ইজারা সাত লাখে, লেনদেন আট কোটি টাকা
ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ২৯ আগস্ট,মঙ্গলবার,২০২৩ | আপডেট: ১২:২৯ পিএম, ৩০ ডিসেম্বর,সোমবার,২০২৪
বরগুনার খাকদোন নদের দক্ষিণ পারে মাছ বাজারে প্রায় সাত লাখ টাকায় ৭৫টি ঘর (প্রতিটি ৯ হাজার ৩৩২ টাকা করে) ইজারা দিয়েছে প্রশাসন। অথচ, ইজারার জন্য সাড়ে আট কোটি টাকা চাঁদা তুলেছেন ব্যবসায়ীরা। সরকারি কর্মকর্তা ও জনপ্রতিনিধিদের এ সংক্রান্ত তর্কবিতর্কের একটি ভিডিও রেকর্ডিং কালের কণ্ঠ’র কাছে রয়েছে।
উচ্ছেদ, বরাদ্দ ও ফের উচ্ছেদের চিঠি
সদর উপজেলা ভূমি অফিস সূত্রে জানা গেছে, জেলা প্রশাসন গত ২১ মার্চ মাছ বাজারের ৪৪টি দোকান উচ্ছেদ করে।
একই স্থানে গত ৩ জুলাই জেলা প্রশাসনের অনুমতিক্রমে উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) চন্দন কর ৭৫টি ঘর বরাদ্দ দিয়েছেন।
এদিকে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডাব্লিউটিএ) সূত্রে জানা যায়, খাকদোন নদ দখলের কারণে সংকুচিত হয়ে আসছে। নদীবন্দর সচল রাখতে প্রতিবছর সরকার নদী খনন করছে। কিন্তু অব্যাহত দখলের কারণে নাব্যতা ধরে রাখা যাচ্ছে না।
গত ২ আগস্ট বরগুনা নদীবন্দর কর্মকর্তা খাকদোন নদের তীরভূমিতে স্থাপনা না করার জন্য এবং অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের জন্য নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট চেয়ে জেলা প্রশাসকের কাছে চিঠি দিয়েছেন।
রয়েছে হাইকোর্টের আদেশ
খাকদোন নদ নিয়ে হাইকোর্টে ২০২১ সালে মামলা করে হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিচ ফর বাংলাদেশ। ২০২২ সালে ৩০ জানুয়ারি হাইকোর্টের আদেশে বলা হয়, নদের সীমানা নির্ধারণ করে আদালতকে অবহিত করতে হবে। কিন্তু নদের সীমানা নির্ধারণ গতকাল সোমবার পর্যন্ত করতে পারেনি প্রশাসন।
ব্যবসায়ীদের অভিযোগ
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন ব্যবসায়ী জানান, ঘর বরাদ্দ পেতে চার থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত দিতে হয়েছে। ঘর পেয়েছেন মাছ বাজারের ব্যবসায়ী ছাড়াও অন্য লোকজন।
মাছ বাজারের ব্যবসায়ী জহিরুল হক পনু বলেন, ‘অভিযোগ তো একজনের বিরুদ্ধে করতেই পারে। টাকার বিষয়ে মাছ বাজারের সভাপতি বা সাধারণ সম্পাদক বলতে পারবেন, তাঁরা তালিকা করেছেন এবং তাঁরাই তালিকা দিয়েছেন। আগে যাঁদের ডিসিআর ছিল, তাঁরা অনেকে পাননি। আবার ডিসিআর ছাড়া অনেকে পেয়েছেন। আমরা যখন তালিকা দিয়েছি, তখন এমপি ও পৌর মেয়র সুপারিশ করেছেন।’
জনপ্রতিনিধি ও কর্মকর্তাদের তর্ক
গত রবিবার সকালে মাছ বাজারের পেছনে উচ্ছেদ করা এলাকা পরিদর্শনে যান জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান, সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও), সহকারী কমিশনার (ভূমি), পৌর মেয়র, সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এবং বিআইডাব্লিউটিএর নদীবন্দরের কর্মকর্তারা। এ ছাড়া মাছ বাজারের ব্যবসায়ীরাও উপস্থিত ছিলেন।
এ সময় জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর কবীর ইউএনওর কাছে জানতে চান, ‘নদীর ফোরশোরের (তীর) সীমানা আগে ঠিক করতে হবে। ফোরশোর জমিতে কোনো স্থাপনা উঠবে না।’ এ সময় ইউএনও কাউসার হোসেন বলেন, ‘বিআইডাব্লিউটিএর কোনো ফোরশোর জমি নেই।’ সঙ্গে সঙ্গে বিআইডাব্লিউটিএর উপপরিচালক মামুনুর রশিদ আপত্তি জানান। জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ইউএনওর কাছে জানতে চান, ‘মাছ বাজারে ঘর বরাদ্দ দিতে সাড়ে আট কোটি টাকা নেওয়া হয়েছে। সেই টাকার হিসাব দিতে হবে। তা না হলে এখানে একটি ঘরও উঠবে না।’ সঙ্গে সঙ্গে ইউএনও বলেন, ‘আমরা এসব টাকা নেওয়ার বিষয়ে কিছুই জানি না। কে নিয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে মামলা করেন।’
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বক্তব্য
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিআইডাব্লিউটিএর নদীবন্দর কর্মকর্তা নিয়াজ মোহাম্মদ খান বলেন, ‘আমাদের ফোরশোরে কোনো স্থাপনা না করার জন্য এবং অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের জন্য নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট চেয়ে জেলা প্রশাসকের কাছে চিঠি দিয়েছি।’
জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও বণিক সমিতির সভাপতি জাহাঙ্গীর কবীর বলেন, ‘পুরনো ব্যবসায়ী যাঁরা ছিলেন তাঁদের কাছ থেকে টাকা নেওয়া হয়েছে। নতুন যাঁদের নামে দেওয়া হয়েছে, তাঁদের কাছ থেকেও টাকা নেওয়া হয়েছে। এসব টাকা উঠিয়েছে মাছ বাজারের মাতবররা। এর সঙ্গে পনুও ছিলেন। এখান থেকে সাড়ে আট কোটি টাকা ওঠানো হয়েছে। কোনো কোনো ঘরপ্রতি ১৫ লাখ টাকা করেও নেওয়া হয়েছে। এসব টাকা প্রশাসনের কথা বলে ওঠানো হয়েছে। আমার দাবি, গরিবের টাকা ফেরত দেওয়াসহ ৩০ জন প্রকৃত ব্যবসায়ীকে ঘর দেওয়া হোক।’
এ বিষয়ে জানতে স্থানীয় সংসদ সদস্য ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভুকে গতকাল সন্ধ্যার পর কল করলেও তিনি ফোন ধরেননি। আর পৌর মেয়র কামরুল আহসান মহারাজ বলেন, ‘সুপারিশের অভিযোগ সঠিক না।’ জেলা প্রশাসক মোহা. রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘বরাদ্দ নিয়ে যদি কোনো অনিয়ম থাকে, তা আমরা দেখব, যাতে সুষ্ঠুভাবে সমাধান হয়।’