মিহির কান্তি মজুমদার
করোনা সংক্রমণের ঢেউ নিয়ে পূনরায় সেই ওমিক্রন
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ৪ জুলাই,সোমবার,২০২২ | আপডেট: ০৬:৪৮ পিএম, ২১ ডিসেম্বর,শনিবার,২০২৪
প্রায় স্তিমিত করোনা সংক্রমণ আবারও বাড়ছে দ্রুতগতিতে। বাড়ছে মহামারীর স্থায়িত্বকাল। মারণঘাতী করোনাভাইরাসের বৈশ্বিক মহামারী চলছে আড়াই বছর। জনজীবন, অর্থনীতি, জীবিকাসহ সবকিছু প্রায় লণ্ডভণ্ড। জনজীবন যখন একটু সচল হওয়া শুরু করেছে, তখনই আছড়ে পড়েছে সংক্রমণের নতুন ঢেউ। চলতি জুলাই মাসের প্রথম ০২ দিনের সংক্রমণের সংখ্যা প্রায় ৩০০০, মৃত্যু হয়েছে ১১ জনের। যাদের মৃত্যু হয়েছে তাদের অনেকেই ০২ ডোজ টিকা নেওয়া ছিল। এ সংক্রমণ থেকে শিশুরা রেহাই পায়না। টিকা প্রহণকারীরাও সংক্রমণ ও মৃত্যু কোনটাতেই ছাড় পাচ্ছেনা। এমনকি টিকার বুস্টার ডোজ গ্রহণেও মুক্তি নেই। কারণ সংক্রমণ ঘটাচ্ছে- সংক্রমণ ক্ষমতায় সেরা সেই ওমিক্রন।
ওমিক্রন মারণঘাতী করোনা প্রজাতির ভাইরাসের ভ্যারিয়েন্ট। করোনা প্রজাতির ৪টি ভাইরাস সাধারণ সর্দি জ্বরের উপসর্গ তৈরি করে। এদের সাথে আমাদের নিত্যদিনের বসবাস। এ প্রজাতির ৫ম ভাইরাস সার্স © (SARS-Severe Acute Respiratory Syndrome), ২০০৩ সালে চীন থেকে যার সংক্রমণ শুরু। মারণঘাতী এ ভাইরাস উৎপত্তি এলাকার ৪টি দেশে ছড়িয়ে নিস্তেজ হয়েছে। করোনা প্রজাতির ৬ষ্ঠ ভাইরাস মার্স © (MERS-Middle East Respiratory Syndrome)সংক্রমণ শুরু করে ২০১২ সালে মধ্যপ্রাচ্যে। তীব্র মারণঘাতী এ ভাইরাসও ৩ বা ৪টি দেশে সংক্রমণ এবং মৃত্যু ঘটিয়ে ক্ষান্ত দেয়।
করোনা প্রজাতির ৭ম ভাইরাস সারা পৃথিবীতে চলমান বৈশি^ক মহামারীর তাণ্ডব শুরু করেছে সেই ২০১৯ সালের ডিসেম্বর থেকে। এ প্রজাতির সবক’টি ভাইরাসই শ্বাসতন্ত্র আক্রান্ত করে। এজন্য বৈশ্বিক মহামারী সৃষ্টির এ করোনা ভাইরাসের নামকরণ করা হয়েছে Severe Acute Respiratory Syndrom Corona Virous-2 নামে, সংক্ষেপে SARS-CoV-2। সহজাত কারণে এ ভাইরাস তার অবয়বে পরিবর্তন ঘটিয়ে সংক্রমণ, অসুস্থতা ও মৃত্যুর-মিছিল অব্যাহত রেখেছে শুরু থেকেই। যদিও বেশকিছু দিন ধরেই তা একটু স্তিমিত ছিল, কারণও করোনার সেই ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্ট।
বংশবিস্তার করে টিকে থাকার প্রবণতা সকল জীব ও উদ্ভিদ জগতের সহজাত প্রবৃত্তি। ভাইরাস সম্পূর্ণ প্রাণ নয়, তবে আধা-প্রাণ হলেও টিকে থাকার প্রবৃত্তিও ভাইরাসের সহজাত। জীব ও উদ্ভিদের মতো প্রচলিত পদ্ধতিতে ভাইরাস বংশবিস্তার করতে পারে না। তবে কোন দেহকোষের প্রোটিনের সংস্পর্শে এসে নিমিষেই লক্ষ লক্ষ প্রতিলিপি তৈরি করতে পারে। আর এই প্রতিলিপি তৈরির সময় সকল বাধা-বিপত্তি এড়িয়ে টিকে থাকার প্রয়োজনে ভাইরাস তার দেহাবয়বে প্রতিনিয়ত পরিবর্তন ঘটায়, যাকে বলা হয় মিউটেশন। মিউটেশনের মাধ্যমে মূল ভাইরাসের আলাদা বৈশিষ্ট্য তৈরি করে যে টিকে থাকতে সাহায্য করে, সেটি এ ভাইরাসের ভ্যারিয়েন্ট। শুরু থেকে এ পর্যন্ত করোনার বর্তমান প্রজাতির ভাইরাসে হাজার হাজার মিউটেশন হলেও ভ্যারিয়েন্ট হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে মাত্র ১২টি। যেসব ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণ বা মারণঘাতী ক্ষমতা একটু বেশি, তাদের বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ‘উদ্বেগজনক ভ্যারিয়েন্ট’ হিসেবে নাম দিয়েছে। উদ্বেগজনক ভ্যারিয়েন্ট হিসেবে খেতাব পাওয়া করোনার ভ্যারিয়েন্ট হচ্ছে আলফা, বেটা, গামা, ডেল্টা ও ওমিক্রন।
দক্ষিণ আফ্রিকায় প্রথম শনাক্ত হয় ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্ট। সংক্রমণের তীব্রতার কারণে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা শনাক্তের মাত্র দু’দিন পরেই ২৬ নভেম্বর, ২০২১ তারিখে একে ‘উদ্বেগজনক ভ্যারিয়েন্ট’ হিসেবে ঘোষণা করে। সারা বিশ্বে এ পর্যন্ত ৩৪ কোটির বেশি মানুষ করোনা আক্রান্ত হয়েছে। মৃত্যু হয়েছে ৫৫ লক্ষের বেশি। শনাক্তকৃত ১২টি ভ্যারিয়েন্টের মধ্যে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট ছিল সবচেয়ে মারণঘাতী। বেশিরভাগ মৃত্যুর জন্য এ ডেল্টাই দায়ী। কিন্তু তীব্র সংক্রমণ ক্ষমতার কারণে ওমিক্রন মাত্র ১ থেকে ২ মাসের ব্যবধানে ডেল্টাসহ সকল ভ্যারিয়েন্টকে করেছে দেশ ছাড়া। চর দখলের মতো ওমিক্রন সব দখলে নিয়েছে। বেঁচে থাকার সংগ্রামে শক্তিধররাই টিকে থাকে, দুর্বলেরা নয়। কম মারণঘাতী হলেও টিকে থাকার সংগ্রামে ওমিক্রন অনেক শক্তিশালী। ওমিক্রন দেহাবয়বে (জেনোম) যেমন ৫০টির বেশি মিউটেশন ঘটিয়েছে, তেমনি গায়ের কাঁটা বা স্পাইকে মিউটেশনের সংখ্যা বাড়িয়েছে ২৬ থেকে ৩২টি। স্পাইকের যে অংশ দেহকোষে আটকে থেকে লক্ষ লক্ষ প্রতিলিপি তৈরি করে, সে সংযোগ অংশেও মিউটেশনের সংখ্যা ১৫-এর অধিক। কাজেই অন্য ভ্যারিয়েন্টের চেয়ে দেহকোষে আটকে থাকার ক্ষমতা ওমিক্রনের অনেক বেশি হওয়ায় ডেল্টাসহ অন্য ভ্যারিয়েন্ট টিকে থাকতে পারেনি। এ কারণে ওমিক্রনকে অতি মন্দের মধ্যে একটু আশার আলো বলে মনে করা হয়েছিল।
হংকং বিশ^বিদ্যালয়ের গবেষণা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে- ওমিক্রন সংক্রমিত ব্যক্তির শ^াসতন্ত্রে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের চেয়ে ৭০ গুণ দ্রুত প্রতিলিপি তৈরি হয়। অপরদিকে, এ ভ্যারিয়েন্ট ফুসফুস সংক্রমণ করে ১০ গুণ কম। ফুসফুস খুব একটা আক্রান্ত না হওয়ায় ওমিক্রন সংক্রমণে হাসপাতালে ভর্তি এবং মৃত্যুর হার কমেছে দৃশ্যমানভাবে। ইতোমধ্যে টিকার ২টি ডোজ ও বুস্টার ডোজ গ্রহণকারীর সংখ্যা বৃদ্ধি ঘটেছে। টিকার ন্যায় ভাইরাসের সংক্রমণও শরীরে অ্যান্টিবডি বা রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা তৈরি করে। এভাবে করোনা সংক্রমণও রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা বৃদ্ধি করছে। টিকা এবং ভাইরাস সংক্রমণজনিত যৌথ রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা তাই বাড়ছে প্রতিদিন। জনজীবন আবার সচল হয়েছে। বৈশি^ক মহামারীর সংক্রমণ ও আতঙ্ক দুটোই কমেছে একই গতিতে। কিন্তু ওমিক্রন সংক্রমণের নতুন ঢেউ আবার দিগন্তে আশঙ্কার মেঘ সৃষ্টি করছে।
মহামারীর সংক্রমণ যখন একটু কমেেেছ, তখন তীব্র সংক্রমণ ক্ষমতার ওমিক্রন কিন্তু বসে ছিলনা। টিকে থাকার জন্য মিউটেশনের মাধ্যমে সাব-ভ্যারিয়েন্ট সৃষ্টি করেছে। প্রথমে সাব-ভ্যারিয়েন্ট বিএ-১ দিয়ে সংক্রমণ শুরু করেছিল। সংক্রমণ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে সাব-ভ্যারিয়েন্ট বিএ-২ সারা পৃথিবীতে ছড়িয়েছে। শিশু, তরুণ, মধ্যবয়সী, বৃদ্ধ কাউকে ছাড় দেয়নি। টিকা গ্রহণ করা থাকলেও তা এড়িয়ে সংক্রমণের ক্ষমতা শুরু থেকেই ওমিক্রনের ছিল। এখন তা বৃদ্ধি পেয়েছে নতুন নতুন সাব-ভ্যারিয়েন্ট সৃষ্টির মাধ্যমে। সাব-ভ্যারিয়েন্ট বিএ-৩ তৈরি হলেও সংক্রমণ ক্ষমতা কম হওয়ায় হারিয়ে গেছে। সংক্রমণ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে সাব-ভ্যারিয়েন্ট বিএ-২ এখন বিএ-৪ ও বিএ-৫ নামের দুটো সাব-ভ্যারিয়েন্টকে কোন কোন ক্ষেত্রে সাথে নিয়ে আবার দ্রুতগতিতে সংক্রমণের ঢেউ সৃষ্টি করেছে দেশে দেশে। এ দেশেও সংক্রমণ বাড়ছে প্রতিদিন। তবে ফুসফুসে সংক্রমণের তীব্রতা কম থাকায় হাসপাতালে ভর্তি, অক্সিজেন সাপোর্ট এবং মৃত্যু কমেছে। শুরু থেকেই ওমিক্রন বিএ-৪ ও বিএ-৫ নামে ২টি সাব-ভ্যারিয়েন্ট নিয়ে শঙ্কা ছিল অনেক। কারণ এ সাব-ভ্যারিয়েন্ট যে কোন সময় খুব মারণঘাতী হতে পারে। বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থা সে কারণে গত এপ্রিল, ২০২২ মাস থেকে এ দুটি সাব-ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণ নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করছে। টোকিও বিশ^বিদ্যালয়ের গবেষকদল সতর্ক করে বলেছে যে, ওমিক্রনের সাব-ভ্যারিয়েন্ট বিএ-৪ ও বিএ-৫ ফুসফুসে মারাত্মক সংক্রমণ করতে পারে। কাজেই এ সাব-ভ্যারিয়েন্ট তীব্রতা নিয়ে ফুসফুস সংক্রমণ শুরু করলে বৈশি^ক মহামারী আবার চরম আকার ধারণ করতে পারে। তবে টিকা ও সংক্রমণজনিত যৌথ রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাওয়ায় করোনার এ বৈশি^ক মহামারী ধীরে ধীরে স্তিমিত হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।
করোনা ভাইরাসের কোন প্রজাতি থেকেই সম্পূর্ণ মুক্তির সম্ভাবনা অদূর ভবিষ্যতে নেই। এসব ভাইরাসের মধ্যেই আমাদের বসবাস করতে হবে। মানুষের মধ্যে রোগ সৃষ্টি করে এমন ভাইরাসের মধ্যে শুধুমাত্র একটি ভাইরাস পৃথিবী থেকে নির্মূল হয়েছে। এটি হচ্ছে গুটি বসন্তের ভেরিওলা ভাইরাস। অন্য সব ভাইরাস আছে। কোনটি সুপ্ত অবস্থায়, কোনটি সর্দি-কাশি সৃষ্টি করে এমন দুর্বল অবস্থায়। কোনটি আবার একটু মারণঘাতী অবস্থায়। ওমিক্রন বা তার সাব-ভ্যারিয়েন্ট বা করোনা প্রজাতির নতুন কোন ভ্যারিয়েন্ট তৈরি হলে তা প্রতিরোধ করেই আমাদের এগিয়ে চলতে হবে। ততদিন টিকা নেওয়া, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা, সাবান বা সেনিটাইজার দিয়ে ঘন ঘন হাত ধোয়া, মাস্ক ব্যবহার করা- এসব প্রতিরোধ ব্যবস্থা অনুসরণ করতে হবে। রোগের তীব্রতা একটু কমলেও খুব তাড়াতাড়ি এসব পরিত্যাগ করার সুযোগ নেই।
-------------------------------------------------------------------
ড. মিহির কান্তি মজুমদার, সাবেক সচিব।