জালাল উদ্দিন আহমেদ
একজন হিরো আলম এবং আমাদের রূচিজ্ঞান
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ৬ ফেব্রুয়ারী,সোমবার,২০২৩ | আপডেট: ০৫:৪২ পিএম, ২১ ডিসেম্বর,শনিবার,২০২৪
মানুষ নামের মনহুশদের সঙ্গে কি ভয়ংকর বসবাস আমাদের। এই 'মনহুশ' শব্দটি আমি আমার স্বর্গবাসী পিতৃতুল্য শশুর মশাইয়ের মুখ থেকে শুনেছিলাম। শব্দটি আরবী কিংবা উর্দু হবে হয়তো। কোন এক কথার ছলে তিনি বলেছিলেন 'মানুষ নামের মনহুশদের সাথে আমাদের বসবাস'। হয়তোবা আমার গত কয়েকদিন আগের বাংলা কথায় 'মতামত' কলামে লেখা সেই "হককথা" লেখাটির প্রতিধ্বনি হয়েই প্রকট আকারে বাস্তব এই চিত্রটি জাতির সম্মুখে প্রকাশ পেল। কতটা দুর্ভাগা জাতি হলে এমন অরূচিকর উচ্চারন একজন উচ্চ পদাধিকারীর মুখে শুনতে হয়! অবশ্য তিনি উচ্চ পদাধিকারী ছিলেন বলেই হয়তো এখনকার অবসরের দিনগুলিতে বুদ্ধিবৃত্তির আঁতেল হয়ে সমাজে এধরনের ঘৃণা ছড়ানোর সুযোগ নিতে পারছেন। সেক্ষেত্রে তিনি অবসরে থেকেও তার দায়বদ্ধতার ঋণ শোধ করছেন নাকি আরো কিছুদিন বেঁচে থেকে 'His Excellency' হওয়ার খায়েসের মিশনে নেমেছেন, সেটাও বিবেচনায় আনতে হবে।
পঞ্চান্ন হাজার বর্গমাইলের এই ছোট্ট ভূখন্ডে ভুইফোঁড়ের মত গজিয়ে উঠা অর্ধশত টেলিভিশন চ্যানেলগুলির কোন এক সময়ের সাড়া জাগানো সমসাময়িক ও রাজনীতির উপর নির্মিত টকশো এখন কেউ দেখে বা শুনে বলে মনে হয়না। সেক্ষেত্রে সাধারন মানুষের জন্য এখনকার দিনে ইউটিউব ভিত্তিক টকশো ও আলোচনার পোর্টাল গুলিই ভরসার স্থল হয়ে দাঁড়িয়েছে। আজকের দিনে বাংলার রাজনীতি ও সমসাময়িক বিষয় নিয়ে সবচেয়ে সরগরম যে খবরটি জনমনে নাড়া দিয়েছে তা হচ্ছে আশরাফুল আলম সাঈদ নামক এক প্রান্তিক মানুষের 'হিরো আলম' হয়ে প্রকাশিত হওয়ার এক আরব্য রজনীর গল্প। এ গল্পের নায়ক নায়িকা দর্শক শ্রোতা স্ক্রিপ্ট রাইটার সবই যেন হিরো আলমময়। কে জানতো সেদিনের সেই লেখাপড়া না জানা গ্রাম্য বালকটি একদিন দেশের সর্ব মহলে আলোড়ন তুলে সমাজকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে বলবে আমরাই তোমাদের আদিসুত্র। এই আমাদের থেকেই তোমাদের উদ্ভব। জঠর জ্বালায় জর্জরিত সেদিনের মফস্বল শহরের ইলেক্ট্রিক খাম্বার নীচে পান সিগারেট বিক্রি করা রাস্তার হকার আলম আজ জাতির বিবেক। মিথ্যার মিথের উপর তৈরী হওয়া সমাজ কাঠামোকে আজকের হিরো আলমরা আঙ্গুল তুলে দেখিয়ে ছিচ্ছে আমাদের ভঙ্গুর সমাজ কাঠামোর দুর্বল দিকটিকে।
কি নিয়ে উচ্চকিত হব আমরা! একই মায়ের সন্তান হয়ে যখন আমরা নিজের শিকড়কে অস্বীকার করার মহোৎসবে একাট্টা হই তখন একবার কি আমাদের মনে পড়ে না এই আলমের মত একজন ভাই একজন বাপ একজন চাচা বা মামা আমাদের গ্রামে বাপদাদার ভিটা মাটি আঁকড়ে বাংলার সমগ্রতাকে জিইয়ে রেখেছে। তাদেরই সহযোগিতা ও কায়িক পরিশ্রমের অর্থমুল্যে আমরা আজ শহুরে বড়বাবু বা বড় সাহেব হয়ে দেশসেরা হচ্ছি বা হয়েছি। তারপরেও সবকিছু কেন আমার চাই? বাপদাদার ভিটে জমিন বেচাবিক্রি করে লেখাপড়া শেখা এই আমি আমার আরেক সহোদর অশিক্ষিত ভাই তথা আলমদেরকে মানতে আমার রুচিতে বাঁধে কেন? কি এমন জাত পাত খুইয়েছে আমাদের সেই গ্রাম্য পথশিশু আলম নামের বালকটি, যে তার কর্ম সাধনা ও শ্রমে আজ জাতির কাছে হিরো আলম নামক পরিচিতি পেয়েও সমাজ তথা রাষ্ট্র ব্যবস্থায় হাজারো প্রশ্নে তাকে জর্জরিত হতে হচ্ছে! রাস্তায় হকারি করে, ট্রেনে বাসে ফেরি করে জীবিকা নির্বাহের নির্মোহ অভিজ্ঞতার নির্যাসে এই গ্রাম্য আশরাফুল আলম যখন ডিজিট্যালের আশীর্বাদে নিজেকে জনমানুষের গ্রহনযোগ্য 'হিরো আলম' বানিয়েছে তখন কোন্ অজুহাতে আমাদের এইসব তথাকথিত পদাধিকারীর সভ্য সমাজ তাকে অস্বীকার করার স্পর্ধা দেখায়! প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরা কোন্ স্পর্ধা নিয়ে তার নির্বাচন করার গ্রহনযোগ্যতাকে অস্বীকার করে! কেনই বা দেশের সর্বোচ্চ বিচারালয়ের বাস্তবতায় তার অধিকারকে প্রতিষ্ঠা করাতে হয়? আর কেনইবা বিচারালয় থেকে সেইসব অযোগ্য কর্মচারীদের ভর্ৎসনা করা হয় না! কেনইবা জন মানুষের গ্রহনযোগ্য একজন স্বশিক্ষিত প্রান্তিক মানুষকে তথাকথিত মুখোশধারী সামাজিক মানুষদের ঠাট্টা তামাশার উপলক্ষ্য বানানো হয়। একজন সুবিধা বঞ্চিত কিশোর থেকে জন মানুষের আশার প্রতীক হওয়া যুবক যখন প্রান্তিক জনগোষ্ঠী থেকে বুক চিতিয়ে উঠে আসতে চায় তখন তাদেরই মাটি থেকে উঠে আসা পরনির্ভরশীল হয়ে বেড়ে উঠা পড়ুয়া মধ্যস্বত্তভোগী অন্যজন তার বিরোধিতায় আদাজল খেয়ে তার প্রভু বন্দনায় সামিল হয়। এবং সেটারই প্রতিফলন দেখলাম আমরা আজকের এই গ্রাম্য মানুষের প্রিয় মুখ হয়ে উঠে আসা হিরো আলমের ক্ষেত্রে।
কিন্তু কি দোষ ছিল এই সহজ সরল অদম্য ইচ্ছাশক্তির গ্রাম্য যুবকটির! কেন তাকে সাধারন নাগরিক জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে হোঁচট খেতে হয়। কেন তাকে তার ভাষায় কথা বলতে হাজারো বিধি নিষেধ শুনতে হয়। কোন অধিকার বলে তার মুখের উচ্চারন বদলে ফেলার এতসব সরকারী এন্তেজাম! কোন কারনে আইন শৃংখলার উঠানে গিয়ে তাকে রবীন্দ্র বা নজরুল সংগীত না গাওয়ার মুচলেকা দিতে হয়? কোন কারনে একজন স্বীকৃত নাগরিক হয়েও তিনি সংসদ নির্বাচনের প্রার্থী হতে পারেন না? কেন তাকে নিয়ে বুদ্ধিবৃত্তি ও অন্যসব পেশাজীবি ও রাজনীতিকরা গল্পে আড্ডায় হাসি ঠাট্টা তামাসা করে! একজন আশরাফুল আলম তো আমাদেরই ছায়া। আমাদেরই ভাই ব্রাদার। তার সৃষ্ট রঙ্গ তামাসা, টিকটক নাটক সিনেমা আমাদের মত কতিপয় সাদা কলারের পরজীবির ভাল নাইবা লাগতে পারে, কিন্তু তিনি তো গ্রামে গঞ্জে জনপ্রিয়। এমনকি শহর বন্দরের একটি বয়সের জেনারেশনের কাছে তিনি একটি ক্রেজ। এই হিরো আলমকে নিয়ে কতিপয় তথাকথিত সংকৃতি সেবীর এত গাত্রদাহ কেন। তাদের কি চোখে পড়ে না যখন এই হিরো আলমের উপচে পড়া ভীড়ের রিয়ালিটি শো গুলি গ্রামে গঞ্জে অনুষ্ঠিত হয়। একজন সাদা মনের গ্রাম্য যুবক যখন আপন অভিজ্ঞতায় বলেন 'আমি সকল বিধবা মা, পরিত্যক্ত নারী ও এতিম শিশুদের জন্য সংস্থা করে যেতে চাই যাতে করে আমার মায়ের মত মার খেয়ে রাস্তায় বাচ্চা নিয়ে রাত কাটানো না লাগে।' তিনি আরো বলেন, 'সার্টিফিকেটধারী শিক্ষিত লোকেরা ভীতু। নিজেও কিছু করবেনা অন্যকেও কিছু করতে দিবেনা।' এই স্বশিক্ষিত ছেলেটি যখন এধরনের মহানুভব উচ্চারনে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে চায় তখন আমাদের মত তথাকথিত শহুরে জ্ঞান পাপীরা ক্ষমতা ও অর্থ জোশের জোয়ারে দু'একটা প্রেমের কবিতা লিখে কবি হতে চায়। ফেব্রুয়ারীর বিকেলে বই মেলায় গিয়ে টিভি ক্যামেরায় নিজের বইয়ের মোড়ক উন্মোচনে ধন্য হতে চায়।
জানিনা কোন্ অক্টোপাশের বাহুবন্ধনে আবদ্ধ আমাদের আজকের এই সমাজবদ্ধতা। তবে যে কথাটি দিয়ে শুরু করেছিলাম আমার এই হিরো আলমীয় কড়চায়, তার আদিকথা হলো রুচিজ্ঞান। কোন্ রূচিতে রূচিময় হলে বিগ পদাধিকারীর সত্তোর্ধ একজন অবসরের আমলা আঁতেলের কাছে সাধারন বাঙালীর প্রিয় মুখ হিরো আলম রূচিকর হবে তা জানার ইচ্ছে হয় বৈকি! তিনি যখন নেট দুনিয়ার face the people নামক সেই জনপ্রিয় টকশোতে হিরো আলমকে নিয়ে বলেন, 'তাকে নিয়ে কথা বলতে আমার রূচিতে বাঁধে', তখন অবাক হয়ে ভাবতে ইচ্ছে করে এধরনের জনতার কর্মচারীদের নিয়েই তো আমরা স্বাধীনতার পঞ্চাশটি বছর পার করলাম। লাগাম দেয়ার সময় কি এখনও হয়নি! আর চাহিদার বাস্তবতায় গজিয়ে উঠা বিভিন্ন নেটিজনদের বলি, অনুষ্ঠান পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে আরো সচেতন হওয়া সমীচিন নয় কি! কারন যে আলোচকের মুখের সেই কুখ্যাত উচ্চারনটি ভাইরাল হোল তার ভাষা, উচ্চারন ও বলার ভঙ্গি হিরোর মতই তো মনে হোল।