জালাল উদ্দিন আহমেদ
করোনার হাল খাতায় বাংলাদেশ
প্রকাশ: ০১:৪৭ পিএম, ১৫ সেপ্টেম্বর,মঙ্গলবার,২০২০ | আপডেট: ১০:৫৩ এএম, ২২ ডিসেম্বর,রবিবার,২০২৪
মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়া করোনার প্রকোপে আজ দুনিয়ার বেবাক শক্তিধর রাষ্ট্রসমূহ থর থর করে কাঁপছে। কাঁপছে শক্তির মানদন্ডে পৃথিবীর মোড়ল আমেরিকাও। ছোটবড় কেউ বাদ নেই এই দৈব দুর্বিপাকে। পৃথিবীর ২০১ টি দেশ আজ করোনায় কাবু। দুনিয়ার সর্বক্ষেত্রেই আহাজারি ও মৃত্যুর মিছিল। দক্ষিন এশিয়ার বাংলাদেশে এই করোনার প্রকোপ একটু দেরী করেই এসেছে। কিন্তু খুব বেশী যে দেরী হয়েছে তা কিন্তু নয়। তবে দেরী যেটা হয়েছে তা রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক সচেতনেতার ক্ষেত্রে। নিজেদের সচেতনেতার ভাবনাগুলি বিভিন্ন শাখা প্রশাখায় উড়তে উড়তে আমাদের প্রস্তুতির নাটবল্টু গুলোকে অনেকটাই ঢিলে করে দিয়েছি আমরা। লক্ষ্য করা যায় রাজনীতির মোসাহেবী সে সময় এমন এক মাত্রায় পৌঁছে দিয়েছিল যা ভেবে আমরা তৃপ্তির ঢেকুরও তুলেছি অনেক ক্ষেত্রে। আবার ধর্মীয় বয়ানের সোলেনামায় আমরা নিজেদেরকে সৃষ্টিকর্তার সেরা ধর্মীয় জীব হিসাবে প্রচার করতে গিয়ে সমাজ ও রাষ্ট্র কাঠামোকে বিভ্রান্তিতে ফেলে দিয়েছি। সেক্ষেত্রেও প্রস্তুতির ঢিলেমী তৈরী করেছে বলে অভিজ্ঞ মহল মনে করেন।
মূল প্রস্তুতি মোকাবিলা করার জন্য যে জায়গায়টিকে আমরা আমাদের ভরসার শেষ স্থল ভেবেছি তারা সে সময় বা এখনকার পর্যায়ে কি অবস্থায় আছে তা নিয়ে আমরা কেউ কি ভেবেছি! তাদেরকে নিয়ে বিস্তর আলোচনা আমাদের আছে। যুগ পরম্পরায় আমলাতান্ত্রিক গড্ডলিকায় আমাদের স্বাস্থ্য বিভাগের হাঁটাচলা। আমাদের স্বাস্থ্য অবকাঠামোয় একজন পেশাজীবি চিকিৎসক চেয়ারের উৎকর্ষতায় প্রশাসনিক কর্ণধার হতেই বেশী স্বাচ্ছন্দবোধ করেন। আজকের এই করোনাময় সময়ে মহামারীর বিরুদ্ধে সম্মুখ যুদ্ধে অবতীর্ণ এই বীর সেনানীদের নিয়ে বেশী কিছু লেখার অবকাশ নেই। তারপরেও রাজনীতির দুষিত হাওয়ায় স্নাত হয়ে যখন আমাদের মানবতার সেবাদানকারী এই পেশাজীবিরা অমুক পরিষদ তমুক এসোসিয়েশন করে নিজেদেরকে একটি পর্যায়ে নামিয়ে এনে ডাক্তারী বিদ্যাটাই ভুলতে বসেন তখন স্বাস্থ্যখাতের বর্ষ পরম্পরার প্যান্ডেমিক সাধারন মানুষকে অসহায়ত্বের চরম পর্যায়ে ফেলে দেয়।
যে হালখাতা নিয়ে বসেছি তার ফালনামা যে মোটেই সুখকর হবে না তা আমরা দিব্য চক্ষু দিয়েই দেখতে পাচ্ছি। আঠারো কোটি জনতার দেশে প্রত্যহ দশ থেকে পনের হাজারের পরীক্ষা করন এবং সরকারী হাতে গোনা গুটিকয় বিধিবদ্ধ হাসপাতালে তার কর্মচাঞ্চল্য দৃশ্যমান হওয়া মোটেই সুখকর ও স্বাস্থ্যকর নয় তা কিন্তু বহুল কথিত একটি বিষয়। আর যে সব বড় বড় প্রাইভেট হাসপাতাল তাদের নিজস্ব ব্রান্ড নিয়ে এই গরীবের দেশে বেনিয়াবৃত্তি করছে তারাও যে খুব গর্ব করে বলার মত কিছু করছে তাও চোখে পড়ছেনা। সাম্প্রতিক সময়ে তিক্ত অভিজ্ঞতায় পড়ে সরকারের বাধ্য হয়ে কোভিড চিকিৎসায় নথিভুক্ত হওয়া ডজন খানেক বেসরকারী হাসপাতাল বন্ধ করে দেয়ার খবরও আমরা জেনেছি। বাকী থাকলো শাহেদ সাবরিনাদের মত রাজনৈতিক চাঁইদের কলুষিত স্বাস্থ্য সেবার নমুনা। যে নমুনার আন্তর্জাতিকতা করনে আজ বাংলাদেশ সর্বক্ষেত্রে হেয় প্রতিপন্ন হয়েছে এবং হচ্ছে প্রতি নিয়ত।
রাজনীতির কলুষিত পথগুলি কেন যে সর্ব উঠানে তার বীরত্ব প্রকাশে উন্মুখ থাকে তা আমার এই ক্ষুদ্র মস্তিষ্কে ধরে না। দেশ যখন করোনার দাপটে কাঁপছে তখন সেই মহামারীর নিত্য ব্যবহার্য মাস্ক বা কিটস নিয়ে যে হৈচৈ ও রাজনীতি মেশানো প্রশাসনিক নোংরামী হোল তা কি সুস্থ সমাজে কাম্য ছিল! যে মহৎ উদেশ্য নিয়ে বিদেশে সুনাম অর্জনকারী একজন চিকিৎসক তার নিজ দেশে সেবার মানসিকতা নিয়ে এসে কোরেন্টাইন নামক বন্দিত্বের গ্লানি নিয়ে সে দেশে ফিরে গেলেন তার সদুত্তর কি আমাদের আছে?
আজকের দিনে করোনা মহামারীর এই দীর্ঘমেয়াদী দুর্যোগে আমাদের প্রশাসনিক কার্যধারা গুলো যখন রাজনীতির টকঝালে উঠানামা করে তখন কোরেনটাইন, লকডাউন আইসোলেশন নামক বিধিবদ্ধ নিয়মাচার গুলো নিজেরাই হাসাহাসি করে। লকডাউন আইসোলেশন এর বিধি নিষেধ সত্বেও বন্যা সতর্কতা হুজুগে রাজনীতির মোড়কে যেভাবে নেতা পাতি নেতারা তাদের দলবল নিয়ে ধান কাটার ফটো সেশন করলেন তা কোন নিক্তিতে মাপা যায়! করোনা শুরুর প্রথম দিকে করোনা আক্রান্তে জর্জরিত দেশ সমূহ হতে হাজার হাজার বাঙালী বিনা বাধায় এবং অবাধে যে হারে দেশে ফিরলেন তাতে করোনা সংক্রমনের সূচনা বা ব্যাপ্তি সেখান থেকেই শুরু হয়েছে বলে অভিজ্ঞ মহল মনে করেন। একজন জাতীয় অধ্যাপকের করোনা আক্রান্তে মৃত্যু হওয়ায় তাঁকে তড়িঘড়ি করে কাফনের কাপড় ও পলিথিনে মুড়িয়ে চার থেকে ছয়জনের প্রশাসনিক নজরদারিতে দাফন করা করা হয়। পাশাপাশি ওই একই করোনায় আক্রান্ত বিনাভোটের কোন জনপ্রতিনিধি (?) যখন ইন্তেকাল করেন তখন ঘটা করে তার জানাজা ও দাফন সম্পন্ন হয়। সেক্ষেত্রে প্রশাসনের করোনা সম্পর্কিত বিধিবদ্ধতার বালাই থাকে না। এরকম হাজারো খুচরো ব্যথা বেদনা ও অনিয়মের নিয়মাচারে আমাদের করোনা যুদ্ধ এগিয়ে চলেছে।
করোনা আক্রান্ত, সুস্থ্য হয়ে ফেরা ও মৃত্যু হারের হাল খাতায় দেখা যায় বাংলাদেশে শুরুর দিকে করোনা প্রকোপ খুব একটা দৃষ্টিগ্রাহ্য ছিল না। তবে শুরুর দুজন চারজনের মৃত্যু যখন মে জুনের দিকে দশ বিশে উঠা শুরু করলো তখন গদ্দিনশীনরা নড়েচড়ে বসার আয়োজনে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। দেশের সর্বোচ্চ শিরোমনির আকুলতায় অধীনস্ত রাজনীতির নায়কেরা সর্বক্ষেত্রে রাজনীতির টকঝালে নিজেদেরকে উপস্থাপনেই ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। ওদিকে রাজনীতির আশীর্বাদ পুষ্ট প্রশাসকেরাও রাজনীতির ঢঙে প্রশাসনিক প্রয়োগে জড়িয়ে পড়লেন। ফলে লকডাউন, কোরেন্টাইনের মত অতীব প্রয়োজনীয় কার্যক্রমগুলি সাধারন জনপদে ফিকে পানসে হয়ে ধরা দিল। এমনকি দেশের সর্বোচ্চ পর্যায়ের সমন্বয়ে গঠিত বিশেষজ্ঞ কমিটির সুপারিশে গা না লাগিয়ে রাজনীতির মিশেলে ক্ষমতাবান প্রশসকেরা জনপদের চলাচলে সবকিছু শিথিল করে দেয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। এই যখন হাল হকিকত তখন আজকের দিনে করোনা তার ক্রমবর্ধমান সংক্রমনে মোটাতাজা হচ্ছে বলেই মনে হয়। আজকের দিনে প্রত্যহ গড়ে ৫০ জনের মৃত্যু নিয়ে আমাদের দৈনন্দিন পথচলা। দেশে বর্তমানে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা তিন লাখের অধিক। এ পর্যন্ত মারা গেছেন সাড়ে চার হাজার। ক্রিটিক্যাল বা মুমূর্ষ অবস্থায় আছেন আরো হাজার দেড়েক। নিরাময় হয়েছেন দু লাখের মত। গোটা দুনিয়া বা পার্শবর্তী ভারতের অবস্থা খুব যে একটা ভাল তা বলা যাবে না। বিশ্ব পরিস্থিতিতে এ পর্যন্ত দু কোটি নব্বই লক্ষ মানুষ করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। এবং এই আক্রান্তের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। মারা গেছেন নয় লাখ পঁচিশ হাজারের মত। একটিভ রোগী প্রায় সত্তর লাখ যার মধ্যে একষট্টি হাজার মুমূর্ষ বা ক্রিটিক্যাল অবস্থায় আছেন। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে এ পর্যন্ত আটচল্লিশ লাখ করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। মারা গেছেন প্রায় আশি হাজার মানুষ।
লক্ষ্য করা যায় ইদানীংকার হিসাবে বাংলাদেশে গড়ে পঞ্চাশ জন করে মানুষ মারা যাচ্ছেন। তবে গত মাস দুয়েক আগেও এই সংখ্যাটা আঠার বিশে উঠা নামা করেছে। কারন সে সময় স্বাস্থ্যবিধি ও জন সমাগমের কিছুটা হলেও কড়াকড়ি ছিল। এখনকার পরিস্থিতি দেখে মনে হয় না দেশে কোন মহামারী চলছে (ছোট্ট একটি নমুনাঃ গত ২৮ ও ৩০ আগষ্ট পারিবারিক কারনে আমাকে সস্ত্রীক ঢাকা-কক্সবাজার এবং কক্সবাজার- ঢাকা যাতায়ত করতে হয়েছে। এবং তা আকাশ পথে সংঘটিত হয়েছে। ভেবেছিলাম ওটাই বোধ হয় নিরাপদ এবং স্বাস্থ্য সম্মত। স্বাভাবিক ভাড়ার তিনগুন ভাড়া গুনার পর ভেবেছিলাম হয়তোবা স্বাস্থ্যবিধি মানার জন্য এত বেশী গুনতে হচ্ছে। কিন্তু চলার পথে যেভাবে প্যাকড আপ বিমানে আসা-যাওয়া করলাম তাতে দেশে যে দৈব দুর্বিপাক চলছে তা ঘুনাক্ষরেও মনে হয়নি। তাছাড়া ঢাকার রাজপথ কিংবা কক্সবাজার এবং তৎসংলগ্ন সেই প্রত্যন্ত সমুদ্র সৈকত সব কিছুই স্বাভাবিক বলে মনে হয়েছে আমার কাছে)।
দুর্যোগপুর্ণ এই মহামারীর অজুহাতে সরকার নিজের ক্ষমতাবলে অনেক ভালসব পদক্ষেপগুলো নিতে পারতো। তা না করে সরকারের দলীয় রাজনীতির আস্ফালনে প্রশাসনের উঠানে একধরনের ঢিলেমী সৃষ্টি হয়েছে ফলে জনপদে করোনা সংক্রমনের পথকে ত্বরান্বিত করেছে বলেই মনে হয়। এদিকে করোনা নিয়ন্ত্রনের আঁটঘাট না বেঁধেই ভ্যাক্সিন নামের সোনার হরিনের পিছনে দৌড়ানো শুরু হয়ে গেছে। কারন সেখানে ব্যবসা আছে। আছে গরীবের গলা কেটে পঞ্চাশ টাকার ভ্যাক্সিন পাঁচ’শ টাকায় বিক্রি করার এক জবাবদিহিহীন পরিবেশ। এই ভ্যাক্সিন কার্যক্রমে সরকারের নিজস্ব আয়োজনে সম্পন্ন করা হবে বলে মনে হচ্ছে না। কারন যে দেশের সরকার ব্যবস্থায় ষাট থেকে সত্তর ভাগ আইন প্রনেতাই ব্যবসায়ী প্রটোকলে বিলং করেন সেখানে সরকারী নিয়ন্ত্রন বা প্রোটকলে রেখে জনগনের স্বাস্থ্যবিধি উন্নয়নের আশা করা অলীক বলেই মনে হয়।
আজকের ফ্যামিলি ডাইনেষ্টির বাংলায় একজন ডঃ জাফরুল্লাহ বা ডঃ ইব্রাহিমদের জন্ম নেয়া বড়ই কষ্টসাধ্য ও দুঃস্বপ্নের ব্যাপার। মনে পড়ে ১৯৮২ সালের ওষুধ নীতির কথা। স্বাস্থ্য খাতের জীবন্ত কিংবদন্তি ডঃ মোঃ জাফরুল্লার তৈরী করে দেয়া সেই ওষুধনীতির বদৌলতে আজ বাংলাদেশের ওষুধ খাত স্বয়ং সম্পুর্নই বলা যায়। এই ওষুধ নীতি চালু হওয়ার আগে দেশীয় উৎপাদনের হার ছিল দেশের মোট ভলিউমের মাত্র ৪-৫%। সেই ওষুধ নীতি বাধ্যতামূলক হওয়ার পর এখনকার চিত্রে বাংলাদেশ তার ওষুধ উৎপাদনে ৯৭-৯৮% এ চলে এসেছে। আজকের দিনে বাংলাদেশ ওষুধ রপ্তানীকারক দেশ হিসাবে পরিচিতি পেয়েছে। সেক্ষেত্রে স্বাস্থ্য খাতের বর্তমান চালচিত্রে প্রাইভেট হাসপাতাল ও ডাইগনসিস ল্যাব গুলির অপরিকল্পিত ও অবৈধ দৌরাত্মে আজ এদেশের স্বাস্থ্য খাতের যে দৈনদশা দেখা যাচ্ছে তার মূলেও রয়েছে এই রাজনীতির বাণিজ্যিকিকরন।
এত কিছুর পরেও চলছে জাফরুল্লাহ সাহেবদের মত গুটিকয় নমস্য ব্যক্তির ঐকান্তিক ও অক্লান্ত প্রচেষ্টা। করোনা মোকাবিলায় ইতোমধ্যেই দেশীয় প্রচেষ্টায় অনেক কিছু যোগানে তারা এগিয়ে এসেছেন। কিন্তু করোনা মোকাবিলায় সম্মিলিত প্রচেষ্টাকে পাশ কাটিয়ে যখন সিদ্ধান্ত গ্রহনকারীগন ও প্রশাসনের আষ্টে-পৃষ্টে রাজনীতি মেশানো বাণিজ্যের দুষ্ট কীটগুলো অবাধে বিচরণ করে তখন দেশপ্রেমের চেতনায় সংঘটিত শ্রমগুলো পন্ডশ্রমে পরিণত হয়। করোনা মোকাবিলা ম্যানেজমেন্টে যা কিছু দৃশ্যমান তার সিংহ ভাগই সরকারের মাধ্যমে পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত। সেক্ষেত্রে সরকার নিজস্ব বলয়ের আপাত চমকের প্রতি মোহাচ্ছন্ন থাকলেও সময় ও চাহিদার নিক্ততে এক সময় সব ঠিক হয়ে যাবে বলেই অনুমান করা যায়। আপন ঐতিহ্যের চেতনায় উজ্জীবিত বাঙালী তার স্বপ্ন বাস্তবায়নে একাট্টা হবে - এটাই কাম্য। করোনা জয় করে আমরা স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসবো ইনশা আল্লাহ!