রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নিরাপত্তা নিশ্চিতে শর্ষের মধ্যেই ভূত
ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ২৯ অক্টোবর,শনিবার,২০২২ | আপডেট: ০৬:৩০ এএম, ২৫ ডিসেম্বর,
বুধবার,২০২৪
বাংলাদেশ-ভারত যৌথ উদ্যোগে নির্মিত সুন্দরবন সংলগ্ন রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্পের সুরক্ষা এক দশকেও নিশ্চিত করা যায়নি। নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা সংস্থাগুলোই এখন হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতিনিয়ত প্রকল্প এলাকা থেকে তামার তার, জিআই পাইপ, রড, লোহার পাইপ, অ্যালুমিনিয়াম টিন শিটের মতো গুরুত্বপূর্ণ সরঞ্জাম চুরি ও পাচার হচ্ছে। পুলিশ, আনসার ও বেসরকারি সংস্থা মিলিয়ে প্রকল্পে ২৭০ নিরাপত্তাকর্মী থাকলেও ঠেকানো যাচ্ছে না চুরি। পুরো প্রকল্প ঝুঁকিতে পড়লেও দায় নিচ্ছে না কেউ। অভিযোগ রয়েছে, কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী, শ্রমিক ও নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা সংস্থাগুলোর কর্মীরা চোরদের সহায়তা করছেন।
এ বিষয়ে রামপাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের উপব্যবস্থাপক আনোয়ারুল আজিম বলেন, 'প্রকল্পের বড় অংশের নিরাপত্তার দায়িত্ব জেরিন সিকিউরিটি সার্ভিসের। আনসার ব্যাটালিয়ন, সাধারণ আনসার ছাড়াও পুলিশ রয়েছে। কিন্তু চুরির ঘটনা বেড়েই চলেছে। আমরা এসব সংস্থাকে সতর্ক করেছি। স্থানীয় প্রশাসনকেও বহুবার বলেছি।' তিনি আরও বলেন, 'দ্রুতই উৎপাদনে যাবে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র। তখনও এসব চলতে থাকলে ভয়াবহ পরিস্থিতি হতে পারে। এখন সময় এসেছে বিকল্প চিন্তা-ভাবনা করার।'
প্রকল্প সংশ্নিষ্টরা জানান, বাগেরহাটের রামপাল উপজেলার বিদ্যুৎ প্রকল্পটির এ বছরই বাণিজ্যিক উৎপাদনে যাওয়ার কথা। ভারত সফরে গত ৬ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে নিয়ে প্রকল্পের একটি ইউনিট উদ্বোধন করেন। এর পর থেকে এগিয়ে চলেছে ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদনের প্রস্তুতি। তবে প্রকল্পের বিস্তীর্ণ এলাকায় সীমানাপ্রাচীর না থাকা, দক্ষ নিরাপত্তাকর্মীর অভাব, অরক্ষিত নদীপথ, ভেতরের লোকজন চুরি ও পাচারে জড়িত থাকায় নিরাপত্তা ঝুঁকিতে রয়েছে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি।
চলতি বছরের মে থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ছয় মাসে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে খোয়া যাওয়া প্রায় অর্ধকোটি টাকার মালপত্র উদ্ধার করেছে র্যাব-৬। এসব সরঞ্জামের মধ্যে রয়েছে তামার তার, লোহার পাইপ, জিআই পাইপ, কপ্টার টিন প্রভৃতি। এ সময় চোর চক্রের ১৯ সদস্যকে আটক করা হয়। প্রায় একই সময়ে চুরি যাওয়া বিদ্যুৎকেন্দ্রের ৪১ কোটি টাকার সরঞ্জাম ও ২৫ চোরকে আটক করেছে আনসার ব্যাটালিয়ন। সরকারি দুটি বাহিনীর পাশাপাশি বেসরকারি জেরিন সিকিউরিটি সার্ভিসের সদস্যরা ৪০ লাখ টাকার মালপত্র জব্দ ও ৫০ চোরকে আটক করার কথা জানিয়েছেন। তবে তাদের অনেকেই জামিনে এসে একই কাজ করছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিদ্যুৎকেন্দ্রের এক কর্মকর্তা জানান, বিদ্যুৎকেন্দ্রের ৯১৫ একর জায়গার মধ্যে ৪৫০ একরে সীমানাপ্রাচীর, বাকিটা ফাঁকা। ভেতরে জঙ্গল তৈরি হয়েছে। কাঁটাতারের অবস্থাও নাজুক। দীর্ঘ নদীপথ অরক্ষিত। নিরাপত্তাকর্মীর ঘাটতি রয়েছে। বেসরকারি নিরাপত্তাকর্মীরাও প্রশিক্ষিত নন। ফলে চুরি ঠেকানো সম্ভব হচ্ছে না বলে জানান তিনি।
সূত্র জানায়, নদীপথে ইঞ্চিনচালিত নৌযানে বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালপত্র চুরি করে খুলনাসহ বিভিন্ন অঞ্চলে নিয়ে যাওয়া হয়। আবার কেন্দ্রে আসা ট্রাকে করেও কৌশলে যন্ত্রাংশ সরানো হয়। চালক-হেলপাররা কথা মতো জায়গায় এসব পৌঁছে দেন। রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের নিরাপত্তায় ৭৫ আনসার ব্যাটালিয়ন, সাধারণ আনসার ৩০, পুলিশ সদস্য ১৫ ও জেরিনের ১৫০ কর্মী নিয়োজিত। কিন্তু তাঁদের মধ্যে কোনো সমন্বয় নেই। এককভাবে কোনো সংস্থাকে নিরাপত্তা নিশ্চিতের দায়িত্বও দেওয়া হয়নি। ফলে কোনো ঘটনা ঘটলে কাউকেই জবাবদিহি করা সম্ভব হচ্ছে না। এরই সুযোগ নিচ্ছে চোর চক্র।
এক মাস পর জামিনে মুক্ত চোর চক্রের এক সদস্য সমকালকে বলেন, আমরা এলাকার অনেকেই বিদ্যুৎকেন্দ্রে শ্রমিকের কাজে যাই। কেন্দ্রের স্থায়ী শ্রমিকদের সঙ্গে আমাদের সখ্য আছে। তাঁদের দেওয়া তথ্যে চুরি করি। আবার অনেক সময় নদীর পাশ দিয়ে ভেতরে ঢুকে চুরি করি। এখানে চুরি করা সহজ ও লাভজনক।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিদ্যুৎকেন্দ্রের এক কর্মকর্তা বলেন, দৈনিক মজুরিভিত্তিক শ্রমিকদের প্রবেশে তেমন নিয়ন্ত্রণ নেই। তবে এটি সত্য, কেন্দ্রের ভেতর থেকে সহায়তা ছাড়া চুরি করা বেশ কঠিন। কারণ, কিছু টেকনিক্যাল জিনিস আছে, যা খুলতে হলে স্থায়ী শ্রমিকদের লাগবে। প্রকল্প অনিরাপদ হলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কোনো মাথাব্যথা নেই। যাদের বড় অংশের নিরাপত্তার দায়িত্ব, তারাই বেশি অবহেলা করে বলে জানান তিনি।
জেরিন সিকিউরিটি সার্ভিসের জেনারেল ম্যানেজার (প্রশাসন) মিয়া মুসা আলী বলেন, আমাদের কর্মীদের কর্তৃপক্ষ নির্ধারিত পোস্টে দায়িত্ব দেয়। প্রকল্পের সার্বিক নিরাপত্তা দেওয়া আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। অনেকে জেরিনের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে পার পেতে চায়, এটা ঠিক নয়। নিরাপত্তা বাহিনীগুলোর মধ্যে সমন্বয় ছাড়া কোনোভাবেই চুরি ঠেকানো যাবে না।
রামপাল থানার ওসি মোহাম্মদ শামসুদ্দিন বলেন, শর্ষের মধ্যেই ভূত আছে। এখানকার কর্মীরাই এসব অপকর্মে জড়িত। আমরা বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে শতাধিক ব্যক্তিকে চুরির অভিযোগে ধরেছি। ফলে আগের চেয়ে চুরি কমেছে।
খুলনা আনসার ব্যাটালিয়ন-৩-এর অধিনায়ক চন্দন দেবনাথ বলেন, সঠিক নিরাপত্তা নিশ্চিতে কেন্দ্রে অন্তত এক ব্যাটালিয়ন আনসার দরকার। সঙ্গে দ্রুত সীমানাপ্রাচীর নির্মাণ ও পশ্চিমে প্রায় দুই কিলোমিটার অরক্ষিত নদীপথে নজরদারি বাড়াতে হবে।