শ্যামা কাহন
ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ২ মার্চ,রবিবার,২০২৫ | আপডেট: ১০:৪১ এএম, ১২ মার্চ,
বুধবার,২০২৫

ঘাট লাগোয়া ঘুমটি ঘরের বস্তি
ওখানেই থাকে ওরা।
ফেরিঘাটের রাস্তার পাশে
বিচ্ছিন্ন বিচরন।
হাতে শ'দুয়েক গুঁজে দিয়ে
চায়ের টং এর সাইড বেঞ্চে।
বিরাশির এক ভরা দুপুরে
কিছু কথা তাহার সনে -
মেয়ে তোমার নাম কি?
-শ্যামা
শ্যামা কেন! তুমি তো ফর্সা।
-কি জানি বাপু!
মা রেখেছিল তাই।
বাবা কোথায়?
-ওতো জন্মের আগেই চলে গেছে।
মানে?
-পরপারে।
আর মা!
-সেও বাবার কাছে চলে গেছে।
তা শ্যামা কেন!
মাকে জিগ্যেস করেছিলে কখনো।
-কোন এক অমাবস্যার নিশিরাতে,
এটুকুই বলেছিল।
এখন কর কি?
-কি আর করি।
গতর খাটাই।
সে আবার কি?
-কেন জানো না!
মেয়েদের আছে তো ওটাই।
একটু খুলে বলবে কি?
-কি আর বলি!
পাড়ার মন্টু মামা।
সে আবার কে?
-ওতো আমাদের গুড়িপাড়ার
কমন মামা গো।
গুড়িপাড়া! এ আবার কেমন নাম।
-ওটাইতো আমার জন্মের ঠিকুজি।
একটু খুলে বলবে কি?
- পদ্মাপাড়ের গোটা বিশেক বস্তিঘর।
জেলে বাইদ্যা আর মাঝিদের
মাথা গোঁজার ঠাঁই।
তারপর!
-আর শুনতি চেয়ো নাগো বাপু,
সে এক বিরস কাহিনী।
কবেকার কথা?
-এইতো সেদিন।
তখনও পাকিস্তান।
শুনেছি পঁয়ষট্টির যুদ্ধের পর
ওপারে আকাল লেগেছিল।
ছাপড়া দ্বারভাঙ্গার
অর্ধাহার অনাহারের মানুষগুলো-
বৌ-বাচ্চা নিয়ে নৌকা ভাসিয়ে
নোঙ্গর করে - এই পদ্মার চরে।
সেতো হোল!
কিন্তু গুড়িপাড়া নামটা?
-বস্তির বয়েস তখন
বছর ছয় হবে।
আমি তখন সাত ছুঁই ছুঁই
রত্না আমার বয়সীই হবে।
ওর মা ছিল দুধে আলতায় সুন্দরী।
যাক বাপু, ওসব না শুনা ই ভাল।
নাহ্ বল। না বললে
জানবো কেমন করে!
-শুনে হবেটা কি!
খাওন পরন দেবে কি?
সেই তো গতর খাটিয়েই
খেতে হবে।
তবুও বল-
-এসব শুনে কি করবা।
আমাদের কান্না কি এতে থামবে!
বন্ধু মনে করেই বল।
-আমাদের আবার বন্ধু!
এক - আধ ঘন্টার মেহমান।
তারপর নতুন কেউ।
গতরটা যতক্ষন আছে!
ভালই বলেছো।
তবুও মনের কথা, জীবনের কথা।
-আমাদের আবার জীবন। মন!
সেতো কবেই মরে গেছে।
ঠিক আছে, একটু হলেও বল।
-কি যে বলি-
সেই যে যুদ্ধ লাগলো।
মন্টু মামা শহরে আসা যাওয়া করে।
তিনিই একদিন - খান সেনাদের
বস্তিতে এনেছিল।
তারপর?
-তারপর আর কি,
জুলি কাকিকে (রত্নার মা)
ক্যাপ্টেন সাহেবের চোখে ধরলো।
ব্যাশ! আমরা ব্যাঁইচা গেলাম।
রত্নাকে সে গুড়িয়া বলে ডাকতো।
এক সময় বস্তির নাম দিল গুড়িয়াচক
ওটাই এখন গুড়িপাড়া।
তা তুমি এখানে কিভাবে?
-এটাও মন্টু মামার অবদান।
অবদান! বিরাট প্রাপ্তি মনে হচ্ছে।
-তাছাড়া আর কি!
দেশ স্বাধীন হোল।
পিতামাতা হারা এতিম মেয়েটা
দিনে দিনে ডাঙ্গর হচ্ছে।
গায়ে গতরে ভালই ছিলাম।
মন্টু মামা আমাকে নিয়ে
নৌকা ভাসালেন।
ভাসতে ভাসতে নাও
এসে থামলো -
এই ঘাটে।
তারপর?
-সোজা শান্তি মাসির খোয়াড়ে।
শান্তি মাসী! সে আবার কে?
-ওইই তো সব।
যত অশান্তির আখড়া।
গতর খাটানীদের খোয়াড়ের মনিব।
লেখাপড়া করেছ কিছু?
-আমাদের আবার লেখাপড়া।
নাম দস্তখত আর -
বাংলাটা পড়তে পারি।
গুড়িপাড়ায় যা শিখেছিলাম।
চুয়াত্তরের মড়ক আমাকে
এই নরকে আনলো।
বাইরে যাওয়া হয়-
-নাহ্। এটাই আমাদের জগত।
এই যে ঘাট নদি আর চর।
আর ওইসব ঘুমটি ঘর।
এটাই আমাদের সব।
তো এভাবেই চলবে!
-তাছাড়া গতি কি।
জুয়ান হইছি। বুড়ি হব।
ব্যারামে পড়বো,
জ্বর হবে, কাশি হবে,
হঠাৎ করে বিছানা নেব।
ব্যাশ, তারপর ওপারে!
সরকারী কোন সাহায্য?
-নাহ্!
এনজিওরাই আমাদের ভরসা।
ডাক্তার বদ্যি পথ্য ওরাই করে।
তোমাদের ভবিষ্যত?
-আমাদের আবার ভবিষ্যত।
ভবিষ্যত তো ওদের।
গঞ্জের গালকাটা মনির,
চেয়ারম্যান কাজেম শেখ
আর থানার পুলিশ বাবুরা।
মানে?
-হ্যাঁ, তাইতো দেখছি।
শুক্রবারে চাঁদের হাট বসে গো।
হপ্তা নেয়ার দিনকাবাড়ী
সকাল বিকাল সন্ধ্যা দলবেঁধে আসে।
তখন বুঝতে অসুবিধা হয়না,
ওদের ওই হাট্টাগোট্টা চেহারার
আসল রহস্য।
আর কিছু!
-আছে তো।
নতুন কেউ এলে
ওটার ফিতা তো
ওরাই কাটে আগে।
ওদেরকে সন্তুষ্ট করার
মাসীর কৌশল।
নিজের শেষ কথা?।
-ধর্ম বলে কিছু নেই।
গতরটাই আমাদের ধর্ম।
জয় মা কালী - আহে লিল্লাহই
আমাদের শেষ কথা।
ভাল থেক শ্যামা!
-জি, আপনিও।