জালাল উদ্দিন আহমেদ
সোশ্যাল মিডিয়ায় রাজনীতি
প্রকাশ: ১১:১০ পিএম, ১৬ অক্টোবর,শুক্রবার,২০২০ | আপডেট: ০৬:৩৫ পিএম, ২১ ডিসেম্বর,শনিবার,২০২৪
চারিদিকে গেল গেল রব। সব বুঝি শেষ হয়ে গেল। রাজা গেল, রাজ্য গেল, প্রজারাও ধুকে ধুকে শেষের পথে। এটা বোধ হয় আগেও ছিল। তবে ইদানীংকার সোশ্যাল মিডিয়া বড়ই ঠোঁটকাটা। ক্ষেত্র বিশেষে নির্লজ্জও বটে। কোন এক এক্স কিংবা স্বনামধন্য অমুক তমুক সাহেবরা তাদের নিজেদের পোর্ট্যালে সাংবাদিক সেজে যেভাবে সপ্তাহের সাতদিনই ক্ষমতার সংস্কৃতির পিন্ডি চট্কাচ্ছেন তাতে মনে হচ্ছে আগামীকালই বোধ হয় আমরা নতুন সকাল দেখবো। যেভাবে যদু মধু কদুদের মত অখ্যাত মানুষজনের সাক্ষাৎকার নিয়ে তাদের ওয়েব পোর্টালে ছাড়ছেন তাতে মনে হচ্ছে সত্যিকার অর্থেই এক মহামারীর কবলে গোটা বাঙালী জাতি। ইদানীং আবার উত্তর পাড়ার লোকজনও বেশ নেতা নেতা ভাব নিয়ে যেভাবে জাগরনের কথা বলেন তাতে মনে হয় যেন টেলিভিশনটা খুলেই রাখি। বলা তো যায় না - কড়া নাড়ার শব্দ বুঝি এসেই গেল! আরে বাবা, আপনারা তো খাঁচার পোষাকী মানব। আপনারা কেন কাদা-মাটির গন্ধ শুক্তে চান। আর যদি ওই খায়েস থেকেই থাকে তবে পদবী ছেড়ে মাটিতে নামুন। মাটি ও মানুষের কথা আগে বুঝুন। তারপরে না হয় কিছু বলুন। আসুন জনতার কাতারে। দাঁড়ান প্রেস ক্লাবের সামনে। নেতা হয়ে কলার উঁচু করে না দাঁড়িয়ে সাধারন মানুষ হিসাবে দাঁড়ান তো দেখি! বড় বড় কমান্ডিং ভয়েস দিচ্ছেন সূদুর আমেরিকা ইংল্যান্ডের সুউচ্চ দালানের তিরিশ তলা বিল্ডিংযের এসি রূমে বসে। এতই যদি জোশ, দেশপ্রেম, তাহলে আসুন না আমার ঢাকার গলিপথে কিংবা গ্রাম বাংলার মেঠোপথে। ঘরে ঘরে বাতি জ্বালান। পাড়ায় মহল্লায় মাইকিং করুন। সেটাও যদি না পারেন তবে লিফলেট ছাপান। পাড়ায় মহল্লায় দাঁড়িয়ে বিলি করুন আপনার সেইসব মূল্যবান কথা যা ভিডিও করে ভাইর্যাল করছেন। একজন কর্নেলকে তো দেখি চাকুরি চ্যুতির ক্ষোভে উনি বিষদ্গার ছড়াচ্ছেন সামরিক বাহিনীর শৃংখলার আতুড় ঘরে। ব্যক্তি জিঘাংষার বিষ উদ্গীরণ করে আপনারা কেন গোটা সেনাবাহিনীর শৃংখলায় বিশৃঙ্খলা আনার অপপ্রয়াস চালাচ্ছেন!
জ্বলে পুড়ে মরছি আমরা। আর আপনারা ঘি ঢালছেন ইংল্যান্ডের ব্রুকলিনে কিংবা নিউইয়ার্কের ম্যানহাটনে বসে। তা কি কখনও হয়! আপনাদের এই ভিডিও ভাইর্যালে সাত মন ঘিও পুড়বে না রাধাও নাচবে না। একজন তো উত্তরাধিকারের সুবিধাভোগে গত পনের বছর ধরে লুটেরা ক্লাইভের দেশে সুউচ্চ অট্টালিকায় বসে তার জাতীয়তাবোধের ওয়াজ নসিহত করেই চলেছেন। আরে ভাই, কিছু পেতে গেলে কিছু তো বিনিয়োগ করতে হয়। তবেই না ফুলে ফলে ডালি সাজাতে পারবেন। যে ডালি সাজিয়ে মহান সেনাপতি তাঁর গ্রহন যোগ্যতার শীর্ষে পৌঁছেছিলেন তার ধারে কাছেও কি আপনারা আছেন? সেনাপতির ভাঙ্গা স্যুটকেস আর ছেঁড়া গেঞ্জি দিয়ে তো অনেক হোল। আর কত! দেখুন তো আজকের ডাইনেষ্টির দিকে তাকিয়ে! কি সুন্দর সাজানো গুছানো বাগান তৈরী করে আস্তে ধীরে সমস্ত শাখা প্রশাখায় ফুলে ফলে ভরে উঠছে সেই ঘরানা। আছে কি আপনার পরম্পরায় এইসব ঐতিহ্য! কোন্ পরিকল্পনায় এগোচ্ছেন আপনার ডাইনেষ্টির ভীত তৈরীতে! আর মালয়েশিয়া বলুন, কানাডাই বলুন কিংবা আমেরিকা ইংল্যান্ড যাই বলুন না কেন, নিজ মাটিতে বীজ বপন না করে , চারা গাছের যত্ন না নিয়েই আপনারা ফুল ফলের স্বপ্ন দেখছেন। সেটা কিভাবে সম্ভব! আপনারা যা বলছেন বা যেটার জন্য বাংলার মানুষের জন্য ফাইভ স্টারের এসিতে বসে বুক চাপড়াচ্ছেন তা যদি সত্যিই হয় তবে তার প্রমান করা বা উপস্থাপনে শরীক হওয়ার জন্য বেড়ে উঠা বাগানের প্রয়োজন। সে স্পেস কি আপনাদের আছে? আপনারা গাছ না লাগিয়ে ফল খেতে চান। ফল ধরবে কোথায়? কোথায় আপনাদের তৃণমূল? ওহ্! আপনারা তো আবার উত্তর পাড়ার দিকেও মাঝে মধ্যে তাকিয়ে থাকেন। তায় না! সেটা কি করে সম্ভব এই ডিজিট্যাল অবাধ প্রবাহের যুগে। ভেবেছেন কি কখনও, একজন বুকফাঁড়া অসুস্থ্য কাব্যগীতির মানুষ যখন সাজানো গুছানো ড্রয়িং রূমে মুখে মাস্ক লাগিয়ে ক্যামেরার সামনে বসে তার কাব্যরীতির ভাষায় মহামারীর এই দিনেও মহামারী দুর্যোগের কথায় জোর না দিয়ে আপনাদের পিন্ডি চট্কান তখন কি মনে হয়না কত সাংগঠনিক শক্তি থাকলে এত জোরে তিনি এসব কথা বলতে পারেন। বুঝতে হবে কত ওজন নিয়ে ওসব কথাগুলো তারা বলেন। কারন তাদের সেসব কথা যখন সব মহল থেকে মূল্যায়ন করা হয় তখন বুঝতে হবে গতি ওদিকেই প্রবাহিত। হয়তো বলবেন ক্ষমতার জোরে তারা ওসব করছে বা করাচ্ছে। তো মশাইরা! সে ক্ষমতায় তো একদিন আপনারাও ছিলেন। আপনাদের চেহারাও তো তখন এরকমই ছিল। তারপরেও তো লগি-বৈঠার তোপে সব ঠান্ডা হয়ে গেলেন। কেন, আপনাদের লগি-বৈঠা নেই ? ঠিক আছে! আপনারা ভদ্রলোকের দল! তাহলে ভদ্রলোক হয়েই আসুন না রাজপথে। শুদ্ধাচারের যেটুকু আছে আপনাদের মাঝে- তাই নিয়ে জনগনের কাতারে আসুন। একজন মিলন জেহাদ নুর মোহাম্মদ বা বসুনিয়াদেরকে নিয়ে আর কত। গত পঞ্চাশ বছরের রাজনীতিতে এভাবে বহু নুর মোহাম্মদ, বসুনিয়াদের বড়শিতে গেঁথে রাজনীতির ফসল ঘরে তুলেছেন। এখন এই মিলন জেহাদরা আর টোঁপ খায় না, এইতো? ঘাটে চার ফেলুন। নতুন করে চার বানান। বস্তাপচা পুরনো চার খেতে খেতে মাছের মুখে ঘা হয়ে গেছে। নতুন স্বাদে নতুন গন্ধে রাজনীতির মঞ্চ সাজান। আমরা প্রস্তুত হয়ে আছি। তবে মাঠে নামলে মাঠের সাইজ দেখেই নামুন। সেই সাতচল্লিশ থেকে একাত্তর। সে সময়কার মাছের টোপে ভিন্নতা ছিল। আবার বাহাত্তর থেকে এ অব্দি এত ভ্যারাইটির টোপ আমাদের খাইয়েছেন যে আমরা এখন চার ও টোপ খাওয়ার অপটিমাম অবস্থানেও নেই। এখন কোন টোপই আর খেতে ভাল লাগে না। সুতরাং আদল বদলান। মেহেরবানী করে আমাদের আর ভড়কাবেন না। আমরা বড় অসহায়ের মত খাঁচায় বন্দি সাদা ইঁদুরের দল হয়ে ঘুরপাক খাচ্ছি। যারা মাথার উপর আছেন তাদের অন্ন যোগানে আমরা ফোকলা হয়ে গেছি। আর নতুন করে এসে আমাদের অস্থি-চর্ম যেটুকু আছে তা শেষ করার খেলায় মাতবেন না প্লিজ।
আপনারা তো দুটি পক্ষ। চ্যালেঞ্জ দেয়ার মত আর কি কেউ আছে? মধ্যেখানে লেজেহোমোর একটি পক্ষ দাঁড়িয়েছিল ঠিকই কিন্তু বুনিয়াদি খুঁত থাকায় তাও বিলীন হওয়ার পথে। আর ধর্মীয় অনুভূতির সুড়সুড়ি দিয়ে যারা সাধারণ আনপাড় বাঙালীদের এতদিন ভড়কেছে তাদের পায়েও আজকে মাটি নেই। অবশিষ্ট যে কয়েকটি পকেট যুগ যুগ ধরে লাল নীল পতাকার ঝান্ডা নিয়ে রাজপথ গরম করে রাখে তারা ওরকমই। তারা আপনাদের ক্ষমতার শরীকানায় ভাগ বসানোর অবস্থানে আগেও ছিল না এখনও নেই এবং ভবিষ্যতে আসতে পারবে বলে মনে হয় না। সুতরাং আপনারা উত্তরাধিকারের দুই খুঁটি যখন দাঁড়িয়েই গেছেন তখন ভাল করেই না হয় দাঁড়ান। আমরা তো আছি। এখনও আপনাদের মহান পিতৃপুরুষের অহংবোধে আমরাও শরীক। তবে যেভাবে সেরাদের সের দরে আপনারা বেচাকেনা করছেন কবে না সেটাও একদিন সিকি আনা পাই হয়ে যায় সেই আশংকায় আমরাও আছি। মনে রাখবেন বাঙালী বুঝে বেশী কিন্তু করে কম। আর যখন করে তখন আপনাদের এই বুঝা আর বুঝানোর আত্মশ্লাঘায় আপনারাও যেমন পুড়বেন তেমনি গোটা বাঙালীর উঠানে আহাজারির ঝড় উঠবে। সুতরাং সময় অল্প। সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়ে সামনে আসুন। এবং বাংলার মাটি ও মানুষের সাথে সখ্যতা করুন। খামোখা সোশ্যাল মিডিয়ায় উল্টাসিধা বা এলোমেলো কথার ডালি সাজিয়ে সাধারনে বিভ্রান্তি ছড়িয়ে কি হবে? সামনে আসুন। আপনাদের মহা মূল্যবান কথগুলো অখ্যাত যাকে তাকে দিয়ে না বলিয়ে সামনে যারা আছেন তাদেরকে দিয়ে বাংলার মাটিতে দাঁড়িয়ে ওসব বলুন। আমরা শুনি। সম্পৃক্ত হই। তারপরে না হয় বুঝা যাবে আমরাই বা কারা আর আপনারাই বা কারা। সত্যিই আজ বাংলার মানুষ দম বন্ধ হওয়া অস্বস্তি ও অসুবিধায় আছে।
রাজনীতির অন্ন যোগানে আজ বাঙালী হা-অন্ন। রাজনীতি করে আপনারা বনেদি হতে চান? আর হয়েছেনও তো! আজকের দিনে তরুন-যুবারা লেখাপড়া করে জজ ব্যারিস্টার হতে চায়না। কিংবা ব্যবসায়ীর ছেলে ব্যবসায় মনোযোগ দেয়না। সবাই রাজনীতি করতে চায়। বিনা বিনিয়োগে বনেদি হওয়া যায়। সমাজের মোড়ল হওয়া যায়। তাইতো আজ কিশোর ছেলেটি পড়ার টেবিলে না বসে জনপদে টিন এজার ভাই হয়ে বড় হয়। এই ভাইয়েরা দাদাগিরি করতে করতে একসময় রাজনীতির দাদা হয়ে উঠে। আর রাজনীতির বনেদি ধারকেরা এদেরকে দিয়েই তাদের ক্ষমতার চেয়ার পাওয়ার রাজনীতিকে এভাবে পোক্ত করেন। এভাবে আর কতদিন? কেন আমরা ঐতিহ্যের ডালি সাজিয়ে বসতে চাই না! আমরা কি দেখতে পাই না সেই ছেলেটিকে। অজগ্রাম কোটালী পাড়ার সেই ছেলেটির বেড়ে উঠা এবং তার মুজিব ভাই হয়ে উঠার চিত্রগুলি কি আমাদের অচেনা? ভাবতে অবাক লাগে, সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালী হয়ে যিনি আজ আমাদের বাঙালী জাতির পিতা - আমরা কি সেই মহাপুরুষের উত্তরাধিকারী! আমরা কি সেই মানুষটির উত্তর পুরুষ নই যিনি অবিভক্ত বাংলার প্রথম প্রধানমন্ত্রী হয়ে বৃটিশ ভারতকে তাক লাগিয়ে বাঙালীর মুখকে উজ্জ্বল করেছিলেন। সেই শেরে বাংলা একে ফজলুল হককে কি আমরা ভুলে গেছি! সুতরাং গেল গেল রব যেমন আমরা শুনতে চাই না তেমনি আছি থাকবো করে এভাবে বাঙালীর অস্তিত্বে আর কুঠারাঘাত না করে সোহরোওয়ার্দী-শেরে বাংলা-ভাসানী-মুজিবদের প্রকৃত উত্তরাধিকারী হয়ে সামনে আসুন।
সোশ্যাল মিডিয়া আজ রাজনীতির উন্নাসিকতার আতঁড় ঘরে ঠাঁই নিয়েছে। ক’দিন আগেও এটা প্রেস মিট বা টেলিপ্যাথিক উপায়ে সেরে ফেলা হোত। আজকের দিনে এখন ভিডিও করে বেশ চটকদার ভাবেই উপস্থাপন করা হচ্ছে। এর একটা ইম্প্যাক্ট অবশ্যই আছে। গত নির্বাচনের আগের কয়েকটি নির্বাচনে এসবের দাপট আমরা দেখেছিলাম। তখন অবশ্য সোশ্যাল মিডিয়ার এত আনাগোনা ছিল না। তায় রাজনীতির পক্ষ গুলো টেলিভিশন ভাড়া নিয়ে মার্জিত বিন্যাসে এসবের ভাইরাল করতেন। কিন্তু সময় পাল্টেছে। এখন আর ভিডিও ভাইরাল করে বা গুজব ছড়িয়ে বাঙালীকে বিভ্রান্ত করা যাবে না।* ঘাটে নতুন চার ফেলুন। পুরনো চারে অরূচি ধরে গেছে। ওই যে বললাম- ফোকলা হয়ে এখন অস্থি চর্মসার হয়ে কোন রকমে আমরা দাঁড়িয়ে আছি। সুতরাং ওটুকু নিয়েই আমাদেরকে থাকতে দিন। আমরা মন্দের ভাল আছি।
জনগনের ভোটাধিকার নিশ্চিত না করতে পারলে এই কথার কোন মূল্য আছে কি?