জালাল উদ্দিন আহমেদ
মুক্তিযুদ্ধঃ খন্ডিত চেতনা(৭)
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ৩ আগস্ট, বুধবার,২০২২ | আপডেট: ০১:৪৯ এএম, ২৭ ডিসেম্বর,শুক্রবার,২০২৪
পূর্ব প্রকাশের পর……..
-৭-
পথ পরিক্রমায় ঘোষনা পাঠের সেই অখ্যাত মেজর (৫) একসময় রাষ্ট্র ক্ষমতার শিখরে চলে আসেন। তবে সে সময় তিনি মেজর জেনারেল এবং বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধানও বটে। তার কর্মধারার সততা ও নিষ্ঠা অপামর জনসাধারনকে উজ্জীবিত করে। দেশ গড়ার উদগ্র বাসনায় তিনি যখন গনমানুষের কাছাকাছি আসতে শুরু করলেন ঠিক তখনই স্বাধীনতা বিরোধী মহাজনেরা তাদের মাস্টার প্ল্যানের ঝাঁপি খুলে বসলেন। সরলমনা বাঙালীর মাথায় ঢুকিয়ে দেয়া হোল ধর্মীয় অনুভূতির সুড়সুড়ি। পার্শ্ববর্তী দেশের সহয়তায় ধর্ম নিরপেক্ষতার নামে দেশকে ধর্মহীন করার কাজে বিগত সরকার উঠে পড়ে লেগেছিল - এই কথাগুলি দেশের অপামর ধর্মভীরু জন সাধারনকে তারা বেশ ভালভাবেই গিলাতে পেরেছিলেন বলে মনে হয়। তাছাড়া মুসলিম সংখ্যা গরিষ্ঠ দেশকে গড়ে তোলার জন্য তাদের বিকল্প নেই - এই বেদ বাক্যটি তারা জেনারেলের মাথায় ভালভাবেই ঢুকাতে পেরেছিল বলেই মনে হয়। নইলে স্বাধীনতার চার পাঁচ বছরের মাথায় কি এমন ঘটলো যে স্বাধীনতা বিরোধীদের পুনর্বাসন করার জন্য ক্ষমতাধর জেনারেলটি তাদেরকে রাষ্ট্রীয় রাজনীতির অভয়ারন্যে প্রবেশের সনদ প্রদান করলেন। এমনকি চিহ্নিত ও বিতর্কিত কতিপয় বাংলাদেশ বিরোধী রাজনৈতিক ব্যক্তিদের নিজ দলে ভিড়িয়ে বাংলাদেশ সৃষ্ঠির মূল চেতনায় কুঠারাঘাত করলেন এই জেনারেল। অথচ সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের নিরিখে ক্ষমতার শিখরে থাকা ওই জেনারেলটিই ছিলেন বাংলার স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রথম ঘোষিত মুক্তিযোদ্ধা।
সাধারন বাঙালী ক্ষমতার পট পরিবর্তনের ফলে দ্বিতীয় অপশন হিসাবে জেনারেল জিয়ার "প্রথম বাংলাদেশ আমার শেষ বাংলাদেশ" শ্লোগানকে আপন হিসাবে গ্রহন করেছে। স্বাধীনতা ঘোষনা পাঠের সিপাহশালারের নেতৃত্ত্বে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের আদর্শে গড়ে উঠে বিএনপি নামক নতুন রাজনৈতিক দল। দেশ গড়ার চেতনায় রনাঙ্গনের প্রথম সারির উদারচেতা বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সমন্বয়ে গঠিত দলটি তাদের "থিংক ট্যাঁংকে" ও দলীয় নেতৃত্ত্বে সেইসব মানুষগুলোকে আনলেন যারা প্রকৃত অর্থেই ছিলেন স্বাধীনতা বিরোধী এবং একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে মানবতা বিরোধী কোন না কোন অপরাধে জড়িত। সুতরাং বলা যায়, স্বাধীনতার ঘোষনা পাঠের জেনারেলটির গঠিত দলটি রাজনীতির সূচনাতেই খন্ডিত চেতনার ধারক হিসাবে সাধারনে পরিচিতি লাভ করলো। রাষ্ট্র ক্ষমতা ও রাজনীতির এই মেরুকরনে স্বভাবতই দেশে দুটি পক্ষ দাঁড়িয়ে গেল। দেশে স্বপক্ষ শক্তির অখন্ড চেতনার ধারক হিসাবে লাইম লাইটে থাকা মূল শক্তিটি "বাঙালী জাতীয়তাবাদের" ঝান্ডা নিয়ে মূল চেতনার "জয় বাংলা" শ্লোগানে আবদ্ধ রইলো। অসাম্প্রদায়িক চেতনার ঝান্ডা উঁচিয়ে তারা মুক্তমনা মানুষ ও সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর মন জয় করার কাজে ব্যপৃত রইলো। পাশাপাশি বৃহৎ প্রতিবেশীর বন্ধু হিসাবে তাদের বিস্বস্ততা অর্জনে সমর্থ হোল। অপরদিকে "বাংলাদেশী জাতীয়তা বাদের" নিশান উড়িয়ে ঘোষনা পাঠের সেই মেজরের নেতৃত্ত্বে তার সহযোদ্ধা ও সাধারন ধর্মভীরু মানুষের দল "বাংলাদেশ জিন্দাবাদ" শ্লোগানে নিজেদেরকে সম্পৃক্ত করলো। তবে ফাঁক গ'লে স্বাধীনতা বিরোধীদের একটি সুবিধাবাদী চক্র জেনারেল জিয়ার সেই "প্রথম বাংলাদেশ" গড়ার তাঁবুতে ঢুকে পড়লো। ফলে বাঘা বাঘা ও শ্রেয়তর মুক্তিযোদ্ধা সমন্বয়ে গঠিত এই দলটি যাত্রাপথেই একটি প্রশ্ন বোধক চিহ্ন নিয়ে তাদের রাজনীতির হাতে খড়ি দিল। ক্রমান্বয়ে বিভিন্ন মত ও পথের লোকজনের ভিড়ে দলটি একটি জগাখিঁচুড়ি সংগঠনে পরিনত হোল। তবে দেশের অপামর ধর্মভীরু জনসাধারনের (যারা রাজনীতি বুঝেন না বা বুঝতে চান না) অকুন্ঠ সমর্থনে দলটি পায়ের নীচে মাটি পেল। ওদিকে সুযোগের সদব্যবহারে স্বাধীনতা বিরোধী সংগঠনটি তাদের পথ চলায় স্বাধীন বাংলাদেশে ক্রমশঃ প্রকাশ্য হতে থাকলো।
বাংলাদেশের রাজনীতি ও রাজপথে আবারো সেই ধর্মীয় শ্লোগান "নারায়ে তাকবির" ধ্বনিত হওয়া শুরু হোল। আর এভাবেই বাংলাদেশ ভূখন্ডে পুনরায় পাকিস্তানী ভুতের ঘাড়ে চড়ে ভারত বিরোধী রাজনীতির সূচনা হয়। এই ভারত বিরোধী ভুত অবশ্য পাকিস্তান রাষ্ট্রটির জন্মলগ্ন থেকেই অল্পবিস্তর আমাদের ঘাড়ে চেপে বসে ছিল। বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের সূচনাতেই সেই ভুত নতুন করে মাথা চাড়া দেয়ার সুযোগ পেল। পাশাপাশি বাংলাদেশ বিরোধী ম্রীয়মান পাকিস্তানী প্রেতাত্মারাও নতুন করে জেগে উঠার পথ খুঁজে পেল। আর অখন্ড চেতনায় সমৃদ্ধ বাঙালী সংস্কৃতি ও স্বত্ত্বার ধারক হিসাবে চিহ্নিত গোষ্ঠী তাদের অস্তিত্ত্ব টিকিয়ে রাখার সংগ্রামে লড়াইয়ের জন্য পুনরায় প্রস্তুত হতে থাকলো। তবে সে সময় জয় বাংলা শ্লোগানের মহারথীরা নিজেদের আখের গোছানোর মচ্ছবে যেভাবে খন্ডিত চেতনার তাঁবুতে প্রকাশ্য হলেন তাতে করে মুক্ত চিন্তার সাধারন মানুষ বিমূঢ় না হয়ে পারেন নি। সে সময় তারা বাংলাদেশী ওয়ালাদের ঘড়ে হাত রেখে নিজেদের আখের গুছিয়েছেন। পাশাপাশি বাংলাদেশী ওয়ালারা নিজেদের রাজনীতির উঠান নিরাপদ রাখতে সাংগঠনিক ভাবে শক্তপোক্ত বাঙালী ওয়ালাদের দুধে ভাতে রাখার চেষ্টা করেছেন। দেখা যায় চেতনার মূল দাবিদার পক্ষের মহারথীরা ভাল ভাল পোষ্টিং পদবী ও ব্যবসা বানিজ্য হাতিয়ে নিয়ে বেশ আরাম আয়েশেই দিন কাটিয়েছেন। পঁচাত্তরের সূচনালগ্নে শুরু হওয়া বাকশালীয় আতংক সাধারন মানুষকে অখন্ড চেতনার তাঁবু থেকে ছিটকে ফেলে দিয়েছিল। আবার পনেরোই আগষ্টের মর্মন্তুদ ঘটনার পরবর্তী সময়ে অখন্ড চেতনা ধারীদের সুবিধাবাদি আচরন সুবিধাজনক মনে না হওয়ায় দেশের সাধারন মানুষ তাদের ব্যাপারে অনেকটা নিস্পৃহ হয়ে পড়ে। আর বাংলাদেশী ওয়ালারা সেই সুযোগটি কাজে লাগিয়ে তাদের পায়ের মাটি শক্ত করার কাজে অগ্রসর হতে থাকে।
(৫) জেনারেল জিয়াকে "অখ্যাত" হিসাবে আখ্যায়িত করা কথাটি হয়তো একটি পক্ষের জন্য গাত্রদাহের ব্যাপার হতে পারে। কিন্তু মনে রাখা প্রয়োজন জন উন্মাদনার সেদিনের সেই অগ্নিঝরা উত্তাল দিনে ক্যান্টনমেন্টে থাকা ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের এই সামান্য মেজরকে কোন বাঙালী চিনতো না। কিন্তু সময়ের চাহিদায় ক্যন্টনমেন্টে থাকা জনগনের প্রতিপক্ষ সেনাবাহিনীর (তখনকার প্রেক্ষিতে) ভিতর থেকে একজন বাঙালী সৈনিক যখন নেতার নামে দেশের অপামর জনগনকে ঘোষনা পাঠের মাধ্যমে বাঙালী অস্তিত্ত্বের সলতেই আগুন জ্বালান তখন সেই মেজর আর অখ্যাত থাকেন না।
(চলমান…………..