মিহির কান্তি মজুমদার
জনশুমারি ২০২২ এবং জনমিতিক বহুমাত্রিক পরিবর্তন
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ৪ আগস্ট,বৃহস্পতিবার,২০২২ | আপডেট: ১১:৪৯ এএম, ৫ ডিসেম্বর,বৃহস্পতিবার,২০২৪
ছবি: ফাইল
গত ২৭ জুলাই, ২০২২ তারিখে জনশুমারি ও গৃহগণনা-২২ নামে জনশুমারি, গৃহগণনা এবং ব্যক্তির জনমিতিক ও আর্থ-সামাজিক তথ্যের প্রাথমিক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। দশ বছর অন্তর পরিচালিত এ জনশুমারি-২০২১ সালে সম্পাদনের কথা ছিল। কিন্তু বৈশ্বিক করোনা মহামারীর কারণে বর্তমান বছরের ১৫-২১ জুন, ২০২২ সময়কালে এ জনশুমারীর আয়োজন করা হয়েছে। প্রাথমিক প্রতিবেদন প্রকাশের সাথে সাথে বিভিন্ন প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় এ শুমারি নিয়ে চলছে লেখা ও আলোচনা। জনশুমারী সম্পূর্ণ নির্ভুল হয়েছে কিনা, প্রতিবেদনে উল্লেখিত জনসংখ্যা সঠিক কিনা, কেউ গণনায় বাদ পড়েছে কিনা- এসব নিয়ে আলোচনা বিস্তর। মাত্র ৭ দিনে জনমিতিক বিভিন্ন তথ্যসহ জনসংখ্যার চিত্র সম্পূর্ণ নির্ভুল হবে, তা প্রত্যাশা করা যৌক্তিক নয়। শুমারিকৃত জনগণের তথ্য ডাটাবেজে আছে। কেউ বাদ পড়লে অন্তর্ভুক্তির যেমন সুযোগ আছে, তেমনি ০২ বার অন্তর্ভুক্তি হলে বাদ দেওয়ারও ব্যবস্থা আছে। এ সুযোগ রেখেই শুমারির প্রাথমিক প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে।
জনগণনায় কেউ বাদ পরতেই পারেন, যা সংশোধনের সুযোগ আছে। এটা খুব জরুরী বিষয় নয়। বরং জনমিতিক যে বহুমাত্রিক ও ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে, তা পর্যালোচনা করে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিবার পরিকল্পনা, দক্ষতা উন্নয়ন ও অন্যান্য বিষয়ে পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করাই বেশি জরুরি। প্রাথমিক প্রতিবেদন অনুযায়ী দেশের জনসংখ্যা প্রায় ১৬.৫২ কোটি যা ২০১১ এর জনসংখ্যার চেয়ে ১.১২ কোটি বেশি। গড়ে প্রতিবছর জনসংখ্যা বেড়েছে দশ লাখ। জনসংখ্যার মধ্যে পুরুষের (৮.১৭ কোটি) চেয়ে নারী জনসংখ্যা (৮.৩৩ কোটি) বেশি। দেশে এখন পুরুষের চেয়ে নারীর গড় আয়ু বেশ বেশি (৭৪.৯ বছর) এবং বিদেশে এক কোটি প্রবাসী কর্মীর মধ্যে পুরুষের সংখ্যা অনেক বেশি। কাজেই, জনশুমারির চিত্রে নারীর সংখ্যা একটু বেশি হওয়াই স্বাভাবিক।
জন্ম ও মৃত্যুর হারের ভিত্তিতে কোন অঞ্চলের জনসংখ্যার হ্রাস-বৃদ্ধি এবং জনমিতিক বৈশিষ্টে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে। এ পরিবর্তন কয়েকটি ধাপে অগ্রসর হয়। কোন জনপদে জন্ম ও মৃত্যুর হার দুটোই যদি খুব বেশি থাকে, তখন জনসংখ্যার খুব একটা হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটে না বা পরিবর্তন হয় না। যেমন- ১৮০১ সালে বাংলাদেশের এলাকায় প্রাক্কলিত জনসংখ্যা ধরা হয় ১.৪৫ কোটি, যা ১৯০১ সালে ২.৮৯ কোটিতে উন্নীত হয়। অর্থাৎ জনসংখ্যা দ্বিগুণ হতে সময় লেগেছে ১০০ বছর। এ অবস্থাকে জনমিতিক পরিবর্তনের (ডেমোগ্রাফিক ট্রানজিশন) এর পূর্ব ধাপ বলা হয়। এরপরে জনস্বাস্থ্য ও স্যানিটেশন উন্নয়ন, খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি- এসব পদক্ষেপের ফলে মৃত্যু হার হ্রাস পায়। কিন্তু জন্মহার উচ্চ থাকায় জনসংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পায়। এটাই জনমিতিক পরিবর্তনের প্রথম ধাপ। যেমন বাংলাদেশে ১৯৫১ সালে জনসংখ্যা ছিল প্রায় ৩.৭৯ কোটি। জনস্বাস্থ্য ও স্যানিটেশন উন্নয়ন, টিকা কার্যক্রম, কুমিল্লা মডেল ও খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি, রুরাল ওয়ার্কস প্রোগ্রাম এবং অন্যান্য উন্নয়ন কর্মসূচির জন্য মৃত্যু হার হ্রাস পায়। কিন্তু জন্মহার অধিক থাকায় ১৯৭১ সালে জনসংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় ৭ কোটি। অর্থাৎ জনসংখ্যা দ্বিগুণ হতে সময় লেগেছে মাত্র ২০ বছর।
জনমিতিক পরিবর্তনের এ প্রথম ধাপে জনসংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পায় এবং বর্ধিত জনসংখ্যা কৃষি উৎপাদনের জায়গা দখল করে। ফলে কৃষি উৎপাদন কমে যায় এবং দুর্ভিক্ষ, মহামারী এবং সংশ্লিষ্ট অন্যান্য কারণে আবার জনসংখ্যা হ্রাস পায়। জনমিতিক পরিবর্তনের প্রথম ধাপের এ অবস্থাকে বলা হয় মালথাসের জনসংখ্যা ফাঁদ (গধষঃযঁংরধহ চড়ঢ়ঁষধঃরড়হ ঞৎধঢ়)। প্রখ্যাত জনমিতি বিজ্ঞানী থমাস রবার্ট মালথাসের নামে জনসংখ্যা ফাঁদের নামকরণ করা হয়েছে। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে ব্যাপক জন্মনিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম, কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি, বৈদেশিক কর্মসংস্থান এবং অন্যান্য উৎপাদনশীল কর্মকান্ডের মাধ্যমে বাংলাদেশ এ জনসংখ্যা ফাঁদ এড়াতে সক্ষম হয়।
একজন মা গড়ে কতজন সন্তান জন্মদান করেন- তাকে বলা হয় টিএফআর (টোটাল ফার্টিলিটি রেট)। বাংলাদেশে ১৯৭২ সালে জন্মহার অধিক থাকায় টিএফআর ছিল ৬.৩ এবং শিশু বয়সি জনসংখ্যা (০ থেকে ১৪ বছর) ছিল ৪৫.২%। তখন ব্যাপক পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রম, শিক্ষা, নারীর ক্ষমতায়ণ, নগরায়ণ এবং অন্যান্য সামাজিক পরিবর্তনের কারণে জন্মহার কমতে থাকে। শুরু হয় জনমিতিক পরিবর্তন এর দ্বিতীয় ধাপ। বাংলাদেশে ১৯৮০ এর দশকেই এ ধাপের সূচনা ঘটে। এ ধাপে জন্মহার ও মৃত্যুহার দুটোই কমা শুরু করে। তবে এ দ্বিতীয় ধাপ খুব বেশি দিন স্থায়ী হয় না। জন্মহার ও মৃত্যুহার দ্রুত নেমে একটা স্থিতিবস্থা পর্যায়ে চলে আসে এবং শুরু হয় জনমিতিক পরিবর্তনের তৃতীয় ধাপ। এ তৃতীয় ধাপে কর্মক্ষম জনসংখ্যা যেমন বৃদ্ধি ঘটতে থাকে, তেমনি শিশু বয়সী জনসংখ্যা কমতে থাকে। এ ধাপের শেষের দিকে বয়স্ক লোকের সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পায় এবং শিশু বয়সী জনসংখ্যা কম থাকায় কর্মক্ষম লোকের ঘাটতি পুরণ হয়না। ফলে জনসংখ্যা বৃদ্ধি প্রথমে স্তিমিত হয় এবং পরে জনসংখ্যা কমতে শুরু করে। তখন দেশের উন্নয়ন প্রক্রিয়া একটুও অগ্রসর হয় না। শুরু হয় দ্বিতীয় জনমিতিক পরিবর্তনের চতুর্থ ধাপ।
জনমিতিক পরিবর্তনের এ ধাপের মধ্য দিয়েই সব দেশ অগ্রসর হয়। এ পরিবর্তন প্রক্রিয়ায় শিশু বয়সী জনসংখ্যা ধীরে ধীরে কমতে থাকে। কর্মক্ষম জনসংখ্যা বৃদ্ধি পায় ও সংখ্যাধিক্য ঘটে, যা দেশের উন্নয়নে খুবই ইতিবাচক ভূমিকা রাখে। কর্মক্ষম জনসংখ্যা বৃদ্ধি অব্যাহত থাকে না। একটা পর্যায়ে তা আবার কমতে থাকে এবং বয়স্ক জনসংখ্যার বৃদ্ধি ঘটে। এজন্য কর্মক্ষম জনসংখ্যার আধিক্য কোন দেশে শুধুমাত্র একবারই আসে। এজন্য এ ধাপকে বলা হয় ডেমোগ্রাফিক বোনাসকাল। বাংলাদেশের কর্মক্ষম জনসংখ্যার বৃদ্ধি ২০০০ সাল থেকেই দৃশ্যমান হয়। কোন দেশের কর্মক্ষম জনসংখ্যার বৃদ্ধি বা ডেমোগ্রাফিক বোনাসকাল ৩০ থেকে সর্বোচ্চ ৪০ বছরের বেশি স্থায়ী হয় না। কারণ কর্মক্ষম জনসংখ্যা বার্ধক্যে উপনীত হয় এবং উৎপাদন প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়। বয়স্ক জনসংখ্যার জন্য স্বাস্থ্য ও অন্যান্য খাতে খরচ বৃদ্ধি পায়।
জনশুমারির বর্তমান প্রতিবেদনে দেখা যায় শিশু বয়সী (০-১৪ বছর) জনসংখ্যা ২৮.৬১% তে নেমে গেছে। ২০১১ সালে এ হার ছিল ৩৪.৬৪%। বেড়েছে কর্মক্ষম জনসংখ্যা (৬৫.৫৩%)। যদিও কোন কোন সমীক্ষায় এ হার আরও বেশি বলে উল্লেখ আছে। জাতিসংঘের জনসংখ্যা বিভাগের প্রাক্কলন অনুযায়ী বাংলাদেশে শিশু বয়সী জনসংখ্যা ২০৪০ সালে ১৯.৫% এবং ২০৫০ সালে ১৭.৩% এ নেমে যাবে। তখন বয়স্ক জনগণের হার হবে ২২.৫%। কাজেই, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা কমবে, বহু স্কুল বন্ধ হবে, স্বাস্থ্য খাতে চাপ বাড়বে এবং উন্নয়ন প্রক্রিয়া ব্যাহত হবে। এসব দিক বিবেচনায় রেখেই স্বল্পমেয়াদী থেকে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিতে হবে। কারণ ডেমোগ্রাফিক বোনাসকাল হচ্ছে চায়ের কাপে বিস্কুট ভিজিয়ে খাওয়ার সামিল। পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নে একটু বিলম্ব হলে এ সুযোগ আর কখনও ফিরবে না।
জনশুমারি প্রতিবেদনে টিএফআর ২.৩ উল্লেখ করা হয়েছে। এটি ২০১১ সালে একই রূপ ছিল। তবে কোন কোন বিভাগে এটি অনেক কমে গিয়েছে। টিএফআর ২.১ থাকলেই একে রিপ্লেসমেন্ট লেভেল বলা হয়। অর্থাৎ জনসংখ্যা সেখানে বৃদ্ধি ঘটে না। বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক এন্ড হেলথ সার্ভের (বিডিএইচএস) ২০১৭-১৮ এর প্রতিবেদন অনুযায়ী এদেশে রাজশাহী ও রংপুর ডিভিশনে টিএফআর ২.১ এবং খুলনা বিভাগে ১.৯ এ নেমে গেছে। অর্থাৎ রাজশাহী ও রংপুর বিভাগে জনসংখ্যা খুব একটা বৃদ্ধি ঘটবে না। খুলনা বিভাগের জনসংখ্যা কমবে। সে বিবেচনায় এখনই পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের কর্মপদ্ধতিতে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটাতে হবে। স্বাধীনতার পরে ইউনিয়ন পর্যায়ে তিনজন পরিবার কল্যাণ সহকারী, একজন পরিদর্শক এবং একজন ফ্যামিলি ওয়েলফেয়ার ভিজিটর কাজ করছেন। এখনও তাই আছে, যার কোনো যৌক্তিকতা নেই। সিলেট বিভাগে টিএফআর ২.৬। খুলনা, রাজশাহী, রংপুর ও সিলেটের পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের তৃণমূল পর্যায়ে জনবলের চিত্র একইরূপ থাকার কোন কারণ নেই। জনবল কাঠামো, কর্মসূচি ও সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ব্যাপক পরিবর্তন জরুরী। শিশুর সংখ্যা কমছে। কাজেই, সুস্থ্য শিশুর জন্মগ্রহণের জন্য প্রসব পূর্ব, প্রসবকালীন এবং প্রসবোত্তর সেবায় ব্যাপক পরিবর্তন আনতে হবে। পরিবার কল্যাণ সহকারীদের মিডওয়াইফারি প্রশিক্ষণ প্রদান করা যৌক্তিক। অবসর ও অন্য কারণে পরিবার কল্যাণ সহকারীর পদ শূন্য হলে সেখানে মিডওয়াইফ বা নার্স নিয়োগ করার কথা বিবেচনা করা যেতে পারে।
বিডিএইচএস- এর প্রতিবেদনে জনগণের মধ্যে উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা উচ্চ হারে বৃদ্ধির তথ্য আছে। এদের মধ্যে শতকরা ৫০% জানেন না, তাদের এ রোগ আছে। যারা জানেন- তাদের একটি বড় অংশ এ রোগ নিয়ন্ত্রণে কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করেন না। ফলে হৃদরোগ, স্ট্রোক, কিডনী রোগ এবং অন্যান্য রোগে বাড়ছে মৃত্যু ও পঙ্গুত্বের সংখ্যা। বয়স্ক লোক বৃদ্ধির সাথে এ রোগের প্রকোপ আরো বাড়বে, ফলে উৎপাদনশীলতা কমবে। অথচ পাবলিক হেলথ এক্সপেন্ডিচার রিভিউ; ২০১৫ বলছে আমাদের প্রতিরোধমূলক স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ব্যয় বৃদ্ধির সুপারিশ থাকলেও তা অনেক কমে গিয়েছে। আমাদের অসংক্রামক রোগের বৃদ্ধি ঘটছে দ্রুত গতিতে। জনমিতিক পরিবর্তনের সাথে এর একটা নিবিড় সম্পর্ক আছে। কাজেই, প্রতিরোধমূলক স্বাস্থ্য ব্যবস্থার গতি বাড়াতে হবে।
কৃষি, শিক্ষা ও অন্যান্য ক্ষেত্রে উৎপাদনশীলতা বাড়াতে দক্ষতা বৃদ্ধির বিকল্প নেই। দেশের ৪ কোটির বেশি তরুণ জনগোষ্ঠী আছে। এদের দক্ষতা বৃদ্ধি করে স্ব-কর্মসংস্থান এবং দেশে বিদেশে কর্মসংস্থান বাড়াতে হবে। মোট কথা জনশুমারিতে প্রতিফলিত জনমিতিক পরিবর্তনের যে বহুমাত্রিক চিত্র উপস্থাপিত হয়েছে- সেসব দিক গুরুত্বের সাথে বিবেচনায় নিয়ে আমাদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিবার পরিকল্পনা এবং অন্যান্য খাতে কর্মসূচি, জনবল কাঠামো, বাজেট এবং অন্যান্য বিষয়ে ব্যাপক পরিবর্তন আনতে হবে। তাহলেই জনশুমারির প্রচেষ্টা সফল হবে।