ফ্ল্যাটে কষ্টের জীবন
ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ০৪:১১ পিএম, ৮ জানুয়ারী,শুক্রবার,২০২১ | আপডেট: ০৪:২৬ পিএম, ১৫ ডিসেম্বর,রবিবার,২০২৪
বাইরে থেকে যত দৃষ্টিনন্দনই মনে হোক না কেন, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) উত্তরা অ্যাপার্টমেন্ট প্রকল্পের যে ক'টি ভবনের কাজ শেষ হয়েছে, সেগুলোর ভেতরের অবস্থা একেবারেই বিপরীত। অ্যাপার্টমেন্টের মালিকদের কষ্টের শেষ নেই। দু'জন প্রভাবশালীর কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছেন তারা।
অভিযোগ, সার্ভিস চার্জের নামে বাড়তি টাকা না দিলে বা ওই প্রভাবশালীদের অন্যায় কাজের প্রতিবাদ করলেই কপালে জুটছে মারধর, অপমান, লাঞ্ছনা। যারা ফ্ল্যাটে উঠেছিলেন, মানসম্মানের ভয়ে তাদের অনেকে তা বেচে দেওয়ার চিন্তা করছেন। অনেকে অন্যখানে ভাড়া থাকতে শুরু করেছেন, অনেকে চেষ্টা করছেন অন্য কোথাও চলে যাওয়ার।
ভুক্তভোগীরা বলছেন, উত্তরার মনোরম পরিবেশে রাজউকের ফ্ল্যাটে বসবাস করার স্বপ্ন-সাধ একেবারে উবে গেছে তাদের। রাজউককে এসব জানিয়ে কোনো লাভ হচ্ছে না। এখানে যার ক্ষমতা আছে, তার কথামতোই চলতে হচ্ছে অন্যদের। তাছাড়া রাজউকের কাজও হয়েছে নিম্নমানের। সে কারণেও হতাশ তারা।
উত্তরার ১৮ নম্বর সেক্টরে গড়ে ওঠা রাজউকের অ্যাপার্টমেন্ট প্রকল্পের ছয় হাজার ৬৩৬ ফ্ল্যাটের মধ্যে প্রায় পাঁচ হাজার ফ্ল্যাট বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। হাজারখানেক বাসিন্দা ইতোমধ্যে উঠেও গেছেন। কিন্তু ভুক্তভোগীরা বলছেন, সেখানে ব্যবস্থাপনা বলে একেবারে কিছুই নেই।
ফ্ল্যাট মালিকরা জানান, ২০১৯ সালের ২৬ নভেম্বর রাজউকের প্রকল্প পরিচালক মোজাফফর উদ্দিন ফ্ল্যাট মালিক অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা আলী কদরকে সভাপতি ও আরেক ফ্ল্যাট মালিক ঝুট ব্যবসায়ী জহিরুল ইসলাম রায়হানকে সাধারণ সম্পাদক করে এক বছরের জন্য একটি অস্থায়ী ব্যবস্থাপনা কমিটি গঠন করে দেন। কমিটি গঠনের পরই জহিরুল ইসলাম রায়হান প্রত্যেক ফ্ল্যাট মালিকের ওপর মাসে এক হাজার টাকা করে সার্ভিস চার্জ (পানি, ঝাড়ূ ও কমন বিদ্যুৎ বিল) আরোপ করেন এবং তা তুলতে শুরু করেন। অথচ কোনো ভবনই রাজউক ফ্ল্যাট মালিকদের সম্পূর্ণ বুঝিয়ে দেয়নি। কারণ প্রকল্পের অনেক কাজই বাকি। বুঝিয়ে না দেওয়া পর্যন্ত এসব বিল রাজউকের বহন করার কথা।
ফ্ল্যাট মালিকের কাছ থেকে এভাবে সার্ভিস চার্জ আদায়ের ব্যাপারে আপত্তি তোলেন সভাপতি আলী কদর। তিনি এও বলেন, প্রয়োজনে এই টাকার জন্য তিনজনের নামে একটি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলা হোক। কিন্তু তাতে রাজি হননি রায়হান। এতে আলী কদর দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়ান। জহিরুল ইসলাম এই সুযোগে তার সঙ্গে যুক্ত করেন আরেক ফ্ল্যাট মালিক ঝুট ব্যবসায়ী মোবাশ্বের আলী খাদেম বাবুকে। তিনি আবার বিমানবন্দর থানা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি। এরপর দু'জনে মিলে শুরু করেন অনিয়মের রাজত্ব। প্রথমেই তারা আলী কদরকে লিফটের মধ্যে নিয়ে লাঞ্ছিত করেন।
সি ব্লকের আরেক ফ্ল্যাট মালিক জাকারিয়া হাবিব বলেন, তাদের এসব কাজের প্রতিবাদ করায় আমাকেও মারতে এসেছিলেন। আমার ড্রাইভারকেও মেরেছেন। ভাবছি অন্যখানে গিয়ে ভাড়া থাকব। কয়েকদিন আগে ফ্ল্যাট মালিক আব্দুল হামিদকে মারধর করেন খাদেম বাবু। তিনি তুরাগ থানায় একটি সাধারণ ডায়েরিও করেছেন। তিনি বলেন, যারাই সার্ভিস চার্জের টাকা দিতে আপত্তি করেন, তাদের ওপরই ওরা হামলা চালায়। পথেঘাটে অপদস্থ করেন। সন্ত্রাসীদের নিয়ে গেটে বসে থাকেন। কেউ ঢুকতে গেলেই মারধর করেন।
কয়েকদিন আগে খাদেম বাবু আমার পথরোধ করেন। আমাকে অপহরণের জন্য টানতে টানতে গেটের বাইরে নেওয়ার চেষ্টা করেন। আমাকে মারধর করেন। কোনো রকমে তার কাছ থেকে ছুটে আসি। রায়হানের ইঙ্গিতেই এটা করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেন তিনি।
একইভাবে নাজেহাল করা হয়েছে অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিব রতন চন্দ্র ভৌমিক, বিসিএস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন একাডেমির সাবেক ট্রেইনার ইমদাদুল হক, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (বাকসু) সাবেক ভিপি আব্দুস সালামকেও। আব্দুস সালাম সেখানে থাকা বাদ দিয়ে বাড়িতে চলে গেছেন। এসব দেখে অন্যরা আর ভয়ে কিছু বলার সাহস পাচ্ছেন না।
ভবনের বাসিন্দারা জানান, প্রত্যেক ফ্ল্যাট মালিকের কাছ থেকে এক থেকে দেড় হাজার টাকা আদায় করেন রায়হান ও খাদেম বাবু। কোনো রসিদও দেন না। এভাবে প্রত্যেক মাসে পাঁচ-সাত লাখ টাকা তুলছেন তারা। ওই টাকায় মূল গেটে কেবল দু'জন নিরাপত্তারক্ষী রেখেছেন ২০ হাজার টাকা বেতনে। বাকি টাকা তারা আত্মসাৎ করছেন। আশপাশের খোলা জায়গায় দোকান-নার্সারি বসিয়ে ভাড়া বাণিজ্যও করছেন তারা। ইচ্ছেমতো যেখানে সেখানে আম-কাঁঠাল গাছ লাগাচ্ছেন। সবজির চাষ করছেন।
এসব প্রসঙ্গে জহিরুল ইসলাম রায়হান বলেন, যারা সার্ভিস চার্জ দেন না, তারাই এসব কথা বলেন। ঢাকা শহরে একটি বিল্ডিংয়ে থাকতে গেলে চার-পাঁচ হাজার টাকা সার্ভিস চার্জ দিতে হয়। অথচ হামিদ সাহেব একটি টাকাও সার্ভিস চার্জ দেন না। তিনি নিয়মিত থাকেনও না। তিনি একজন বিতর্কিত লোক। আর কাউকেই মারধর করা হয়নি। বলা হয়েছে, আসুন, আলোচনা করি।
খাদেম বাবুও বলেন, তিনি কাউকে কোনো মারধর করেননি। তারা এসব মিথ্যা কথা ছড়াচ্ছেন।
প্রকল্প পরিচালক মুজাফফার উদ্দিন বলেন, ওখানে গঠন করা কমিটির মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। যেসব অব্যবস্থাপনার কথা বাসিন্দারা বলছেন, এগুলোকে একটি নিয়মের মধ্যে আনার জন্য শিগগিরই নোটিশ দিয়ে দেবো। আর যেখানে সেখানে কেউ গাছপালা লাগালে সেটি ভবিষ্যতে তাদের জন্যই ক্ষতির কারণ হবে। এ ব্যাপারেও একটি নোটিশ দেওয়া হবে। আরও যদি কিছু করার থাকে, তাও করা হবে।
ফ্ল্যাটের কাজের মানেও অখুশি :ফ্ল্যাটের বাসিন্দারা বলেন, যেখানে দরজার চৌকাঠ-পাল্লা দেওয়ার কথা সেগুন কাঠের, সেখানে দেওয়া হয়েছে গামারি, প্লাইউড কিংবা প্লাস্টিকের। উন্নত ফিটিংসের পরিবর্তে দেওয়া হয়েছে অতি সাধারণ মানের ফিটিংস। বৈদ্যুতিক সরঞ্জামের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। টাইলস দেওয়া হয়েছে খুবই সাধারণ মানের। লিফটের ক্ষেত্রেও একই ব্যাপার। ভেতরের রঙও সাদামাটা। গ্যাস সংযোগের জন্য টাকা নেওয়া হলেও তা দেওয়া হয়নি। অথচ একেকটি ফ্ল্যাটের দাম পড়ছে প্রায় পৌনে এক কোটি টাকা।
তারা বলছেন, যেসব সামগ্রী ব্যবহার করা হয়েছে, সেগুলো টেকসই নয়। অনেক জিনিসপত্র ভেঙেও যাচ্ছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন বরাদ্দপ্রাপ্ত জানান, রাজউক ফ্ল্যাটপ্রতি ইউটিলিটি ফি (পানি, বিদ্যুৎ, গ্যাস সংযোগ) বাবদ নিয়েছে দুই লাখ টাকা। কিন্তু এখন সিলিন্ডারের গ্যাস ব্যবহার করতে হচ্ছে। তাও সেটি বসাতে হচ্ছে রান্নাঘরে।
সরেজমিন দেখা যায়, প্রধান দরজা ও চৌকাঠে এমন গাঢ় রং ব্যবহার করা হয়েছে যে, বোঝার উপায় নেই সেটি কী কাঠ। বারান্দার দরজাগুলোর ফিটিং বেশ দুর্বল। অনেক স্থানে ইতোমধ্যেই ফাঁকা হয়ে আছে। টয়লেটে ব্যবহার করা হয়েছে সাধারণ মানের প্লাস্টিক ডোর। দরজার ছিটকিনিগুলোও খুবই দুর্বল। দুই ফুট বাই দুই ফুট আকারের টাইলস ব্যবহার করা হলেও রঙ ও মান দুর্বল। বিদ্যুতের সুইচ বোর্ড, ফ্যানের রেগুলেটর, কলিং বেলের সুইচ, জানালায় ব্যবহূত কাচ, পর্দা ফিটিংস একেবারেই সাধারণ। সিড়ির রেলিংয়ের অনেক স্থানেই মরিচা ধরে গেছে।
একজন ফ্ল্যাট মালিক বলেন, উত্তর দিকে যারা ফ্ল্যাট পেয়েছেন, তারা কখনও সূর্যের আলো পান না। অথচ তাদেরও একই দাম ধরা হয়েছে। তারা এখন কিছুই বলতে পারছেন না।
এসব প্রসঙ্গে প্রকল্প পরিচালক মোজাফফর উদ্দিন বলেন, এগুলো আগে করা হয়েছিল। তখন তিনি পিডির দায়িত্বে ছিলেন না। এখন মান বজায় রেখে কাজ করা হচ্ছে। যদি কারও পছন্দ না হয়, তিনি বদলেও নিচ্ছেন। ঠিকাদারের মিস্ত্রি দিয়ে ঠিকও করিয়ে নিচ্ছেন।