জালাল উদ্দিন আহমেদ
জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ
প্রকাশ: ১০:৪৩ পিএম, ১৩ জানুয়ারী, বুধবার,২০২১ | আপডেট: ১০:৫২ পিএম, ২০ ডিসেম্বর,শুক্রবার,২০২৪
একটি যুগ। বারটি বছর। চার হাজার তিন'শ আশি দিন। এক লক্ষ পাঁচ হাজার এক'শ বিশ ঘন্টা। তেষট্টি লক্ষ সাত হাজার দু'শ মিনিট। সাইত্রিশ কোটি চুরাশি লক্ষ বত্রিশ হাজার সেকেন্ড। কিসের এত হিসাব! আঁচ করতে পেরেছেন কি? না পারারই কথা। কারন যে এক ঘেয়ামী ও বৈচিত্রহীন এক পক্ষীয় রেকর্ড এই এক যুগ ধরে বাংলার আনাচে কানাচে বেজেই চলেছে তাতে করে এটা নিয়ে পুলকিত হওয়া বা শিহরিত হওয়ার জনসম্পৃক্ততা এখন মানুষের নেই। মানুষ এখন মেশিন। জীবন চাহিদার নৈমিত্তিক ডামাডোলে সে তার জীবনের বৈচিত্র নিয়ে ভাববার সময় পায় না। সে তার সামাজিক নিয়মাচারের সুখ দুঃখ নিয়ে চিন্তার অবসরে নেই। মানুষ আজ কেবলই যন্ত্রের ন্যায় জীবন ও জীবিকার রোজনামচায় এক বিধিবদ্ধ উপাদান। এদিক ওদিক তাকানোর কোন প্রয়োজন নেই বা পড়েও না। সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় আচারে মতামত প্রকাশের সিদ্ধান্তে সে নেই। সে কেবলই রাষ্ট্রাচারের এক পক্ষীয় রূঢ় আচরনের বিধিবদ্ধ উপাদান – যেখানে রাজনীতি আছে, মিষ্টভাষের জন সম্পৃক্ততার কথা আছে। আছে প্রিয় নেতা বা মহানায়কদের সুত্র টেনে তাদের রেখে যাওয়া স্বপ্নের কচ কচানি। কিন্তু রাজনীতি সুলভ প্রায়োগিক বাস্তবতা সেখানে নেই।
বলছিলাম দেশের জনপ্রিয় সরকার প্রধানের যুগপুর্তি বা বর্ষপুর্তির ভাষন প্রসঙ্গে। জাতির উদ্দেশ্যে প্রচারিত সে ভাষন জাতি বা জনতা কতটুকু শুনেছে বা এর প্রতি আগ্রহ দেখিয়েছে তা ধর্তব্যে না নিয়ে শুধু এটুকুই বলা যায় আমাদের যৌবনের সময়কালে সরকার প্রধান বা বাষ্ট্র প্রধানের এমনকি প্রধান নেতা নেত্রীর ভাষন বা বক্তব্য শোনার জন্য যেভাবে সারাদিনের পুলক জাগানিয়া প্রস্তুতির ব্যস্ততায় তৈরী হতাম এখনকার প্রেক্ষিতে নেতা নেত্রী বা সরকার প্রধানদের দেখা বা শুনার কোন আগ্রহ কি আমাদের বা বর্তমান প্রজন্মের আছে!
ছোটবেলার স্বপ্নচারী এক কিশোরের চোখে দেখেছি রাজনীতির সচেতনতা এবং সামাজিক যুথবদ্ধতা। মানুষ খেয়ে না খেয়ে থেকেছে। কিন্তু রাজনীতির নেতা নেত্রী কিংবা সরকার প্রধান বা সরকারকে নিয়ে সামাজিক আচরনের আশা জাগানিয়া সেই বুকভরা স্বপ্নে মানুষ ভেবেছে, বসেছে, হেসেছে, স্বপ্ন দেখেছে, কান্না করেছে, বিক্ষুব্ধ হয়েছে, উল্লিসিত হয়েছে। ঘরে খাওয়ার সংস্থান নেই। ছেলে মেয়ের পড়াশুনার নিশ্চয়তা নেই, জমির ফসলে জল যোগানের নিশ্চয়তা নেই, নেই কোন ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখার উঠান – কিন্তু নেতা নেত্রীর নামে বা রাজনীতির একাত্মতার সম্মিলিত প্রচেষ্টার কোন খামতি ছিল না তখন। দূর কোন মফস্বল শহরে রাজনীতির বড় নেতা আসবেন জনসভা করার জন্য। ব্যাশ! গ্রাম গ্রামান্তরে সপ্তাহ জুড়ে চলে প্রস্তুতির মহা এন্তেজাম। মানুষের স্বতঃস্ফুর্ততা এবং জন সমাগমের ঢল যেভাবে সেই জনসভাকে জনসমুদ্রে পৌঁছে দিত তাতে করে জনপদের সেই সামাজিক যুথবদ্ধতা ও রাজনৈতিক নৈতিকতার বাক্যাচরনে উঠতি বয়সের যুবক যুবতীরা নিজেদের শুদ্ধাচারে আশার প্রদীপ হয়ে সমাজ কাঠামোয় ঠাঁই করে নিত। নগর বন্দর বা রাজধানীর কোথাও সামাজিক বা রাষ্ট্রীয় কোন অনুষ্ঠান শেষে রাষ্ট্রপতি বা সরকার প্রধান বক্তৃতা দিবেন। সত্যি বলতে কি সেসব জনসভায় জন সমাগমের স্বতঃস্ফুর্ততায় তা জনসমুদ্রে পরিনত হোত। এবং তা স্বতঃস্ফুর্ত অংশ গ্রহনেই হোত। পুজা পার্বনের আনন্দঘন পরিবেশের ন্যায় রাজনীতির এসব জনসভা বা কার্যক্রম সত্যিকার অর্থেই সে সময় মানুষকে আন্দোলিত করতো। মানুষ রাজনীতি নিয়ে স্বপ্ন দেখতো। সমাজ পরিবর্তনের এবং রাষ্ট বিনির্মানের সিঁড়ি হিসাবে সে সময় বিশুদ্ধ রাজনীতির উঠানকে অনুশীলনের পবিত্র উঠান হিসাবে গন্য করা হোত।
আজকের রাজনীতি ও রাষ্ট্র কাঠামো বড়ই অদ্ভুতুড়ে ও বেসুরো আহবানে জন মানুষের অন্তঃস্থল থেকে ক্রমেই দূরে সরে যাচ্ছে। মানুষ এখন রাজনীতি নিয়ে স্বপ্ন দেখে না, ভাবে না, উল্লিসিতও হয় না। রাজনীতি এখন ঘাড়ে চাপানো বোঝা হয়ে বাঙালীর প্রাত্যহিক জীবনাচারে অশনির ডংকা বাজিয়ে চলেছে। রাজনীতির বেসুরো আহবান আজ মাসলম্যান দাদাগিরির আসর বসিয়েছে। সেখানে মিলনের কথা বলেনা। সামাজিক ন্যায় বিচার ও সহমর্মিতার কথা বলে না। পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ও শিষ্ঠাচারের শাশ্বত আচরনের সেই রাজনীতি আজ রাষ্ট্রাচারে নেই। এখানে চলে মামলা হামলা আর আধিপিত্য বিস্তারের কচ কচানি। আর একটি উপাদান আমাদের রাজনীতির উঠানে প্রবল প্রতাপের উলঙ্গ আচরনে বিদ্যমান থেকে তার বর্তমান দৈউলিয়াত্বকে স্মরন করিয়ে দেয়। ক্ষমতায় থেকেই হোক বা ক্ষমতাহীন অবস্থায় হোক প্রতিটি পক্ষ্যই তাদের নোংরামী ও কদর্য আচরনের প্রলেপ লেপনে শুদ্ধ উচ্চারনে মহান নেতাদের কোটেশনেই কথা বলেন। এভাবেই সেই স্তুতি বাক্য উচ্চারন করে তারা তাদের রাজনীতির দুর্বিনীত আচরনে আবহমান বাংলার শাশ্বত বাঙালীয়ানাকে ধুলিস্মাত করেই চলেছে। মহান নেতা বা রাষ্ট্র প্রধানদের বিকি কিনি করে তারা তাদের রূটি রুজির ধান্ধায় রাজনীতির জিন ধরে যেভাবে বিত্তশালী ও প্রতাপশালী হচ্ছেন তা একসময় তাসের ঘরের মত চুরমার হয়ে যাবে সে ইতিহাসের পাতা কি তারা পড়েন নি ! তারপরেও তারা একই বাদ্যগীত বাজিয়ে নিজেদের আখের গোছানোর মহোৎসবে এগিয়ে চলেছে।মহান নেতাদের ত্যাগ তিতিক্ষায় গড়ে উঠা রাজনীতির আদর্শকে গর্তের নীচে ফেলে উপর থেকে পানি ঢালার চর্চায় আজ তারা মত্ত। অর্থাৎ গাছের গোঁড়া কেটে পানি ঢালার বাস্তবতায় আজকের রাজনীতি চলমান।
আজকের দিনে রাজনীতির উত্তরাধিকারের জয় জয়কার। মহান নেতা ও রাষ্ট্র প্রধানদের উত্তরাধিকারীরা এখানে তাদের পিতা প্রোপিতামহের কর্মেরসুফলেযে সোনার বাংলা বিনির্মানের স্বপ্নে বাঙালীকে স্বপ্নচারী করেছিলেন তা এখন মরিচিকা হয়ে বাংলার উঠানে বিরাজ করছে। কিছু উচ্চাভিলাষী এবং অতি পদলেহী জননেতার তকমা লাগানো মানুষজন আজ অকালে ঝরে যাওয়া ওই মহান নেতা ও রাষ্ট্র প্রধানদের উত্তর পুরুষদের সামনে রেখে বাংলায় বৃটিশ রাজের স্টাইলে কোম্পানী আইনের পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেছে। মহান নেতার উত্তর পুরূষরা আমাদের গর্ব ও অহংকারের উচ্চারন। তাদের বলিষ্ঠ অবস্থান ও নৈতিকতা সমৃদ্ধ নেতৃত্বের ছটায় আজ আমরা অনেকদূর এগিয়েছি। কিন্তু ওই যে বলেছি – রাজনীতির উঠানে বৃটিশ বেনিয়া আদলে ক্লাইভ ও ডায়ারদের আস্ফালনে আজ বাংলার উঠানকে যেভাবে সরগরম করা হচ্ছে তা মোটেই শুভ নয়।
প্রসঙ্গ – জাতির উদ্দেশ্যে সরকার প্রধান হিসাবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ভাষন। সত্যি কথা বলতে কি, মানুষ আজ বোবা হয়ে গেছে। সত্য মিথ্যা আজ মানুষের কাছে অচেনা শব্দ। ভাল মন্দের বিবেকহীনতায় মানুষ আজ অন্য গ্রহের মনুষ্য বিবেচনায় বিচরন করছে বাংলার এই পবিত্র ভূখন্ডে যে মাটির সন্তান হিসাবে আমাদের গর্বিত করেছেন সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালী বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমান। আমাদের এই বাঙালী হওয়ার যুগেই দেখেছি – প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রপতির জাতির উদ্দেশ্যে ভাষন দেয়ার ঘোষনার প্রতিক্রিয়া। ঘোষনা দেয়া হয়েছে সন্ধ্যে সাতটাই রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রী জাতির উদ্দেশ্যে ভাষন দিবেন। ব্যাশ! আর যায় কোথায়, সন্ধ্যের আগেই মানুষজন নিজ নিজ প্রস্তুতি সেরে রেডিও টিভির সামনে গোল হয়ে বসে পড়তো যেমনটি দেখেছিলাম মুক্তিযুদ্ধের রক্তঝরা নয় মাস সময়ে। এম আর আখতার মুকুলের চরমপত্র ও বাবুল আখতারের দরাজ কন্ঠের সংবাদ পাঠ শোনার জন্য মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়তো রেডিও সেটের সামনে। ঠিক তেমনি জাতির আশা আকাঙ্ক্ষার প্রতীক মানানীয় প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রপতির দিক নির্দেশনা মুলক নীতিবাক্য শুনার অধীর আগ্রহে মানুষজন ব্যাকুল থাকতো। রাজনীতি, দেশপ্রেম, যুথবদ্ধতা এবং রাষ্ট্র চেতনার সেইসব দিনে সন্ধ্যে বেলার সেই সাতটাই রাস্তাঘাট, হাটবাজার ও জনপদে মনে হোত শুনশান নীরবতার এক অলিখিত কার্ফু জারি করা হয়েছে। এবং পাড়া মহল্লায় উচ্চ ভলিয়্যুমে সে ভাষন যেভাবে বাজানো হোত তাতে মনে হোত যেন একটা উৎসবের আমেজ চলছে চারিদিকে। ভাষন পরবর্তী সময়ে কড়া মিষ্টির ভিন্ন ভিন্ন প্রতিক্রিয়ায় জনপদ ও পাড়া মহল্লা সরগরম থাকতো। অর্থাৎ একটা আবেগী আমেজে সেদিনের সন্ধ্যায় বাঙালী তার আগত দিনের হিসাব কষতে বসতেন।
আজকের দিনে রাষ্ট্র বা সরকার প্রধানদের জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া ভাষন কেমন যেন ফিকে পানসে হয়ে ধরা পড়ছে। মানুষ ও সমাজ ব্যবস্থা এবং তার সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় আচার আচরন এখন এমন এক মেশিন সদৃশ্য অবজেক্ট হয়ে পড়েছে যে, কে কখন কি বলবে বা শোনাবে এই নিয়ে কারও ভ্রুক্ষেপ নেই। সবাই একমুখী- উর্দ্ধপানে ছুটে চলেছে। অর্থাৎ রাজনীতির আবেগ ও রাষ্ট্রাচারের রোজনামচায় জনসম্পৃক্ততা আজ ধর্তব্যে পড়ে বলে মনে হয়না। এটা রাজনীতির দায় কিনা জানিনা কিংবা রাষ্ট্রাচারের বিচরনে কোন অসামঞ্জস্যতা আছে কিনা তা সমাজ বিজ্ঞানী ও রাষ্ট্র বিজ্ঞানীরাই বলতে পারবেন। তবে খোলা চোখের ফালনামায় যা দেখা যায় তাতে এটা স্পষ্ট যে ইদানীংকার রাজনীতি ও রাষ্ট্র নীতির খেরোখাতায় জন সম্পৃক্ততা ও তাদের অংশগ্রহন দিনকে দিন দুর্বল থেকে দুর্বলতর হচ্ছে। ফলে জন গন প্রজাতন্ত্রের কাগুজে প্রেস্ক্রিপশনের দাওয়াই বড় দুর্বল হয়ে ধরা পড়ছে।
সুতরাং ডিজিট্যালাইজেসনের ডামাডোলে আমাদের ষড় ইন্দ্রিয়ের অনুভূতি নামক এই উপাদানটির মেরামতে হাত লাগাতে হবে। সমাজ সম্পৃক্ততায় সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় বিচরনে আমাদের শাশ্বত উপস্থিতি ও সম্পৃক্ততাকে ঝালাই করতে হবে। নইলে একটা সময় আসবে যখন হাই হ্যলো বা সালাম আদাবের বদলে শরীর ঝুঁকিয়ে মাথা নুইয়ে কিংবা সটান কদম বুসির স্টাইলে প্রণত হওয়া ছাড়া আর কোন গতন্তরে আমাদের অবস্থান থাকবে বলে মনে হয়না।