ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়। ফুসফুসের ক্যান্সার, কোলন ও মলদ্বারের ক্যান্সার, প্রষ্টেট ক্যান্সারের প্রাদুর্ভাব এখন অনেক। জিন প্রযুক্তির যত দ্রুত উন্নত হবে, ক্যান্সার নিরাময়ে ভাইরাসের ব্যবহারও ততবেশি ত্বরান্বিত হবে। ক্যান্সার নিরাময়ে ভাইরাসের ব্যবহার এক অপার সম্ভাবনা। এ প্রক্রিয়া যত ত্বরান্বিত হবে, মানব জাতির জন্য ততই মঙ্গল।