জালাল উদ্দিন আহমেদ
সবুজের প্রত্যাশায়
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ২২ ফেব্রুয়ারী,মঙ্গলবার,২০২২ | আপডেট: ০৬:৩৮ এএম, ১৯ ডিসেম্বর,বৃহস্পতিবার,২০২৪
কে যেন বলেছেন, নির্বাচন কমিশন আইনটি সেই পঁচাত্তর সালের বাকশাল আইন পাশ করার স্টাইলেই সম্পন্ন করা হোল। সম্ভবতঃ তিনি বলতে চেয়েছেন, পঁচাত্তর সালে যেভাবে তড়িঘড়ি করে একতরফা ভাবে ঐ বাকশাল আইন পাশ হয়েছিল, এবারকার নির্বাচন কমিশন আইন প্রণয়ন ও পাশের প্রক্রিয়াটিও সেই একই আদলেই সম্পন্ন করা হয়েছে। এটি নিঃসন্দেহে রাজনীতির কথা। সেই পঁচাত্তর সালে রাজনীতির কোন্ আঙ্গিকে সেদিনের সেই চতুর্থ সংশোধনী জুড়ে দিয়ে সংবিধানের ব্যবচ্ছেদ করা হয়েছিল তা এখনকার তরুন যুবারা যেমন জানে না, তেমনি আজকের এই সময়ের হিংসা প্রতিহিংসার রাজনীতি--গনতন্ত্র- নির্বাচন ইত্যাদি নিয়ে তাদের কোন আগ্রহ আছে বলে মনে করার কোন কারনও দেখি না। তারা জানে না নির্বাচন আইনটি কি এবং কেন। কেন নির্বাচন হয়, নির্বাচনের ভালো মন্দের যেকোন হিসাবই তাদের কাছে ধোঁয়াশায় আচ্ছন্ন।
সত্যি কথা বলতে কি, হাল আমলের রাজনীতি গনতন্ত্র নির্বাচন নামক এসব হেডলাইন বা কার্যধারার কোনটিই এখনকার দিনের তরুন যুবাদের আকর্ষিত করে না। এখনকার দিনে তরুন যুবারা একজন শেখ মুজিব, একজন ভাসানী, শেরে বাংলা বা রাজ্জাক তোফায়েল কিংবা নিদেন পক্ষে দাদাভাই সিরাজুল আলম খান হতে চায় না। কারন অবশ্য বহুবিধ। তবে মূল কারন যেটা দিব্য চক্ষু দিয়ে দৃশ্যমান হয় সেটা হোল মাঠ। অর্থাৎ মাঠ বা উঠান কোথায়? একবিংশের এই ডিজিট্যাল বাংলাদেশের মাঠে ঘাটে রাজনীতি করার স্বচ্ছ্ব উঠান কি কোথাও আছে? যে স্বচ্ছ্ব উঠানে রাজনীতির আদর্শ লিপি পাঠ করে যাটের দশক থেকে আমাদের তরুন যুবারা বুকটান নিঃশ্বাসে মাথা উঁচু করে বাহান্ন ঊনসত্তর করে নিজস্ব স্বত্ত্বা তৈরীতে রাজনীতির অপরিহার্য উপাদান হয়েছে, সেই রাজনীতির নৈতিক ও আদর্শগত অবস্থান কি আজকের স্বাধীন স্বত্ত্বার নিজ ভূমিতে বিদ্যমান আছে?
পরাধীন বাংলার রাজনীতিতে ছিল ঠাঁসা কয়েক স্তর বিশিষ্ট উঠান। যে উঠানের রাজনৈতিক সামগ্রিকতায় ছাত্র, যুবা, কৃষক শ্রমিক এবং নীতি নির্ধারনীর মূল ঘরানায় ছিল আপামর জন সাধারনের আশা আকাঙ্ক্ষার মুল প্রতিপাদ্য। চারিত্রিক দৃঢ়তা ও নৈতিকতার বিচ্ছুরনে রাজনীতির মানুষগুলো ছিলেন বাঙালীর আঁধার ঘরে এক একটি জ্বলন্ত মোমের বাতি। কিন্তু সেই মোমবাতি জ্বালিয়েই যখন তারা স্বাধীন সার্বভৌম নিজ উঠানে মুক্ত নিঃশ্বাসে এগোতে চাইলো তখন তাদের পরিচিত সেই আপন মুখগুলো ততদিনে শাসক হয়ে রাজনীতির অন্তোষ্টিক্রিয়ার মচ্ছ্ববে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। এবং আস্তে ধীরে বাঙালী ভূখন্ডের সেইসব ঘরের ছেলেরা বনেদীয়ানার মোড়কে আভিজাত্যের খোলস তৈরী করে শাসক বনে গেল। অগ্নিগর্ভ দিনগুলি অতিক্রম করে বাঙালী যখন আপন উঠানে নিজের মত করে হাঁটতে চাইলো, তখন তাদেরই আপন হয়ে বিচরন করা সেই চিরচেনা মুখগুলো কেমন যেন বিরূপ আচরনের ভিন্ গ্রহের মানুষ হয়ে আত্মপ্রকাশ করলো। এ নিয়ে ফিসফাস কানাঘুষা বা হৈচৈ হয়নি-তা কিন্তু নয়। নৈতিকতার আদর্শে বেড়ে উঠা ছাত্র-যুবাদের একটি বৃহৎ অংশ প্রতিবাদ করে প্রকাশ্য হয়েছে। রাজপথ জনপদে তারা তাদের অস্তিত্বের জানান দিয়েছে। কিন্তু সামন্ত প্রভুত্বের করুনার উঠানে লালিত পালিত হয়ে বেড়ে উঠা বাঙালী যখন রাজদন্ডের কর্তৃত্বের দন্ডটি হাতে পেল তখন সেই নিপীড়িত নিগৃহীত বাঙালীই হয়ে উঠলো পরাক্রমশালী নেতা মন্ত্রী বা এক কথায় শাসক।
প্রজা থেকে রাজা হয়ে উঠার ঘুর্ণাবর্তে বাঙালীর উঠানে এই বিভাজনের লক্ষন রেখাটি ক্রমশঃ প্রকাশ্য হয়ে উঠে। যে রাজনীতি একসময় সুবিধা বঞ্চিত হত দরিদ্র বাঙালীর আশা আকাঙ্ক্ষার আঁতুড় ঘর হয়ে বাঙালীকে স্বপ্নচারী করেছিল সেই রাজনীতি ইদানীংকার সময়ে বাঙালীর ঘরে ঘরে আনাচার ও অনৈতিক দূরাচারী শাসক বানানোর আখড়ায় পরিনত হয়েছে। যে রাজনীতির নৈতিক আলোক ছটায় একসময় বাঙালীর কিশোর যুবারা স্বপ্নচারী হয়ে দেশ মার্তৃকার দামাল ছেলে হয়ে সামনের সারিতে এসেছিল, সেই রাজনীতির দূরাচারী আচরনে আজ তারা দ্বিধা বিভক্ত। দেশের সিংহভাগ তরুন যুবা, বিশেষ করে মেধাবীরা তাই এখনকার দিনে রাজনীতি বিমুখ হয়ে ভিনদেশীয় কর্মযজ্ঞের প্রবাসী রেমিট্যান্সের যোগানদাতা হয়েছে। দেশকে পর নির্ভরশীল ভঙ্গুর অর্থনীতির আধার বানাচ্ছে তারা। আর অবশিষ্ঠের দল পারিবারিক বলয় সৃষ্টিকারী রাজনীতির পেয়াদা সেজে দেশের বুনিয়াদী শিকড়ে ঘৃতাহুতি দিচ্ছে।
নির্বাচন, নির্বাচন কমিশন, সরকার গঠন, রাজনীতি ইত্যাদি সবই তো অঙ্গা অঙ্গি ভাবে জড়িত। কোন ক্ষেত্রেই আপোষের সুযোগ নেই। স্বচ্ছতায় টলমলে হতে হবে প্রতিটি উঠান। দুরভিসন্ধি বা স্বার্থ সিদ্ধির অপচেষ্টায় যদি অপামর জন আকাঙ্ক্ষার এই উঠানগুলি পথভ্রষ্ট হয় তবে তার চেয়ে দুর্ভাগ্যের আর কিছুই হতে পারেনা। আজকের দিনে বাংলাদেশে রাজনীতির যে অনুশীলন দেখা যায় তা সুষ্ঠতা ও স্বচ্ছতায় পাশ মার্ক পাওয়ার যোগ্য কিনা সেটা বোদ্ধাজনেরাই বলতে পারবেন। তবে রাজনীতি নির্বাচন ও সরকার গঠনের প্রক্রিয়াই বলে দেয় দেশের গনতন্ত্র আজ কোন্ উঠের সওয়ারী। যে রাজনীতিতে সহমর্মিতা নেই, যে গনতন্ত্রে বিশ্বাস ও বিশ্বস্ততার কোন বালাই নেই, যে সরকার ব্যবস্থায় বিরোধী মতাদর্শের কোন সম্মান নেই - সেই রাজনীতির তথাকথিত গনতান্ত্রিক রাষ্ট্রাচারে মূল্যবোধের নিক্তিটা কেমন হবে তা সহজেই অনুমেয়। “তাল গাছটা আমার” ভেবে রেখে যদি গনতান্ত্রিক চর্চার মহড়ায় রাষ্ট্রীয় অপচয়ের পুনঃতপশীলিকরন দৃশ্যমান হয় তবে সেক্ষেত্রে “পর্বতের মুসিক প্রসব” ছাড়া কিইবা আশা করা যায়।
আজকের দিনে রাজনীতির দূরাচারী আচরনে বীতশ্রদ্ধ হয়ে তাইতো আম জনতা বা দেশের তরুন প্রজন্ম এ পথ মাড়াতে চাচ্ছে না। ফলে ঘটে যাওয়া সামাজিক, রাজনৈতিক বা রাষ্ট্রীয় অপঘটনাগুলির নৈতিক প্রতিবাদ করার মুষ্টিবদ্ধ প্রতিবাদী কন্ঠস্বর আস্তেধীরে রাজনীতির মাঠ থেকে খুঁজে পাওয়া মুস্কিল হয়ে পড়েছে। মাসলম্যান রাজনীতির স্বেচ্ছাচারী আচরনে সমাজ ও জনপদ আজ বিষাক্ত হয়ে গেছে। মহান নেতাদের পারিবারিক বলয় তৈরী করে আজকের দিনে রাজনীতির যে এক পক্ষীয় অনুশীলন লক্ষ্য করা যাচ্ছে তা কি আদৌও গ্রহনযোগ্য কোন সুষ্ঠ সমাধানের সরল পথ? বাংলার রাজনীতির বর্তমান গতি প্রকৃতি প্রকৃতপক্ষে এই জনপদে সেই মধ্যযুগীয় রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কোন এক সুক্ষ্ণ তফশীলিকরন কিনা তা সময়ই বলে দেবে।
দেশের তরুন যুবারা পদ্মা-মেঘনা-যমুনার বহমানতার সঙ্গে তাল মিলিয়ে নরম মাটির বাংলাদেশে নিজেদের আপন অস্তিত্বের মুর্তি বানিয়ে দুর্বার হয়েছে। প্রতিকুল সময়কে অনুকূলে এনে তারাই আবার বাংলা ও বঙালীর সৃষ্টির আঁতুড় ঘরে নিজেদের পায়ের মাটি শক্ত করার মহাযজ্ঞে সামিল হবে। বাঙালী মাথা তুলে দাঁড়াবে। মহান নেতার আদর্শ এবং মুক্তিযুদ্ধের সর্বময়তায় দেশ যখন এক হয়ে বাঙালী অস্মিতায় নিজেদের গর্বের আঁতুড় ঘরে একাট্টা হবে তখনই কবি কন্ঠের সেই “সার্থক জনম তব জন্মেছি এই দেশে”র মহানতায় আমরা উজ্জ্বল হব। বিশ্ব কবির “সবুজের অভিযান”এর মন্ত্র গাঁথায় অনুপ্রানিত হয়ে তাইতো এই একবিংশের বটতলায় বাঙালী আজ সবুজের প্রত্যাশায় প্রহর গুনছে।