৬ মাসে ফেসবুকে প্রতারণার শিকার ঢাবির ৫৬ ছাত্রী
ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ০১:২৫ পিএম, ৭ জানুয়ারী,বৃহস্পতিবার,২০২১ | আপডেট: ০৮:৫৩ পিএম, ২১ ডিসেম্বর,শনিবার,২০২৪
ইভা (ছদ্মনাম) নামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ব্যবসায় অনুষদের এক ছাত্রীর ফেসবুক আইডি হ্যাক করে তার কিছু স্পর্শকাতর ছবি সংরক্ষণ করে রেখে দেয় এক প্রতারক। ছাত্রীর গোপনীয় ছবিগুলো পেয়ে পরবর্তীতে তাকে বিভিন্নভাবে ব্ল্যাকমেইল করে টাকা দাবি করতে থাকেন তিনি। দাবিকৃত টাকা না পেলে ছবিগুলো ফেসবুকে ও আত্মীয় স্বজনের কাছে ছড়িয়ে দিবে বলে হুমকি দেয় সেই প্রতারক।
কোন উপায় না দেখে সম্প্রতি ওই ছাত্রী ঢাবির সাবেক ও বর্তমান শিক্ষার্থীদের সমন্বয়ে গড়ে উঠা সংগঠন ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিরাপত্তা মঞ্চ’কে জানায় বিষয়টি। তারা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তায় সেই প্রতারককে গ্রেপ্তার করা চেষ্টা করছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বেচ্ছাসেবী এ সংগঠনটির সর্বশেষ তথ্য বলছে, গত জুন থেকে এ পর্যন্ত ফেসবুকে ব্ল্যাকমেইলিংয়ের শিকার হয়েছেন এমন ৫৬টি অভিযোগ তাদের কাছে এসেছে। সবকটি ঘটনায় তারা ভুক্তভোগী ছাত্রীদের সহায়তা দিয়েছে। এক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তায় প্রতারকদের গ্রেপ্তার করা হয়ে থাকে।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) অধীনে পরিচালিত কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইমের সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন ডিভিশন এসব অভিযোগ তদন্ত করে প্রতারকদের গ্রেপ্তারের মাধ্যমে আইনী ব্যবস্থা নিয়ে থাকে। সংস্থাটি বলছে, তাদের কাছে যেসব অভিযোগ আসে তার ৩০ শতাংশই এমনই।
সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন ডিভিশনের তথ্য মতে, অধিকাংশ সময় ভুক্তভোগীরা আইনের সহায়তা নেয়ার গুরুত্ব খুব কমই অনুভব করেন। তবে কেউ যদি আইনের সহায়তা নেয় তাহলে প্রতারকদের বেশিরভাগ ক্ষেত্রে খুঁজে বের করা সম্ভব হয়। এরকম কেউ প্রতারিত হলে সাথে সাথে সংশ্লিষ্ট থানায় সাধারণ ডায়েরি করে (জিডি) সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন ডিভিশনে যোগাযোগ করা জন্য অনুরোধ করা হয়েছে।
গত ১ নভেম্বর ঢাবির এক ছাত্রীর আপত্তিকর ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে দেওয়ার অভিযোগে মোহাম্মদ মোফাজ্জল সাদাত নামে একই বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। পরে তার বিরুদ্ধে ডিজিটাল সিকিউরিটি আইন ও পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলা করা হয়।
জানা যায়, করোনার প্রার্দুভাবের শুরুর দিকে মোহাম্মদ মোফাজ্জল সাদাত নামে ঢাবির রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের ২০১৮-১৯ সেশনের ওই ছাত্রের সঙ্গে প্রেমের সর্ম্পক গড়ে উঠে ভুক্তভোগী ছাত্রীর। এসময় ক্যাম্পাস বন্ধ থাকায় বিভিন্ন সময়ে ফেসবুকে তাদের মধ্যে চ্যাটিং, ভিডিও ও অডিও কথাবার্তা চলতো। একপর্যায়ে তাদের মধ্যে গভীর প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠলে ওই ছাত্রীর সরলতার সুযোগ নিয়ে ইমোশনাল কথাবার্তা বলে সাদাত নগ্ন ছবি দেখাতে বলত। ওই ছাত্রী ‘সরল বিশ্বাসে’ তার এ প্রস্তাবে রাজি হয়ে এসব প্রদান করে। পরে এসব আপত্তিকর ছবি সাদাত তার ফোনে সংগ্রহ করে রেখে দেয়।
এরপর তাদের সর্ম্পকের মধ্যে মনোমালিন্য সৃষ্টি হলে ওই ছাত্রীর আপত্তিকর ছবিগুলো ফেসবুকের ফেক আইডি দিয়ে আপলোড করে সাদাত। পরে বিষয়টি জানতে পারলে আইনী সহায়তা চেয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিরাপত্তা মঞ্চের সহায়তা কামনা করেন। পরবর্তীতে ওই মঞ্চের সহায়তায় শাহবাগ থানায় মামলা করে টিএসসি থেকে ওই ছাত্রকে আটক করা হয়।
ভুক্তভোগী ওই ছাত্রী তখন দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেছিলেন, ফেইক আইডি থেকে তার সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে উঠে। মাস তিনেক আগে যখন জানতে পারি সে আসলেই ভুল পরিচয় দিয়েছে, তখন ব্রেকআপ করার সিদ্ধান্ত নিই। এরপর তার সাথে সব ধরনের যোগাযোগ বন্ধ করে দিলে ছবিগুলো ফেসবুকে প্রকাশ করে। তখন আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র ভাইদের সহযোগিতা নিয়ে থানায় মামলা করি।
সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়টির একাধিক ছাত্রী এ ধরনের প্রতারণার শিকার হয়েছেন বলে জানিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিরাপত্তা মঞ্চের অন্যতম স্বেচ্ছাসেবক আরাফাত চৌধুরী। তিনি রবিবার (৩ ডিসেম্বর) দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, গত জুন থেকে এ পর্যন্ত ফেসবুকে ব্ল্যাকমেইলিংয়ের ৫৬টি ঘটনা ঘটেছে। ভিকটিমরা পরিচিত ও অপরিচিতদের মাধ্যমে এ ধরণের ঘটনার শিকার হন। তবে অপরিচিতদের সংখ্যাটা বেশি। ভিকটিমরা আমাদের বিষয়গুলো জানানোর পর সংশ্লিষ্ট আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাথে যোগাযোগ করে প্রতারকদের খুঁজে আইনের আওতায় আনার চেষ্টা করি। সেক্ষেত্রে সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন সহায়তা করে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের এক ছাত্রীর কিছু স্পর্শকাতর ছবি নিয়ে তাকে দীর্ঘদিন ধরে ব্ল্যাকমেইল করেছিল এক দুষ্কৃতিকারী। ছাত্রীটি দুষ্কৃতিকারীর কাছে বার বার অনুরোধ সত্ত্বেও তাকে ব্ল্যাকমেইল করা বন্ধ করেনি। ঐ দুষ্কৃতিকারী মেয়েটির কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা দাবি করতে থাকে এবং তার কাছ থেকে বেশ কয়েক দফা টাকা নিয়েও তাকে ব্ল্যাকমেইল করা চালিয়ে যেতে থাকে। এই মানসিক যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে মেয়েটি কয়েকবার আত্মহত্যার চেষ্টা করে।
এ ব্যাপারে আরাফাত চৌধুরী বলেন, কোন উপায় না দেখে সম্প্রতি ওই ছাত্রী বিষয়টি আমাকে জানায়। বিষয়টি নিয়ে আমি সিআইডির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে জানিয়ে দ্রুত আইনের আওতায় আনার অনুরোধ করি। পরবর্তীতে বিষয়টিকে গুরুত্ব সহকারে নিয়ে অক্লান্ত পরিশ্রম করে ওই দুষ্কৃতিকারিকে গ্রেফতার করে পুলিশ। তার কাছ থেকে স্পর্শকাতর ছবিগুলো ডিলিট করে হয়। সর্বশেষ দোষীর বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের সদ্য সাবেক জিএস ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিরাপত্তা মঞ্চের প্রতিষ্ঠাতা জুলিয়াস সিজার তালুকদার সম্প্রতি ফেসবুকের এক পোস্টে লেখেন, এক ছাত্রীর নগ্ন ছবি ভার্চুয়াল মাধ্যমে ধারণ করে তার প্রেমিক। প্রেমিককে সে বিশ্বাস করেছে। পরে অন্য বন্ধুর মাধ্যমে ওই ছেলের আরেকটি সম্পর্কের কথা জানতে পেরে মেয়েটি ভবিষ্যত প্রতারণার শিকার হওয়ার ভয়ে বিধ্বস্তপ্রায় অবস্থায় আমার সাথে যোগাযোগ করে। পরে ছেলেটিকে বাড়ি থেকে ঢাকায় ঢেকে এনে তার কাছে সংরক্ষিত সব ছবি মুছে দেয়া হয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত সে ছবির কোন অপব্যবহার করেনি বলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।
সিআইডির অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মাহমুদুল ইসলাম তালুকদার দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, আমরা এ ধরেণের অভিযোগ নিয়মিতই পেয়ে থাকি। তবে অনেক সময় ভিকটিমরা এসব আমাদের জানাতে চায় না। এ ধরণের অপরাধের শাস্তি নিশ্চিত করতে ও প্রতিরোধের জন্য এগিয়ে না আসাটা একটা বড় সমস্যা।
মাহমুদুল ইসলাম তালুকদার বলেন, ভুক্তভোগীরা যদি এগিয়ে আসে তাহলে অপরাধ কমে যায়। যেমন- ঢাবি ক্যাম্পাসের ঘটনাগুলোতে শুরুতেই ১-২ জন গ্রেপ্তার হলে ৬ মাসে ৫৬টি ঘটনার পরিবর্তে ১০টিতে নেমে আসতো। তাছাড়া আমাদের সচেতনতার অভাবতো আছেই। দেখা যায় যে, অনলাইনে একজনের ব্যক্তিগত ছবি আরেকজনে কাছে শেয়ার করছি। এটা ঝুঁকিপূর্ণ। তারপর শেয়ার করছি এমন ব্যক্তির সঙ্গে যাকে কোন দিন সশরীরে দেখা হয়নি, পরিচয়ও নেই। এতে ভুক্তভোগীরা ব্ল্যাকমেইলিংয়ের শিকার হচ্ছে। তবে পরিচিতদের মধ্যে এ ধরনের ঘটনা খুবই কম হয় বলে জানান তিনি।
তিনি আরও বলেন, এসব ঘটনায় সবাইকে সচেতন হতে হবে। আইনের সহায়তা নেয়ার প্রবণতা থাকতে হবে। যদি কেউ আমাদের কাছে আসে তাহলে প্রতারককে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে খুঁজে বের করতে পারি এবং তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনী ব্যবস্থা নেয়া হয়।
গত এক বছরে কত ভিকটিম এ ধরণের শিকার হয়ে আইনের আশ্রয় নিয়েছেন, এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এ ধরনের পরিসংখ্যান আমাদের আছে তবে খোঁজ নিয়ে জানাতে হবে। তবে তাদের কাছে যেসব অভিযোগ আসে তার ৩০ শতাংশই এমনই বলে জানান পুলিশের এই কর্মকর্তা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক এ কে এম গোলাম রাব্বানী দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, যখনই এ সংক্রান্ত অভিযোগ আমরা পেয়ে থাকি তখন গুরুত্বসহকারে দেখে থাকি। এসব ঘটনা খতিয়ে দেখে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিয়ে থাকি। আবার শিক্ষার্থীরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তা নিলে আমরাও অনেক সময় বিষয়টির খোঁজ-খবর রাখি। তাছাড়া পরবর্তীতে ভিকটিমরা যাতে মানসিকভাবে সুস্থ থাকতে পারে এজন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে কেন্দ্রীয়ভাবে কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা রয়েছে।
তথ্য ও সাইবার নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠান ডিকোডস ল্যাবের এমডি ও সিইও এবং আইটি বিশেষজ্ঞ আরিফ মঈনুদ্দিন দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, এঅন্য ক্রাইমের চেয়ে ফেসবুকভিত্তিক ক্রাইম করাটা অনেক সহজ। শুধুমাত্র একটি ফেইক একাউন্ট খুলে যে কারও ছবি ও নাম দিয়ে এটা করা যায়। তিনি বলেন, করোনা মহামারিতে এটা আরও বাড়ছে। করোনাকালে মানুষের বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের অনেকের কোন কাজ নেই। তারা অন্যকোন সৃষ্টিশীল চিন্তা করতে পারছেন না। যখন তারা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা অন্য কোথাও যেতে পারছেন না তখন বাসায় বসে বসে ইন্টারনেট ব্যবহারের মাধ্যমে এ ধরণেন অপরাধের চিন্তা মাথায় আসে। তখন দেখা যাচ্ছে কেউ সময় কাটানোর জন্য সম্পর্কে জড়াচ্ছে, আবার কেউ কেউ ‘পার্ট টাইম রিলেশনে’ জড়াচ্ছে। ওই পার্ট টাইম সময়টুকুও আসলে বিপদের মূল কারণ হয়ে দাড়াচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, সবার ফেসবুকের একটা সিকিউরিটি আছে। ফেসবুকে অপরিচিত কোন ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট আসলে এক্সেপ্ট না করা, কাউকে নিজের ফেসবুকের পাসওয়ার্ড না দেয়া, প্রোফাইল লক করে রাখা, ব্যক্তিগত সিঙ্গেল ছবি ফেসবুকে না দেওয়া, অপরিচিত লিংকে ক্লিক না করা ইত্যাদির মাধ্যমে ব্ল্যাকমেইলিং থেকে রক্ষা পাওয়া যেতে পারে। তবে কেউ যদি এই ধরণের ঘটনার শিকার হয় তাহলে পরিবারের সদস্য ও বিশ্বস্ত বন্ধুদেরকে শেয়ার করা আর সংকটাপন্ন হলে পুলিশের সহায়তা নেয়ার পরামর্শ তার।
উৎসঃ দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস