জালাল উদ্দিন আহমেদ
কোন গলিপথে আমরা- ২য় পর্ব
প্রকাশ: ১০:৪৮ পিএম, ৫ সেপ্টেম্বর,শনিবার,২০২০ | আপডেট: ০৮:২৮ এএম, ২১ ডিসেম্বর,শনিবার,২০২৪
( সমাজ ও রাষ্ট্র কাঠামোয় বহুবিধ গলিপথের সুচারু ও সমন্বিত চলনেই তৈরী হয় মসৃণ ও প্রশস্ত রাজপথ। এ নিয়েই লেখার চেষ্টা করছি। ১ম পর্ব প্রকাশ পেয়েছে ২/৯/২০২০)।
ছোটবেলায় বড় হয়েছি শিক্ষকের সাহচর্যে। যখন জ্ঞান হোল তখন ঘরে দেখলাম আমার বড় ভাই হাইস্কুলের হেডমাস্টার। আবার স্কুল জীবনে এসে সেই ভাইয়াকে দেখলাম প্রফেসর। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে এসে ঘরে পেলাম কলেজের প্রিন্সিপ্যাল স্যারকে। ছোটবেলায় দেখতাম দাদু তার এলেম ও আমল দিয়ে সমাজে হুজুর হিসাবে সমাদৃত। আমার কোরান শিক্ষার এলেমটা তাঁর কাছ থেকেই পেয়েছি। স্কুল পেরিয়ে কলেজ জীবনে প্রবেশ করে যখন রাজনীতি সচেতন হলাম তখন দেখলাম রাজনীতির শুদ্ধপাঠে তরুন যুবাদের এগিয়ে চলার স্ফুরন। তো এই রোজনামচা নিয়েই আমার বেড়ে উঠা।
শিক্ষক শিক্ষকই। তিনি বিশেষায়িত। তাঁর জন্য নতুন কোন বিশেষনের প্রয়োজন আছে কি? তিনি সম্মানিত। শিক্ষার আলোয় উদ্ভাসিত এক অগ্র পুরূষ তিনি। তাঁর আলোক ছটায় সমাজ আলোকিত হয়। তিনি শিক্ষার আলো জ্বালিয়ে মানুষ গড়ার কারিগর হিসাবে সমাজ সংসারে সম্মানিত হন। আর এক শ্রেণীর শিক্ষক আছেন আমাদের সমাজে। তিনি হচ্ছেন মৌলভী বা ইমাম সাহেব। সমাজবদ্ধ মানুষের আত্মিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধকে উচ্চাসনে বসানোর দায়িত্ব নিয়ে তারা সমাজে হুজুর পুরোহিত বা যাজক হিসাবে সম্মানিত ও গ্রহনযোগ্য। সমাজ তথা রাষ্ট্রের মানুষকে সুশৃংখলভাবে বিকশিত ও দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে এগিয়ে চলার আরও কিছু কিছু আশা ও সম্মানের জায়গায় আমাদের আছে। তার মধ্যে অন্যতম হোল রাজনীতি। সমাজের স্বচ্ছ্বতা ও যুথবদ্ধতার জায়গায় হোল রাজনীতির অঙ্গন। দেশ সমাজ ও সংসার জীবনে আরো বহু বড় বড় উপাদন বা উঠান রয়েছে যা রাষ্ট্র কাঠামোয় আবশ্যিকভাবে বিদ্যমান। বর্ণিত তিনটি সমাজবদ্ধতার চাহিদায় রাষ্ট্রীয় কাঠামোর সৌষ্ঠব বিকশিত হয়।
আজকের দিনে সামাজিক চাহিদার এই তিনটি ক্ষেত্রে (অর্থাৎ শিক্ষা ধর্ম ও রাজনীতি) আমরা কেমন যেন উদাসীন ও ক্ষেত্রবিশেষে বেপরোয়াও বটে। ব্যক্তি সংশ্লিষ্ঠতায় পুষ্ট এই সামাজিক উপাদানগুলি আজকের দিনে ফিকে পানসে হয়ে তার অস্তিত্বের মূলে কুঠারাঘাত করছে। শিক্ষকেরা তাদের সম্মান রক্ষার্থে উদাসীন এবং ক্ষেত্র বিশেষে নৈতিক স্খলনে নিমিজ্জিত। মৌলভী বা হুজুরেরা তাদের উপর অর্পিত ধর্মীয় নৈতিকতা ও মানবিক মূল্যবোধ তৈরীতে যেমন ব্যর্থ তেমনি গ্লোব্যাল রাজনীতির মায়াজালে নিজের অস্তিত্বে কুঠারাঘাত করতেও তারা বেপরোয়া। পাশাপাশি রাজনীতির জায়গায়গুলো আস্তে ধীরে আমাদের মত সাধারন মানুষের কাছে পচা পুকুরের খাবি খাওয়া মাছের মত অবস্থায় পৌঁছে গেছে। পচা প্যাঁক ওয়ালা পুকুরের মাছ যেমন বিওডি(বায়োলজিক্যাল অক্সিজেন ডিম্যান্ড) এর অভাবে খাবি খেতে খেতে একসময় মারা পড়ে, আমরাও সাধারন মানুষ তেমনি রাজনীতির হাটুরেদের কাছে জিম্মি হয়ে ছটপট করছি আর খাবি খাচ্ছি।
শিক্ষকের নীতিহীনতা ও রাজনীতির লেজুড়বৃত্তি এবং সর্বোপরি বেনিয়া তত্ত্বের পিছনে সময় ব্যয় আজ জাতীয় পর্যায়ে শিক্ষার অধঃপতনের মূল কারন হয়ে দাঁড়িয়েছে। শিক্ষক আজ শিক্ষকের পর্যায়ে নেয়। নৈতিকতা ও মানবিক মূল্যবোধ আজ শিক্ষকের মাঝে খুঁজে পাওয়া মুস্কিল। শিক্ষক দৌড়াচ্ছেন টাকার পিছনে, যশের পিছনে। অথচ যা করলে তার যশ ও টাকা দুটোই আসবে সেদিকে শিক্ষকের মনোযোগ নেই। তারা রাজনীতির পিছনে দৌঁড়াচ্ছেন পদ ও পদবীর জন্য। তারা রাজনীতির মঞ্চে বক্তৃতা করছেন। নিজের ক্লাস রুম ও বিদ্যাপীঠ শিকেয় তুলে তারা কোচিং সেন্টার বানাচ্ছেন। কোচিং সেন্টারের সুনাম বাড়ানোর জন্য প্রশ্নপত্র ফাঁসের চক্রে জড়িয়ে পড়ছেন। এমনকি, লজ্জাজনক হলেও সত্য, শিক্ষক তার কোচিং সেন্টারের ছাত্রকে উচ্চ নম্বর প্রাপ্তির প্রতিযোগিতায় নকল সরবরাহ করতে গিয়ে ধরাও পড়ছেন। আবার বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ছাত্রদের উচ্চ নম্বর প্রদানের প্রলোভনে অনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের খবরও আমরা পত্র পত্রিকায় দেখতে পাই। আজকের দিনের শিক্ষকরা তার ছাত্রকে নৈতিকতার শিক্ষায় আলোকিত করেন না। তিনি তার ছাত্রকে মানিবিক মূল্যবোধ, চরিত্র গঠন ও জীবন বোধের গল্প শোনান না। তিনি তার ছাত্রকে বেপরোয়া রাজনীতির লাভের গুড় খাওয়ার পথ বাতলে দেন। তিনি তার ছাত্রকে তারই প্রতিষ্ঠিত কোচিংএ গিয়ে নোট নেয়ার পরামর্শ দেন। সর্বোপরি তিনি তার ছাত্রকে মুখস্ত বিদ্যায় পারদর্শী করে তোতা পাখি বানান। ফলে প্রভাবশালী ও বেনিয়া শিক্ষকদের ওইসব গোল্ডেন এ প্লাস পাওয়া আদর্শ ছাত্ররা একসময় তাদের মুখস্তের বাইরে গিয়ে নিজেদের বাপ-দাদার নামটিও ভুলতে বসে। তারা তাদের অস্তিত্বের ঠিকুজি বলতে পারেনা। আজকাল টিভিতে একটি বিজ্ঞাপন প্রায়শঃ প্রচার হতে দেখি। ছেলে বড় হয়েছে। বিয়ে দেয়ার লক্ষ্যে ছেলেকে নিয়ে বৌ দেখতে গেছেন বাবা-মা। বরের বাবা বলছেন “ আমার ছেলে ক্যাডেট কলেজের গোল্ডেন এ প্লাস পাওয়া ছাত্র”। তখন কনে জিগ্যেস করে বসে “ কোন ক্যাডেট কলেজ”। ছেলের উত্তর “ময়মনসিংহ ক্যাডেট কলেজ”। হতে পারে বিজ্ঞাপনটি একট প্রতিকী এবং কোন একটি পন্যের জন্য বানানো হয়েছে। এখানে নির্মাতা কি চোখে আঙ্গুল দিয়ে কিছু দেখাতে চাইলেন? সত্যি বলতে কি আমাদের শিক্ষা ও শিক্ষকের মান নিয়ে আমরা মহা ফ্যাসাদে আছি।
এখন আসা যাক ধর্মীয় শিক্ষক বা হুজুরদের কথায়। হুজুরদের ইসলামী জোশের রাজনীতি ও অববশেষে মাসলম্যান দাদাগিরির মোসাহেবি করা, পাশাপাশি জেহাদি ও জঙ্গি তৎপরতার মরিচিকায় নিজেদের সমর্পন করা। একজন আলেম বা হুজুর হবেন সমাজের দিক নির্দেশক। তিনি তার ধর্মীয় বিধানের সুমধুর বাণী দিয়ে সমাজের সর্বস্তরের মানুষের মাঝে শান্তির সুবাতাস ছড়িয়ে দেবেন। সমাজের মুরুব্বী হয়ে সমাজ কাঠামোয় নিষ্কলুষ ও উজ্জ্বলতার প্রতীক হয়ে আলো ছড়াবেন। এটাই তো শাশ্বত। ধর্মগুরু হবেন সমাজের আলোকবর্তিকা। কিন্তু এই মিশ্র আবহের সমাজ ব্যবস্থায় আমরা ধর্ম শিক্ষক বা ধর্মগুরুদের কিভাবে দেখি! পীর মাশায়েখ আল্লামায় ছেয়ে গেছে সমাজ। একেক জন একেক তরিকায় অবস্থান করেন। ওয়াজ তফসিরের নামে নিজেদের মধ্যেই গালমন্দ শুরু করে দেন। আজকাল আবার রাজনীতি পন্থী আলাম ওলামাও তৈরী হয়ে গেছে। সুতরাং আজকের দিনে বিশুদ্ধ আলেম ওলেমার জন্য আমাদেরকে হাঁতড়ে বেড়াতে হয়। আমরা সৃষ্টিকর্তার খোঁজে আজ সঠিক ধর্মগুরুর অভাব অনুভব করছি। তারপরেও ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টিতে ধর্ম গুরুরা তাদের পারঙ্গমতায় সব সময়ই চ্যাম্পিয়ন। যার ফলশ্রুতিতে দেখি দিশাহীন রাজনীতি ও মৌলিক শিক্ষার কলুষিত উঠানে গড়ে উঠা মানব সন্তান এক সময় ধর্মীয় আঁচলে নিজেকে সমর্পন করে।
শিক্ষকের সমাজ গড়ার নীতিহীনতা এবং ধর্ম গুরুদের তরিকা ও মাজহাব খোঁজার এই টালমাটালে আমাদের সমাজের গলিপথ গুলো ক্রমশঃ সরু হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু যে দীক্ষা ও মন্ত্রে মানুষ তার সমাজবদ্ধতার সমস্ত গ্লানি ও ক্লান্তিকে দূরীভূত করবে সেই রাজনীতির ডংকাই বা কিভাবে বাজছে তাও দেখা দরকার। বাঙালীর পোড় খাওয়া রাজনীতি আজ রাজা-রাজড়া আমত্যের বলয়ে সিংহ দুয়ার তৈরী করে ফেলেছে। পাল ও সেন বংশীয় আদলে আজ এদেশে বংশীয় পরম্পরার পালা বদল শুরু হয়েছে। আমরা দেখেছি পার্শবর্তী বা দূরবর্তী রাষ্ট্র সমূহের যেখানেই এই বংশ পরম্পরার রাজনীতি গেঁড়ে বসেছে তখনই সেইসব দেশে ধর্মীয় গোঁড়ামীর উচ্চাভিলাষীদের কাছে মানুষ ছুটে গিয়েছে। ফলে সেসব দেশে এমন ভাবে রাজনীতির পালা বদল হয়েছে যা পরবর্তীতে সাধারন মানুষের জীবন যাত্রাকে দুর্বিসহ করে ফেলেছে। সুতরাং ফ্যামিলি ডাইনেষ্টি আপাতঃ দৃষ্টিতে দেশে স্বস্তির আবহ আনলেও তা বহু মত ও পথের দেশে কখনোই দীর্ঘমেয়াদী সামঞ্জস্যতায় সুফল বয়ে আনে না।
আমাদের চলার গলিপথ আস্তে ধীরে সরু হয়ে যাচ্ছে। ফলে গলিপথের আলোকবর্তিকা এখন তার অস্তিত্বের আঁতুড় ঘরে নিভু নিভু অবস্থায় টিম টিম করছে। রাজনীতির স্বছ্বতা ও নৈতিকতা এবং শিক্ষার বিশুদ্ধতাই আমাদের এই অন্ধকারের গলিপথ থেকে বের করে আনতে পারে। পাশাপাশি ধর্মীয় শিক্ষার নৈতিকতা ও বিশুদ্ধ আচরন এক্ষেত্রে আমাদের চলার গলিপথে দিশার আলো হয়ে উঠতে পারে।
আসুন, প্রার্থনায় বসি। নিজেদের শুদ্ধাচারের দিকগুলো উন্মোচনের প্রার্থনা। আমরা বীরের জাতি। সফল হবো ইনশা আল্লাহ!