রাশেদুল ইসলাম
একজন মানুষের কত জমি দরকার ?
প্রকাশ: ০১:২২ পিএম, ৬ সেপ্টেম্বর,রবিবার,২০২০ | আপডেট: ০৮:৩১ পিএম, ২১ ডিসেম্বর,শনিবার,২০২৪
এটা একটা বিদেশী গল্পের শিরোনাম । লেখক রাশিয়ান । নাম লিও তলস্তয় । আমি ছেলেবেলায় গল্পটি পড়েছি । এখনও মনে আছে । সারাজীবন মনে থাকবে । পৃথিবীতে এমন কিছু গল্প আছে, যা মানুষ একবার শুনলে জীবনে আর ভোলে না । এটা সেরকম একটি গল্প ।
তলস্তয় এঁর জীবন বর্ণাঢ্য জীবনগাঁথার এক বিশাল ক্যানভাসে আঁকা ছবি যেন । অভিজাত জমিদার পরিবারে জন্ম । বিলাসবহুল জীবন যেমন দেখেছেন, যুদ্ধ চলাকালীন ও অন্যান্য সংকটময় পরিস্থিতিতে মানুষের জীবনও তিনি দেখেছেন । তাঁর লেখা পৃথিবী বিখ্যাত একটি উপন্যাসের নাম ‘যুদ্ধ ও শান্তি’ । শেষ বয়সে ঋষিতুল্য জীবন কাটান তিনি । নিজের কাজ নিজে করতেন । এমনকি নিজের জুতা নিজে তৈরি করতেন । শ্রমজীবী মানুষের মত পোশাক পরতেন তিনি । ১৯১০ সালের নভেম্বর মাসের এক বরফপড়া মধ্যরাতে তিনি গৃহত্যাগ করেন । নিকটবর্তী রেলষ্টেশনে অপেক্ষারত অবস্থায় বরফ ঠাণ্ডায় জমে ৮২ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন তিনি । তৎকালীন শাসকগোষ্ঠীর নিষেধাজ্ঞা থেকে সত্ত্বেও দেশবিদেশের হাজার হাজার মানুষ তাঁর শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে যোগ দেন । কথিত আছে মৃত্যুকালে তলস্তয়ের সাথে থাকা একটি ঝোলার মধ্যে যে দুটি বই পাওয়া যায়, তার একটি ছিল হযরত মোহাম্মদ (সঃ) এঁর বাণী সম্বলিত বই । নবী মোহাম্মদ (সঃ) নিজে মরুভূমির একজন মেষপালক অবস্থা থেকে দেশের শাসনকর্তা নিযুক্ত হন । কিন্তু দেশের শাসনকর্তা হওয়া সত্ত্বেও তিনি অতিসাধারণ জীবনযাপন করতেন এবং তাঁর অনুসারীদেরকেও একইভাবে সাধারণ জীবনযাপনের পরামর্শ দিয়েছেন তিনি ।
আমি বোধহয় বিষয়ের বাইরে চলে এসেছি । আসলে তলস্তয় বা হযরত মোহাম্মদ (সঃ) এঁর উপর লেখা আমার উদ্দেশ্য নয় । আমি তলস্তয়ের একটা গল্পের উপর লিখতে চাই; যে গল্পটি একবার শুনলে জীবনে কেউ ভোলে না । এ কারণে মূল গল্পটি হুবহু জানা গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয় । গল্পের মূল কথাটিই আসল । যতদূর মনে পড়ে গল্পটি নিম্নরূপ –
পাশের দেশে অনেক কম দামে জমি পাওয়া যায় । এটা জেনেই একজন ব্যক্তি ছুটলেন সেখানে জমি কিনতে । তখনকার দিনে আজকের মত কাগজের মুদ্রা ছিল না । স্বর্ণ ও রৌপ্যমুদ্রার প্রচলন প্রায় সব দেশেই ছিল । এ জাতীয় যথেষ্ট পরিমাণ মূল্যবান মুদ্রা নিয়েই লোকটি সেখানে যান । মুদ্রাগুলি যথানিয়মে জমা দেন তিনি এবং জমা দেওয়া মুদ্রার বিনিময়ে কি পরিমাণ জমি তিনি পেতে পারেন - তা জানতে চান । তারা জানান, জমির পরিমাণ ঠিক হয় সূর্যের অবস্থানের সময় ধরে হাঁটার পরিমাণ অনুযায়ী । তাঁর ক্ষেত্রে সূর্যোদয়ের পূর্ব মুহূর্ত থেকে সূর্য অস্ত যাওয়ার পূর্ব পর্যন্ত হেঁটে তিনি যে পরিমাণ জমির সীমানা নির্ধারণ করতে পারবেন – সেই পরিমাণ পুরো জমির মালিক হবেন তিনি । এ কথা শুনে ভদ্রলোকের অজ্ঞান হওয়ার অবস্থা । তিনি অনেক দ্রুত হাঁটতে পারেন । ফলে বিপুল পরিমাণ সম্পত্তির মালিক হওয়া এখন তাঁর একদিনের ব্যাপার মাত্র । এসব চিন্তায় রাতে ঠিকমত ঘুম হয় না তাঁর । ভোরে বলা যায়, একেবারে না খেয়েই তিনি তাঁর সীমানা নির্ধারণী স্থানে হাজির হন । ভূমি বণ্টনকারী লোকজন তাঁকে নিয়মকানুন বুঝিয়ে দেন । যাত্রা শুরুর স্থানে সূর্য ডুবে যাওয়ার আগে ফিরে আসতে হবে । না পারলে তিনি কোন জমি পাবেন না । লোকটি মৃদু হেসে হাতের ডান দিক দিয়ে হাঁটা শুরু করেন । ভোরের মৃদুমন্দ বাতাসে তাঁর হাঁটার গতি বাড়ে । সূর্য মাথার উপরে উঠতেই তিনি তাঁর ভুল বুঝতে পারেন । সারাদিনের কথা ভেবে তাঁর সাথে কিছু খাবার ও পানি রাখা দরকার ছিল । শুরু থেকে তিনি শুধু হাতের ডান দিকেই হেঁটেছেন । এখন তাঁকে বাম দিক ঘুরে নাক বরাবর হাঁটতে হবে । অনেকদূর হেঁটে তাঁকে আবার বামদিকে ঘুরে সোজা হাঁটতে হবে । কিছু দূর গিয়ে তাঁকে আবারও বাম দিকে হাঁটতে হবে । তারপর জীবনপণ করে তাঁকে শুরুর জায়গায় পৌঁছাতে হবে । তাহলে এই বিশাল বেড় দেওয়া পুরো জমির মালিক হবেন তিনি । তবে সূর্যোদয়ের আগে শুরুর জায়গায় যদি তিনি পৌঁছাতে না পারেন, তাহলে তাঁর সব স্বপ্ন শেষ । তিনি কোন জমি পাবেন না । আবার জমা দেওয়া মুদ্রাও ফেরত পাবেন না তিনি । এমনিতেই রোদে ঘামছিলেন, এসব চিন্তায় ক্ষুধা পিপাসার চিন্তা ভুলে যান তিনি । পাগলের মত ছুটতে থাকেন । সূর্যের ডুবু ডুবু অবস্থায় তাঁর হাত পা অবশ হয়ে আসে । শুরুর জায়গায় অনেক ভিড় দেখতে পান তিনি । মনের সমস্ত শক্তি একত্র করে ছুটতে চেষ্টা করেন । ঠিক সূর্য ডোবার আগেই পৌঁছাতে পারেন তিনি । কিন্তু সেই সীমানা নির্ধারণী জায়গায় পৌঁছেই মাটিতে লুটিয়ে পড়েন তিনি । কোন নড়াচড়া নেই । নিথর একটা দেহ । মারা গেছেন তিনি । তাঁর কেনা জমিতেই গর্ত করে তাঁকে কবর দেওয়া হয় । এই কবর দিতে লোকটির নিজের হাতের মাপে মাত্র সাড়ে তিন হাত জায়গার প্রয়োজন হয় । লোকটির সুখে শান্তিতে বেঁচে থাকার জন্য যে এত বেশী জমির প্রয়োজন ছিল না- তা লোকটি বুঝতে পারেন নি ।
সম্প্রতি একজন পুলিশ কর্মকর্তার নির্দেশে একজন অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তাকে নৃশংসভাবে হত্যার অভিযোগ দেশের বিবেকবান প্রায় সকল মানুষকে কাঁদিয়েছে । অভিযোগে প্রকাশ এধরণের হত্যাকাণ্ডের মূল কারণ অবৈধ পথে অর্থ অর্জন । অভিযুক্ত কর্মকর্তা ইতোমধ্যে দেশেবিদেশে শত শত কোটি টাকার পাহাড় গড়েছেন বলে জানা যায় । কিন্তু সেই কর্মকর্তার প্রকৃত সুখে শান্তিতে থাকার জন্য মোট কত টাকার প্রয়োজন, তা তাঁর জানা ছিল না । তাই অর্থের পিছনে পাগলের মত ছুটতে ছুটতে ছিটকে পড়েছেন তিনি । তবে আমাদের সমাজে এ ধরণের অভিযোগ ব্যতিক্রম কিছু নয় । অপরাধের মাত্রা কার কতটুকু সেটা বড় কথা নয়, কমবেশী আমরা সকলেই একই ধরণের অর্থহীন এক মরীচিকার পিছনে ছুটে চলেছি যেন । আমাদের চলার গতি বোধহয় একটু মন্থর হওয়া দরকার ।
বিজ্ঞানী নিউটনের ৩ নম্বর গতিসূত্রে বলা হয়েছে, প্রত্যেকে ক্রিয়ার একটা সমান প্রতিক্রিয়া আছে । এটা শুধু বিজ্ঞানের কথা নয় । সমাজ বিজ্ঞানেরও কথা । তাই যে ব্যক্তি অন্য মানুষকে কষ্ট দেয়, অন্য মানুষের দুঃখের কারণ হয়; তাকেও জীবনে বেঁচে থেকেই সেই পরিমাণ কষ্ট ও দুঃখ সহ্য করতে হয় । কিন্তু বাস্তবে যখন একজন ক্ষমতায় থাকে বা ভালো অবস্থায় থাকে, মানুষ শুধু তার তখনকার খবর রাখে । অসুস্থতা বা অন্যকোন কারণে যখন সে পর্দার আড়ালে চলে যায়- তখনকার খবর কেউ রাখে না । তাই, অপরাধী মানুষের দুঃখকষ্ট ভোগ করার সংবাদ মানুষ কম জানতে পারে । এ কারণে নিউটনের গতিসূত্র যে সমাজ জীবনেও সমানভাবে প্রযোজ্য - এটা কেউ বুঝতে পারে না । সবাই গল্পের লোকটির মত আচরণ করে এবং অনেক সময় প্রকৃতির নিয়মে ধরা পড়া পুলিশ কর্মকর্তার মত খবর হয়ে পড়ে ।
জন্মের পর একটি নিস্পাপ মানবশিশু হিসাবে আমাদের জীবনের যাত্রা শুরু হয় । আমাদের বুঝতে হবে এই মানবজীবনেও শুরুর বিন্দু এবং শেষের বিন্দু একই জায়গায় । জন্মের পর একজন মানবশিশুর কোন নাম থাকেনা । তখন সে একটি ‘শিশু’ মাত্র । আবার মৃত্যুর পরও একজন মানুষের কোন নাম থাকে না । তখন সে একটি ‘লাশ’ মাত্র । জন্মের সময় একজন মানবশিশুর শরীরে কোন পোশাক থাকে না । আবার মৃত্যুর পরও একজন মানুষের শরীর থেকে তার পোশাক খুলে নেওয়া হয় । ফলে আমরা যে রকম নিস্পাপ অবস্থায় জন্ম নিয়ে জীবন শুরু করি, সেই নিস্পাপ অবস্থা না হোক – অন্তত একজন সত্যিকার মানুষ হিসাবে যেন জীবনের ইতি টানতে পারি –সেই কথাটা আমাদের চিন্তায় রাখা দরকার ।
সকলের কল্যাণ কামনা করি ।
ইস্কাটন, ঢাকা । ৫ সেপ্টেম্বর, ২০২০ ।