জালাল উদ্দিন আহমেদ
মুক্তিযুদ্ধঃ খন্ডিত চেতনা(৪)
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ২৫ জুন,শনিবার,২০২২ | আপডেট: ১১:০৯ এএম, ২৫ ডিসেম্বর, বুধবার,২০২৪
ভাষা আন্দোলন, যুক্তফ্রন্ট, মার্শাল ল, ছয় দফা, আগরতলা ষড়যন্ত্র, গন অভ্যুত্থান ইত্যাদির মিশেলে বাঙালীর নতুন করে বাঁচার তাগিদ অনুভূত হোল। সেই সুযোগে সুযোগ সন্ধানী বন্ধুবেশী প্রতিবেশীরা তাদের ইচ্ছে পুরনের প্যাডেলের গতি আরো বাড়িয়ে দেয়। প্রকৃত চিত্রে এতদাঞ্চলে বামপন্থি ঘরানার বুদ্ধিজীবিদের আধিক্য লক্ষ্য করা যায়। সময়ের চাহিদায় তখন তারা নিজেদের প্রকাশ করার মহেন্দ্রক্ষনটি পেয়ে গেলেন। এসব বামপন্থিরা দেশীয় সীমারেখাকে ধর্তব্যে না নিয়ে সর্বক্ষেত্রে সামাজিক সুষম বন্টন ব্যবস্থায় আন্তর্জাতিকতা বাদকে বেশী গুরুত্ব দেন। বিভিন্ন নামে সেমিনার ওয়ার্কশপ ইত্যাদি এবং ম্যাগাজিন ও দৈনিক পত্রিকায় প্রবন্ধ নিবন্ধ লিখে পাকিস্তান আন্দোলনের ভষ্মে ঘি ঢালা শুরু করেন। এতে করে বাঙালী জাতীয়তা বাদের জাগরনের মোড়ক উন্মোচনে উঁমি চাঁদদের বেশী বেগ পেতে হয়নি। তবে নির্বাচন, আন্দোলন ইত্যাদি সবকিছুই পাকিস্তান রাষ্ট্রের ফ্রেম ওয়ার্কের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল।
এক্ষেত্রে রাষ্ট্র কাঠামোর বিরোধিতা করে ঘোষনার মাধ্যমে নিজস্ব কায়দায় কোন অহিংস বা সহিংস আন্দোলন হয়নি। পাকিস্তান রাষ্ট্রের কাঠামোর মধ্যেই বাঙালী তার "জয় বাংলা" শ্লোগান নিয়ে সমবন্টন, সম অধিকার এবং অসাম্প্রদায়িক চেতনার আন্দোলনে এগিয়ে গেছে।
এল সত্তরের নির্বাচন। পাকিস্তান আন্দোলনের বনেদীরা ততদিনে সাধারন বাঙালীর ভালবাসার তলানীতে নখ দন্তবিহীন ব্যাঘ্রের ভূমিকায় সমাজে অপাংতেয় হয়ে বিচরন করছেন। তবুও তাদের মাথার জিন্নাহ ক্যাপ এবং গায়ের শেরওয়ানী হাজার মাইল দূরের পাকিস্তানী শৈর শাসকদের কাছে খুব আপন বলেই মনে হয়েছে। ফলে গনতন্ত্রের সূচনালগ্নে সত্তরের সাধারন নির্বাচন যখন ম্যান্ডেট হয়ে বাঙালী রাজের করতলে সমর্পিত হোল তখনই দুই পারের কতিপয় কৌটিল্যের পরামর্শে মাথামোটা যুদ্ধবাজ জেনারেলটি হুংকার দিয়ে উঠলো। নির্বাচনোত্তর দুটি মাসে পুর্ব পশ্চিম এবং বাঙালী অবাঙালী বিভাজনের লক্ষ্মন রেখাটি সমাজ রাষ্ট্র তথা বিশ্বে প্রকট ভাবে প্রকাশ হতে থাকলো। সে সময় ধর্মীয় স্বত্ত্বায় একাট্টা হওয়ার সেই পাকিস্তানী দাওয়াই বাঙালী-অবাঙালী জাতি স্বত্ত্বার তোড়ে ম্লান হয়ে গেল। যে অবাঙালী মোহাজের মুসলমানগন "লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান" ধ্বনি অরকম্পিত করে একদিন এই বাংলার বুকে বাঙালীর আপনজন হয়ে তাঁবু গেঁড়েছিল, সেই তারাই তখন পশ্চিমা মোড়লদের টোপে নিজেদের খাঁটি পাকিস্তানী প্রমানে প্রকাশ্য হলো। তাছাড়া এদেশীয় জামাত ও মুসলিম লীগ ঘরানার প্রেতাত্মারা তো চাঁদ তারার পতাকা নিয়ে আগে থেকেই প্রস্তুত ছিল। এমতাবস্থায় আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত পৃথিবীর চৌকস সেনাবাহিনীর মাথামোটা জেনারেলটি দেশের সর্বোচ্চ আধিকারিকের ছড়ি হাতে পাকিস্তান রাষ্ট্রটির কফিনে শেষ পেরেকটি ঠুকে দিলেন।
অস্ত্রের মাধ্যমে বাঙালীদের শায়েস্তা করার মূল মন্ত্রটি এসেছিল সাধারন নির্বাচনে পরাজিত মুসলিম লীগ ও জামাত নির্ভর পুর্ব-পশ্চিমের কতিপয় জনবিচ্ছিন্ন উঁচুতলার মানুষের কাছ থেকে। তাছাড়া পশ্চিম পাকিস্তানের ম্যান্ডেট পাওয়া নতুন মোড়ল জুলফিকার আলী ভুট্টোর উস্কানীও এই গনহত্যা সংঘটনের একটি মূল কারন বলে ধরে নেয়া যায়৷ বৃটিশ রাজের হাত হতে মুক্ত হওয়া অখন্ড ভারত হতে সৃষ্ট ধর্ম ভিত্তিক পাকিস্তান রাষ্ট্রটির সূচনা লগ্ন হতেই তার মুল চাবিকাঠি ছিল ঊর্দিপিরা পাঞ্জাবী জেনারেল আর জনবিচ্ছিন্ন উপরতলার কতিপয় চৌধুরী ও সৈয়দ সাহেবদের হাতে। সাধারন মানুষের চাহিদার ন্যুনতম আওয়াজ পাকিস্তান রাষ্ট্রটির এইসব শাসক কখনোই শুনতে পাননি বা শুনার চেষ্টাও করেননি। ফলে ইতিহাসের নির্মম কঠোরতায় বাংলাদেশ নামক নতুন রাষ্ট্রের সূচনা হলো। ( চলমান)