জালাল উদ্দিন আহমেদ
তোমারে বধিবে যে গোকুলে বাড়িছে সে
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ১২ ফেব্রুয়ারী,রবিবার,২০২৩ | আপডেট: ০৫:২৯ পিএম, ১৯ ডিসেম্বর,বৃহস্পতিবার,২০২৪
আমি একজন মধু মিয়াকে চিনি এবং জানি। গত পঞ্চাশ বছর ধরেই তার সাথে একটা আত্মিক সম্পর্ক আমার গড়ে উঠেছে। এই মধু মিয়া নামের মানুষটি আমার সমবয়স্কই হবে। তার বাড়ি ঢাকার মোহাম্মদপুরের পশ্চিম প্রান্তে। আটি বা বশিলা নামক এলাকায়। বাপ দাদার ভিটায় থাকে। সঙ্গে দু'চার বিঘা চাষযোগ্য জমি। তাও সেটা কালিগঙ্গা,ধলেশ্বরী বা বংশী নদী প্রবাহের গ্রাসের মুখে। এই মধু মিয়া পেশায় গোয়ালা। অর্থাৎ গরুর দুধ বিক্রি করে চলে তার দিনমান। আর টুকটাক সাক-সব্জির আবাদ করে বাৎসরিক ঘর সংসারের চাহিদা মিটিয়ে তার চলে যায় কোনমতে। মোহাম্মদপুরের তাজমহল রোড়ে আমার বসবাস। তাজমহল রোডের পশ্চিমের শেষ প্রান্তে শিয়া মসজিদ। পরবর্তী পশ্চিম প্রান্ত শুধুই জলরাশি আর নদীস্রোতের কাহিনী। তবে শীত আগমনের পূর্বে ও পরের কয়েকটি মাস এই নদী বিধৌত এলাকায় সবুজ প্রান্তরে শুধু সবুজ ধান ক্ষেতের বিশাল সমারোহ পরিলক্ষিত হয়। সে এক মনোমুগ্ধকর সবুজ প্রান্তর এবং সময়ের ব্যবধানে সোনালী ধানের ক্ষেতে গ্রাম বাংলার এক ছোট্ট রেপ্লিকা বলে মনে হোত। শিয়া মসজিদ বরাবর শ্যামলী পর্যন্ত রিংরোড ছিল তখনকার মোহাম্মদপুর রক্ষার বেড়িবাঁধ। এটা কিন্তু স্বাধীনতা পরবর্তী ১৯৭৫-৭৬ অব্দি সময়ের কাহিনী। মনে পড়ে রিংরোডের পাড়ে বসে আমরা তখন সুর্যাস্ত দেখতাম। ওদিকে সাত মসজিদ সংলগ্ন নদীর ঘাট ছিল। ওখান দিয়ে বশিলা বা আটির মধু মাওলারা নৌকা করে ঢাকায় আসা যাওয়া করতো। এই মাওলা নামটি অজান্তে এসে গেল এই কারনে যে মাওলা নামের যুবকটি তখনকার সময়ে ঘাড়ে করে মস্ত বড় খাঁচি ভর্তি ডিম নিয়ে শহর এলাকায় আসতো এবং বাড়ি বাড়ি চাহিদা মত ডিম সরবরাহ করতো। তখন তো আর আজকের দিনের মত ফার্মের মুরগি বা ডিমের আধিক্য ছিল না। এইসব মাওলারা গ্রামে গঞ্জে বাড়ি বাড়ি ডিম সংগ্রহ করে পরে তা শহুরে বাবুদের বাড়িতে চাহিদা মোতাবেক সরবরাহ করতো। এরকম ডিম মাওলাদের মত মুরগি মনির, সবজি মান্নান, মেছো মুসা কিংবা কসাই মুন্নাদের তখন শহরবাসীর মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তের সংসারে অপরিহার্য সহায়ক হিসাবে বিচরন ছিল। সে পদ্ধতি এখনো এই একবিংশের উঠানে বিদ্যমান আছে। তবে তা অন্য ধাঁচে, অন্য আঙ্গিকে। এখন মানুষ বেড়েছে, বসতি বেড়েছে। পাশাপাশি মাওলা মধুদের আধিক্যেও আজকাল ঢাকার অলিগলি দিনমান কোলাহলময় হয়ে থাকে বললেও ভুল হবে না। তবে শুধুমাত্র দুধওয়ালা ছাড়া বাকী পেশাজীবিরা এখন আর আলাদাভাবে চিহ্নিত হয়ে থাকে নি। সব একাকার হয়ে মুক্তবাজার অর্থনীতির ফেরিওয়ালা হয়েছে। ফলস্বরূপ নগরবাসী যাঁচাই বাছাইয়ের সুবিধা নিয়ে এখন ঘরে বসে এসব সবজি আনাজের কেনাকাটা করতে পারেন। তবে চাল ডাল শুকনো মসলাপাতি, এসবের জন্য অবশ্যই নগরবাসীকে বাজার বা পাশের গলিপথের মুদিখানায় পা মাড়াতে হয়।
প্রসঙ্গ মধু মিয়া অর্থাৎ আমার বাসায় প্রত্যহ নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্টকৃত মাপের গরুর খাঁটি দুধ সরবরাহকারী দুধওয়ালা। দুধ সরবরাহের সেই কর্মচক্র এখনও সমান গতিতে প্রবাহমান। তবে বছর বিশেক আগে যে মধু মিয়া কাঁধে করে কিংবা মাথায় দুধের ক্যান নিয়ে যেভাবে বাড়ি বাড়ি দুধ সরবরাহ করতো, এখন আর সে দৃশ্য চোখে পড়বে না। মধু মিয়ার এখন মনসুরাবাদ বা শেখের টেকে চারতলা পাকা বাড়ি, আট দশজন কর্মচারী আছে যারা দুধ নিয়ে পুরনো ঐতিহ্যের আদলে নগরবাসীর বাড়ি বাড়ি দুধ সরবরাহ করে থাকে। তবে কাঁধে বা মাথায় নিয়ে নয়। এখন তারা সাইকেলের দু'পাশে দুধের ক্যান ঝুলিয়ে ঢাকার অলিগলি সাইকেল চালিয়ে তাদের পরিসেবা অটুট রেখেছে। না হলেও সারা বছর ধরে প্রত্যহ দুই কুইন্ট্যাল দুধ তার নেটওয়ার্কের দু'শ থেকে আড়াই'শ বাড়িতে সরবরাহ করতে হয়। শুনেছি বৃহত্তর ঢাকার পশ্চিমাংশের বেড়িবাঁধের ওপারে ইদানীং সে হাউজিং বা রিয়েল স্টেটের ব্যবসায় হাত দিয়েছে। মনে পড়ে আশির দশকে ১৯৮২-৮৩ সালের দিকে সে আমাকে তার এলাকায় একবিঘা জমি কিনে রাখার পরামর্শ দিয়েছিল। তখন দাম হিসাবে বলেছিল, 'স্যার আশি হাজার থেকে এক লাখ যোগাড় করেন আমি ব্যবস্থা করে দিব'। আমি বরাবরই এসব জমি জায়গায় সম্পত্তি ইত্যাদির ব্যাপারে নিরামিষ ছিলাম। এখনও ওই একই ধাঁচে চলছে আমার জীবন প্রবাহ। কোন কষ্ট নেই। হাত-পা ছাড়া। মান সম্মান বাপ দাদার শিক্ষা ও ঐতিহ্য নিয়ে বেশ আছি। সেই মধু মিয়াকে আর বাসার দরজায় কলিং বেল টিপে পটে মেপে দুধ দিতে দেখি না। পরিবর্তে তার কর্মচারী সোলেমান দুধ দিয়ে যায়। আর বার টাকার দুধ এখন আশি টাকায় কিনতে হয়। তবে এই আশি টাকার বিষয়টিও মনে হয় সেই সম্পর্কের জেরেই হয়েছে। কারন নব্বাই এক'শ টাকার নীচে খাঁটি গরুর দুধ পাওয়া এখন মুস্কিলই বটে। কথার ছলে বছর খানেক আগে একদিন দুধ দিতে আসা ছেলেটিকে মধু মিয়ার কথা জিগ্যেস করায় সে বলেছিল 'মহাজন তো একটু অসুস্থ্য। তবে আপনার কথা, ম্যাডামের কথা এমনকি আপনার ছেলে মেয়েদের নাম ধরে ধরে জিগ্যেস করে আপনাদের ভালমন্দের কথা'। শুনেছিলাম মধু মিয়া একদিন ফোনও করেছিল। কিন্তু বাসায় ছিলাম না তাই কথা হয় নি।
দুধওয়ালা মধু মিয়াকে নিয়ে এত কথা বললাম তার একটা কারন অবশ্য আছে। ইদানীং দেশে আলোড়ন সৃষ্টকারী একটি ঘটনা ঘটে গেছে। সামান্য এক চানাচুর ওয়ালা হকার এবং পরবর্তিতে ডিশ ব্যবসা করে মিডিয়া বা নেট দুনিয়ার ক্রেজ হওয়া হিরো আলমের ঘটনা পরম্পরার সাথে এর যথেষ্ট মিল রয়েছে। এই হিরো আলমকে নিয়ে দেশে যে আলোচনা ও সমালোচনার বাতাবরন তৈরী হয়েছে সেটার সঙ্গে এই মধু মিয়াদের কৃচ্ছ্বসাধনময় জীবন জয়ের সাযুজ্য রয়েছে বৈকি! একজন হিরো আলম যেমন তার কষ্টসাধ্য জীবনকে আপন কর্মযোগে সমৃদ্ধ করেছে পাশাপাশি দুধ বিক্রেতা মধুমিয়াও তার কর্ম প্রচেষ্টা ও অধ্যাবসায়ে ঢাকায় প্রতিষ্ঠা লাভের সিঁড়ি গেঁথে এগিয়ে গেছে। দু'জনের কর্মধারা ভিন্নধর্মী হলেও প্রন্তিক মানুষের সংজ্ঞার সীমানা থেকেই তাদের উত্থান। তারা আমাদেরই ভাই, আমাদের শেকড়। এই শেকড়ের বিস্তৃতি এখন ছড়িয়ে পড়ছে। এদের অবস্থান সমাজে গাঢ় হচ্ছে। আজকে হিরো আলম রাস্তাটি তৈরী ক'রে দেখিয়ে দিল যে আমরা আসছি। তোমরা সতর্ক হয়ে যাও। আমাদের ঘাড়ে বন্দুক রেখে ছড়ি ঘুরানোর দিন তোমাদের ফুরিয়ে আসছে। আমাদেরকে পুঁজি করে তোমরা যে মিথ্যের মিথ দিয়ে রাজনীতি সমাজনীতি এমনকি রাষ্ট্রনীতির পসার সাজিয়েছ তার ভিতে কিন্তু আমরা। আমাদেরকে আর ব্র্যাকেটে রাখা যাবে না। আমরা সামনে আসতে চাই। আজকে হিরো আলম যে পথ দেখালো আগামীতে মধু মিয়ারাও সেই পথের পথিক হয়ে যদি ক্ষমতার দন্ডে নিজেদের শরীক করতে চায় তখন কোন্ কুটনীতি দিয়ে এই পরনির্ভরশীল হুজুগে রাজনীতি সামনে এসে তার মোকাবিলা করবে সেটাই তো এখনকার দিনে কোটি টাকার প্রশ্ন!
বড় নড়বড়ে আমাদের বর্তমানের রাজনীতির উঠানটি। কারন রাজনীতি সমাজনীতি রাষ্ট্রনীতি যখন একচক্ষু দৈত্য হয়ে গোষ্ঠী বা পরিবার তন্ত্রের ঠিকাদারি নিয়ে আপন উৎকর্ষতায় মাতোয়ারা হয় তখন গোকুলে বেড়ে উঠা একলব্যরা পদ্মলোচন হয়ে প্রস্ফুটিত হতে চায়। কংস তুমি যতই ক্ষমতাধর হও না কেন গোকুলে বেড়ে উঠা কৃষ্ণরা ঠিকই সামনে চলে আসে। এটাই বিধির বিধান। সেই বার্তাটিতই দিয়েছেন হিরো আলম নামের আজকের দিনে গোকুলে বেড়ে উঠা এই আলোচিত চরিত্র। প্রতিষ্ঠিত রাজনীতির মহা আধিকারিকরা যখন সদম্ভে উচ্চারন করেন 'হিরো এখন জিরো হয়ে গেছে' , তখন মূহূর্ত বিলম্ব না করে হিরো আলমের উত্তর- 'যারা আমার মত একজন সামান্য হিরো আলমকে জিরো বানাতে চায় তারাই একদিন জিরো হয়ে যাবে'। পরনির্ভরশীল পরম্পরার রাজনৈতিক উঠানে বসবাস করা রাজনীতির নেতা পাতি নেতারা যখন আশীর্বাদপুষ্ট রাজনীতির আঁচলে বেড়ে উঠে তখন সত্যিই তার গণভিত্তি থাকে বলে মনে হয় না। ফলে তৃণমূল থেকে উঠে আসা অভয়ারন্যের এইসব হিরো আলম বা মধু মিয়ারা স্টেক হোল্ডারের অধিকারবলে প্রাতিষ্ঠানিক পক্ষের বিরুদ্ধে মুক্ত মঞ্চের প্রতিদ্বন্দি হয়ে উঠে। আমাদের আজকের দিনের মধু মিয়া ও হিরো আলমরা সেই মঞ্চেরই কুশীলব বলে মনে হচ্ছে।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় যখন বঙ্গবন্ধুর তেজদীপ্ত বজ্রকন্ঠের সেই কাব্যিক ঘোষনা বাঙালীকে একাট্টা করেছিল তখন বাঙালী সমস্বরে গেয়ে উঠেছিল -
আমার এই দেশ সব মানুষের
বড়দের ছোটদের সকলের
চাষাদের মুঠেদের মজুরের
গরীবের ফকিরের নি:স্বের।
আমার এই দেশ……..…..।
আমরা আশাবাদী হতে চাই আমাদের শেকড়ের বুনিয়াদকে মজবুত করতে। সম্মান দিতে চাই আমাদেরই পাশে বেড়ে উঠা মধু মিয়া ও হিরো আলমের মত বাঙালী স্বত্ত্বার বাঙালীদেরকে যারা দেশকে ভালবেসে দেশের উন্নয়নে নিজেদের উৎসর্গ করতে চায়। সাম্য ও সমতার তুলাদন্ডে উঠে আপামর বাঙালী কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সমাজ তথা রাষ্ট্রের প্রকৃত কর্মী হয়ে দেশকে মর্যাদার আসনে বসাবে - এটাই লক্ষ্য হওয়া উচিত। উচ্চশিক্ষা ও ডক্টরেট ডিগ্রির ভারে নুব্জ ফর্মুলা দেয়া পরনির্ভরশীল কর্মীর বদলে স্বশিক্ষিত মধু নিয়ারাই আমাদের দেশ গড়ার প্রকৃত কর্মী। ওদের লালন করা একান্ত জরুরী।