জালাল উদ্দিন আহমেদ
যিনি মালেক তিনিই খালেক
প্রকাশ: ০৭:০৮ পিএম, ৩০ সেপ্টেম্বর, বুধবার,২০২০ | আপডেট: ১০:০০ এএম, ২১ ডিসেম্বর,শনিবার,২০২৪
দুজনের নামই সৃষ্টিকর্তার নামের সাথে মিল রয়েছে। আল্লাহর নামের সাথে মিল রেখে নাম রাখা প্রথম জন প্রকারান্তরে একজন বাদশা। আর এই বাদশা কিন্তু যে সে বাদশা নন। তিনি দুনিয়ার বাদশা। সেই মালেককে অন্য অর্থে আবার দোজখের দারোগা হিসাবেও চিহ্নিত করা হয়েছে। অর্থাৎ আমাদের এই দুনিয়ায় মালেক বা মালিকরা তাদের মনুষ্য স্বকীয়তায় ভিন্ন ভিন্ন রূপে প্রকাশিত বা প্রস্ফুটিত হয়েছে। আবার সৃষ্টির সীমানায় থাকা খালিক বা খালেকদের কথাই বা না বলি কেমন করে! খালিক অর্থ স্রষ্টা বা সৃষ্টিকর্তা। তিনি মানবরূপী দৌর্দান্ড প্রতাপের পদাধিকারী সেই খালেক – যাকে সমাজ সম্মান দিয়েছে, রাষ্ট্র পদবী দিয়েছে। সমাজ ও রাষ্ট্রীয় পৃষ্টপোষকতায় পুষ্ট এই খালেকরাও কিন্তু ওইসব মালেকদের মালিক সেজে দপ্তর/অধিদপ্তরের অধিকর্তা হয়েছেন। তবে খালেকদের প্রশ্রয়েই এই মালেকরা তৈরী হয় এবং রাষ্ট্র, সরকার, মন্ত্রনালয়, দপ্তর, অধিদপ্তর ও সমাজ সংসারের আষ্টে পৃষ্টে এরা অবাধে বিচরন ক’রে তাদের জাত চিনিয়ে দেয়।
খালিক বা খালেক (রূপক অর্থে) একজন শিক্ষিত স্মার্ট যুবক। তিনি তার কর্মজীবন শুরু করেছেন একজন চৌকষ কর্মকর্তা হিসাবে এবং কর্মজীবনের শেষের দিকে এসে তিনি আজ দপ্তরের সর্বোচ্চ শিখরের পদটি অলংকৃত করেছেন। তবে বর্তমানের কলুষিত প্রশাসন ও বখে যাওয়া রাজনীতির কোন্ কোন্ বেড়াজাল ডিঙ্গিয়ে তিনি তার সর্বোচ্চ পদবী নিয়ে গদ্দিনশীন হয়েছেন তা কিন্তু মেপে দেখার প্রয়োজন পড়ে না আজকের এই প্রচন্ড প্রতাপশালী রাজা রাজড়াদের রাজত্বে। বিশাল কক্ষ সমৃদ্ধ চার দেয়ালে আবদ্ধ এই মানুষটি দেশব্যাপী ছড়িয়ে থাকা তার প্রফাইলের অফিস সমূহের তদারকির বড় কর্তা। তিনি দেশের ভালমন্দ নিয়ে চিন্তা করেন। তার উপর বর্তে যাওয়া দায়িত্ব সুচারুরূপে পালনে তিনি একগুচ্ছ অতি অনুগত মালেকদের নিয়ে তার দপ্তর সাজান। তবে এইসব মাননীয় খালেকরা বুঝে উঠার আগেই ওইসব বিশ্বস্ত অনুগতরা তার চারপাশ দিয়ে একটি মালেকীয় বলয় সৃষ্টি ক’রে তার দৈনন্দিন জীবনাচার ও পারিবারিক বলয়ে অতপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়ে। তাদের সুখ স্বপ্নের সারথি হয়ে এই মালেকেরা একটি অছিদ্রনীয় রাজত্ব তৈরী করে। ফলে এদের দৌরাত্মে ক্ষেত্র বিশেষে আমত্য পরিষদও অনেক সময় শিখর কর্তার কাছে অপাংতেয় হয়ে পড়েন।
এই মালেকীয় কারিশমা যুগে যুগে সমাজ সংসার ও রাষ্ট্র ব্যবস্থায় বিরাজমান ছিল এবং আছে। এই মালেকরা জীবনের সর্বক্ষেত্রে তাদের দাপট দেখিয়ে চলে। এই দাপট ক্ষমতার হতে পারে। হতে পারে তা ক্ষমতা সংশ্লিষ্টতার ঘনিষ্টজন হিসাবে। আবার ক্ষমতা সংশ্লিষ্টার অতি নিরীহ ক্ষুদ্র দপ্তরীও এই মালেকীয় গ্রুপের মধ্যমনি হতে পারে। সুযোগ সংশ্লিষ্টতায় তারা দপ্তর, সমাজ ও রাষ্ট্রের সর্বক্ষেত্রে ওজিএল (open general license) প্রাপ্ত হয়। ফলে বাধাহীন অপকৌশল অবলম্বন করে তারা তাদের সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলে। একসময় এই মালেকরাই ময়ুর পুচ্ছ লাগিয়ে খালেক সাজতে চায়। কিংবা ক্ষেত্র বিশেষে খালেকদেরও ছাড়িয়ে গিয়ে ওই মালেকরা সমাজ ও রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রক রূপে আবির্ভূত হয়।
আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার প্রতিটি ক্ষেত্রে এই মালেকদের বিচরন অবাধ ও অপ্রতিরোধ্য। এই যে এতসব পিএ পিয়ন ড্রাইভার এবং নাম না জানা এধরনের অগুন্তি পদ ও পদবী ধারী আমাদের জীবন ও জীবিকার সর্বক্ষেত্রে বিরাজ করছে তারা কিন্তু সবাই মালেক হতে পারেন না। এবং সত্যি কথা বলতে কি, বিচক্ষন বুদ্ধিমত্তার শিরোমনি খালেক সাহেব তার অপকর্মের সারথি হিসাবে ঠিকই এক বা দুজন মালেক সৃষ্টি করে অবাধে তার অবৈধ সাম্রাজ্যের গোঁড়াপত্তন করেন। এভাবেই সমাজে এধরনের হাজি মালেকদের ভিত্তি শক্ত হয়। তারা সমাজে গন্যিমান্যি হয়। একসময় সরকারী বা কর্পোরেট হাউজের কলার উঁচু করা আমাদের মত অচিহ্নিত খালেকেরা ওইসব মালেকদের প্রাসাদতুল্য আলীশান বাড়ীতে ভাড়াটিয়া হিসাবে ঠাঁই নেন। এই মালেকদের আবার প্রকারভেদ আছে। শুধু যে পিএ পিয়ন বা ড্রাইভারই এই মালেকীয় বিচরনে কাঠামোর অস্তিত্বে ঘুন ধরায় তা কিন্তু নয়। এই যেমন ধরুন কোন এক সরকারী সংস্থার শিখরে থাকা কোন এক খালেক সাহেব গত এক দশকের বেশী সময় ধরে তার অপরিহার্যতা প্রমান করে বার বার চুক্তি ভিত্তিক নিয়োগে চ্যাম্পিয়ন হচ্ছেন সেটাও কিন্তু মালেকীয় কারিশমা। কত বড় মালেক হলে তিনি চাকুরী জীবন শেষ করেও এক দশকের বেশী সময় ধরে তার অপরিহার্যতা প্রমানে সক্ষম হন তা রাষ্ট্রীয় কর্ম বলয়ে থাকা অন্যান্য পেশাজীবি ও প্রশাসকদের মাথা ঘুরিয়ে দেয়। এ ধরনের মালেকীয় ও খালেকীয় বেড়াজালের অবর্তে পড়ে এক সময় রাষ্ট্রীয় মেকানিজমের কর্ম বলয়ে অবস্থান করা অন্যান্য সম্ভাবনাময় ও মেধাবী পেশাজীবি এবং প্রশাসকেরা কর্মস্পৃহা হারিয়ে ফেলেন। ফলে রাষ্ট্রীয় মেকানিজমের কর্মচাঞ্চল্যে ছন্দপতন ঘটে। এবং এভাবেই মালেকীয় ও খালেকীয় অপ তৎপরতায় দেশ ও জাতির উন্নয়নের গতিপথ বার বার হোঁচট খায়।
সুতরাং ভাবতে হবে। মালেকরা কিন্তু মালেক হয়ে জন্মায় না। তাদেরকে জন্ম দেয়া হয়। রাষ্ট্র, প্রশাসন, রাজনীতি, সমাজ নীতি ও জনপদের প্রতিটি ক্ষেত্রে এই মালেকদের জন্ম দেয়া হয় স্তরে স্তরে জাঁকিয়ে থাকা ভিন্ন ভিন্ন কাঠামোর খালেকদের অপকর্ম ও অনৈতিক কর্মধারাকে সতেজ রাখার জন্য। এই চিত্রটি তৃতীয় বিশ্ব ও একপক্ষীয় শাসন ব্যবস্থার দেশেই বেশী বেশী করে বিকশিত হয় বলে পর্যবেক্ষকেরা মনে করেন। এক্ষেত্রে একটি কথা না বললে ওদের প্রতি অবিচার করা হবে। কারন এই মালেকরা তাদের চলায় বলায় এবং কর্মক্ষেত্রের ক্ষুদ্র পরিসরে এত চটপটে ও পটু হয় যে তাদের উপর অনেক ক্ষেত্রে নির্ভরশীল না হয়েও পারা যায় না। সে খালেক হোক বা মালেক হোক – তারা কিন্তু সিদ্ধান্ত নিতে ও দিতে এবং যেকোন অসাধ্যকে সাধন করতে বেশী সময় নেয় না। ফলে তার বা তাদের চলাফেরায় একটা মানসিক তৃপ্তির বলয় তৈরী হয়। এবং এভাবেই মালেকীয় আস্থায় খালেকীয় পরিমন্ডলে সমাজ-সংসার ও রাষ্ট্রীয় যন্ত্রের চাকা মাঝে মধ্যে মুখ থুব্ড়ে পড়ে।
আমরা আশাবাদী। রাষ্ট্রীয় সার্চলাইটের বেগুনী রশ্মি এখন ওইসব খালেক-মালেকদের মাথার উপর পড়তে শুরু করেছে। আশা করতে পারি , শুধু মলেকরা কেন খালেকরাও যেন এই চিরুনীতে ছাঁকা পড়েন। তবে অপকর্ম করে শুধুমাত্র অবসর জীবনের ওই সময়টাকে বিবেচনায় না নিয়ে যদি কর্মময় জীবনেই এই অপকর্মের শিকড় উপড়ানোর কাজে হাত লাগানো যায় তাহলে সেটাই হবে দেশের বুনিয়াদ পোক্ত করার সঠিক সিদ্ধান্ত। কারন শিকড় শক্ত হওয়ার আগেই সেই শিকড়কে উৎপাটন করতে পারলে জমিনের উর্বরতায় অতটা ভাটা পড়ে না। সুতরাং জমিন নষ্ট হওয়ার আগেই সেখানে ভাল করে হাল চাষ করে মাটিকে বিশুদ্ধ রাখার কাজে হাত লাগানো দরকার। সেক্ষেত্রে খালেকীয় পরিমন্ডলের বিশুদ্ধতা ও কর্মপরিকল্পনার স্বচ্ছতা প্রাণিধানযোগ্য বলে বিজ্ঞজনেরা মনে করেন। কাংখিত ও কলুষমুক্ত বাঙালী সমাজ তথা রাষ্ট্র গড়তে হলে সর্বক্ষেত্রেই এই মালেক খালেকদের এড়িয়ে চলতে হবে। চিরুনী অভিযান শুরু হয়ে গেছে। ছাঁকুনিতে মালেকরা এসে গেছে। সুতরাং খালেক - তোমরা সাবধান হও। তোমাদের জন্য কারেন্ট জাল তৈরী হচ্ছে।
*প্রবন্ধটির চরিত্রগুলি রূপক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে।