জালাল উদ্দিন আহমেদ
শোনা কথার দুনা বল
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ২২ জুন, বুধবার,২০২২ | আপডেট: ০৯:৪৬ এএম, ২৫ ডিসেম্বর, বুধবার,২০২৪
এটি একটি প্রবাদ বাক্য। আবার কেউ এটাকে খনার বচনও বলে থাকেন। কিন্তু এই বাক্যটির যে কত মোহনীয় আবেদন তা আমরা টের পাই, যখন এইসব কথামালা সময়ের আবর্তে সামাজিক বিন্যাসে বিপর্যয় ডেকে আনে। এই শোনা কথা বা কানকথা, একান ওকান হতে হতে একসময় ক্যান্সারের ন্যায় ছড়িয়ে পড়ে সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার অলি গলিতে। তারপরেও আমরা শুনি এবং বেশ আগ্রহ নিয়ে এই শুনা বা বলার পর্বটা চলতে থাকে। এক সময় এইসব চটকদার এবং মুখরোচক কথকতা বাজারে চাউর হয়ে বিশ্বাস যোগ্যতায় এক'শতে এক'শ নম্বর নিয়ে মানুষের মনে স্থায়ীভাবে বাসা বাঁধে। আবার তথ্য উপাত্তমুলক কিছু কিছু কথা আছে যা মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দিয়ে সেসব নিয়েও বেশ তামাশা হয় এই সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থায়। তবে সুবিধাভোগী গোষ্টী একটি সুনির্দ্দিষ্ট দুরভিসন্ধি নিয়েই এসব করে বলে আমরা পরবর্তীতে জানতে পারি।
এই শুনা কথার তাৎক্ষনিক, স্বল্পমেয়াদী এবং দীর্ঘমেয়াদী ফল আমরা দেখতে পাই। তবে ফল বিচারে তাৎক্ষনিক ব্যাপারটা একটু অম্লমধুর হয় বলে আমরা জেনেছি। সেক্ষেত্রে যেহেতু তাৎক্ষনিক ভাবে শোনা কথাগুলি একটু চটকালো বা চটকদার হয়ে একান ওকান হয়, ফলে প্রায়শঃ ক্ষেত্রে তা জোশের পাল্লায় ভারী হয় বটে কিন্তু হোঁশের(হুঁশ) স্থায়িত্বে তা ক্ষনস্থায়ী হয়। সময়ের পরিক্রমায় সমাজ জীবনে ওসব শুনা কথা মূল্যহীন হয়ে পড়ে। পাশাপাশি শোনা কথার স্বল্পমেয়াদী প্রতিক্রিয়া সামাজ ও রাষ্ট্র পর্যায়ে খুব বেশী দাগ কাটতে না পারলেও ব্যক্তি পর্যায়ে সেসব কথাবার্তা বেশ স্থায়িত্ব নিয়েই বিচরন করে বলে আমরা জেনেছি। এসব নিয়ে ভুরি ভুরি উদারহারন বা ঘটনাপুঞ্জ সমাজ ও রাষ্ট্রে কথিত আছে যা সামাজিক ও রাজনীতির উঠানে বেশ শক্তপোক্তভাবেই চলাচল করে। ব্যক্তিগত স্ক্যান্ডাল থেকে শুরু করে সেটা হতে পারে পারিবারিক কিংবা বংশানুক্রমিক ঐতিহ্যের খেরোখাতা। তবে এসব শুনা কথার বল বা ক্ষমতা শুধুমাত্র আলোচনা সমালোচনা কিংবা ক্ষেত্রবিশেষে বক্তৃতা বিবৃতি এবং টেবিল টকের মুখরোচক উপমা হিসাবেই ব্যবহৃত হয়। তবে এসব শ্রূত কথামালার দালিলিক প্রমান উপস্থাপন করা বড়ই দুঃসাধ্য ব্যাপার।
সমাজ ও রাষ্ট্রজীবনে এমনকি আন্তঃরাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে এমন সব কথাবার্তা বা গল্প গুজবের কথা শ্রূত আকারে প্রচলিত আছে যা সমাজ এমনকি রাষ্ট্র বিন্যাসের কাঠামো বিনির্মানের সিঁড়ি হিসাবে ব্যবহৃত হতে দেখা যায়। শ্রূত বা শোনা কথার এসব গল্প বা প্লট এতই শক্তিশালী ভিত নিয়ে তৈরী করা হয় যার বিশ্বাস যোগ্যতার ঘাটতি নেই বললেই চলে। এসব প্রচলিত শোনা কথা সমাজ ও রাষ্ট্র কাঠামো বিন্যাস ও বিবর্তনেও প্রভাব ফেলে। এসব শোনা কথার উৎস এবং প্লট সমূহের ভিত্তি এতই শক্তপোক্ত যে সংসার সমাজ ও রাষ্ট্র কাঠামো বিন্যাসে তা বেশ প্রভাব ফেলে। হতে পারে সেটা রাষ্ট্র নায়কদের বা রাজনীতির স্টেক হোল্ডারদের সখ্যতা বা বৈরিতার চটকদার কল্পকাহিনী। হতে পারে তা গোষ্টী বা সম্প্রদায়গত বৈরিতা ছড়িয়ে সামাজিক ও রাষ্ট্র পর্যায়ের ফায়দা লুটে নেয়ার কোন ফন্দি ফিকির। আর আজ কালকার দিনে ধর্মীয় উস্কানীর বহুবিধ চটকদার কথা ও কাহিনী এমনভাবে শুনানো হয় যার সত্যতা যাঁচাই বাছাইয়ের পুর্বেই তা স্বতঃসিদ্ধতা পেয়ে যায়। সেক্ষেত্রে এসব শোনা কথার কার্যক্ষমতা দ্বিগুন মাত্রা নিয়ে সমাজ এমনকি রাষ্ট্র ব্যবস্থায় তার পদচারনায় সমুজ্জ্বল থাকে।
একজন পিতা তার উত্তর পুরুষদের উপদেশমূলক কথা বলে তাদের সামাজিক ও সাংসারিক দায়বদ্ধতা ও কর্তব্য পালনের শিক্ষা দিয়ে মনুষ্য আচরনের পরিপুর্নতায় বলিষ্ঠ করে গড়ে তুলেন। পাশাপাশি শিক্ষকও তেমনি তার ছাত্রদের সামাজিক মুল্যবোধ ও আর্থ সামাজিক রাজনৈতিক স্বচ্ছ্বতায় তাদের আলোকিত করেন। এসব হচ্ছে সরল রেখায় চালিত স্বচ্ছ ভাবে চলার সিঁড়ি পথ। কিন্তু চলার এই সিঁড়ি পথের ভাঁজে ভাঁজে রয়েছে অসংখ্য খাঁজকাটা কাঁচের টুকরো। এসব প্রতিবন্ধকতাকে জয় করেই আমাদের মানব জীবনের জয়গানে এগিয়ে যেতে হয়। কিন্তু মানব চরিত্র ব'লে কথা। এই মানব চরিত্রেই রয়েছে পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের বিশাল এক বলয়। যার প্রভাবে আমাদের আজকের আলোচ্য বিষয়ের গুরুত্ব অপরিসীম। সেক্ষেত্রে সমাজ ও ব্যক্তি জীবনে এই পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের গুরুত্ব বিবেচনায় আনা একান্তভাবে অপরিহার্য।
শোনা কথা নিয়ে কত যে উপাখ্যান এবং কল্পকথা তৈরী হয় তার কোন ইয়ত্বা নেই। এই যেমন ধরুন আমাদের ইদানীকার পদ্মা সেতু নিয়ে সৃষ্ট কথামালাগুলি। কত যে গল্প কাহিনী সৃষ্টি হয়েছে এবং এখনও সেই গালগল্প সমানে চলেছে। সেই আবুল হোসেন, মোশারফ ভুঁইয়া এখন কোথায়? অথচ এই স্বপ্নের সেতুর তৃণমূল পর্যায়ের সমস্ত কিছু কাজ তারাই করেছিলেন। অহেতুক ঘুষ চাওয়ার অভিযোগ তুলে তাদের যে সামাজিক ক্ষতি হলো তার অশ্রাব্য উচ্চারনগুলি তো এখনো আমাদের কানে কানে। আবার সেটাকে প্রলেপ দেয়ার জন্য বাঙালীর সবেধন নীলমনি নোবেল লরিয়েট ডঃ ইউনুসকে নিয়ে যে অভিযোগ তোলা হয় সেটাও তো আমাদের কানে ভো ভো করে। তারপর পদ্মার নির্মান ব্যয় নিয়ে চাউর হয়ে যাওয়া কান কথাগুলি আজকের সামাজিক মাধ্যমে ক্যান্সারের বিভিষিকায় রূপ নিয়েছে। আবার সেতু নির্মানের শর্ত হিসাবে মানুষের রক্ত, মানুষ বলি, মানুষের মাথার খুলি ইত্যাদি রূপকথার কল্পকাহিনী নিয়ে একসময় সরকারী যন্ত্রকে হিমশিম খেতে হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে দৃশ্যমান সেতুর দু'পাশে কিছু পাগলা ফকির ও গরীব মানুষের আনাগোনায় সেটাকে ভারতীয় 'র' এর নীলনক্সার শব্দও আমাদের কানে কানে ঘুরে ফিরছে। আবার ইদানীং একান ওকান হয়ে ঘুরে ফিরছে এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় ভালভাবেই এর ভাইর্যাল হয়েছে তা হচ্ছে বাংলাদেশে নাকি ১১ লক্ষ অবৈধ ভারতীয় অভিবাসী কর্মরত আছেন যারা বাংলাদেশ থেকে প্রতিমাসে দশ লক্ষ মার্কিন ডলার বেতন ভাতা হিসাবেই নিয়ে যাচ্ছে। অতিসম্প্রতি ভূ-রাজনৈতিক পরিমন্ডলে বাংলাদেশের অবস্থানকে নিয়েও হাজারো কথকতা চাউর হয়ে কানে কানে ঘুরে ফিরছে। বাংলাদেশ এমন এক শক্তিশালী দেশ হয়ে গেছে যে চীন- মার্কিন দহরম মহরমে আমরা যেন আসমান ছুঁয়ে বসে আছি। এর জন্য ভারত নাকি দেয়ালে কপাল ঠুঁকছে। কে যেন বলেছেন আমারিকার দিকে একটু ঝুঁকলেই তো আমেরিকা বাংলাদেশকে রাখাইন প্রদেশ দখল করিয়ে দেবে। তখন তো রোহিঙ্গা সমস্যা আর থাকবে না। আবার শোনা কথায় এটাও শোনা যায় "এই তো হলো বলে, তিস্তা প্রকল্পে চাইনীজ মেগা প্রজেক্ট চলাকালীনই জলপাইগুড়ির 'চিকেন নেক' চিন দখল নিয়ে নেবে। তারপর ইন্ডিয়ার সেভেন সিস্টার বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। তখন আসাম মিজো সমস্যা আর থাকবে না। সমাজ ও রাষ্ট্র জীবনে এহেন হাজারো শ্রুতি জাল বিস্তার ক'রে চলেছে যা কাল পরিক্রমায় সাধারন মানুষের উঠানে বিদ্যুতের মত ছড়িয়ে পড়ে।
কান কথা বা শুনা কথার যে কত জোশ তার টের পাই যখন কোন্ এক ঝড়ের সন্ধেয় বুড়ি গঙ্গায় সাধারন নৌকা ডুবির এক ঘটনাকে আমরা নবাব সিরাজউদ্দৌলার খালা ঘসেটি বেগমকে ডুবিয়ে মারার গল্প বানিয়ে ইতিহাস লিখি। খোদাভীরু দিল্লির দরবেশ সম্রাট ঔরংজেবকে জুলুমবাজ হিংস্র ইসলামী শাসক হিসাবে বিভিন্ন কল্পকথায় বর্ননা করতে দেখি। তার এক হাতে থাকতো কোরান আর অন্য হাতে তরবারি। ধর্মীয় রেশারেশির হিংস্র থাবায় কি সব জঘন্য কথাবার্তা!
এভাবেই বলা এবং শোনার অপভ্রংশ জমতে জমতে আজ আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রজীবনে উইপোকার ঢিপি গড়ে উঠেছে। আজকাল ব্যক্তি ও ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানেও এর ব্যাপক পসার দেখা যায়। কান কথা বা শোনা কথা এবং মিথ্যে ইতিহাসের পঠন পাঠন আজ ভারতীয় উপমহাদেশে ধর্মীয় হিংসার এক বিশাল উপকরন হয়ে আমাদের শাশ্বত সামাজিক বন্ধনকে ছিন্নভিন্ন করে ছাড়ছে। সুতরাং চিলে কান নিয়ে গেল বলে চিৎকার করতে করতে চিলের পিছনে না দৌড়ে আগে নিজের কানে হাত দিয়ে তার স্থিতিটা দেখে নেয়া বুদ্ধিমানের কাজ নয় কি?
সুখের বিষয়, আধুনিক এই প্রযুক্তির সময়ে শোনা কথার গুরুত্ব খুব বেশী কার্যকর হচ্ছেনা বলেই মনে হয়। এই যেমন ধরুন, আজকের দিনে টক অফ দ্যা ইউনিভার্স হচ্ছে নুপুর শর্মা। আধুনিক প্রযুক্তির কল্যানেই বিশ্ববাসী জীবন্ত বা জলজ্যান্ত ঘটনাটি শুনেছেন বা দেখেছেন। ফলে এটার লাইভ ভাইর্যাল হওয়ার পর মানুষের মধ্যে প্রতিক্রিয়া হয়েছে এবং নিয়ন্ত্রিত ভাবেই তা হয়েছে বা হচ্ছে। অথচ এই কথাটি যদি এক'শ বছর আগে ঘটতো তাহলে সেখানে বলা হোত অমুক জায়গায় অমুক ব্যক্তির এধরনের কথার জেরে তাৎক্ষনিকভাবে সেখানে সামপ্রদায়িক দঙ্গায় দু'শ মুসলমানকে কচুকাটা করা হয়েছে, তিন'শ হিন্দুর বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। তাদের এক নেতাকে জবাই করা হয়েছে ইত্যাদি ইত্যাদি সাম্প্রদায়িক বিষ ছড়ানো খবরাখবর। ফল স্বরূপ এই শোনা কথার জেরে সৃষ্ট দাবানলে সমগ্র ভারত বর্ষে আগুন জ্বলতো। ফলে এক ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ের সুত্রপাত হোত তখন। সুতরাং আধুনিক প্রযুক্তির কল্যানে এবং সোশ্যাল মিডিয়ার বদান্যতায় কানকথার গুরুত্ব আজকাল পানসে হয়ে যাচ্ছে - এতে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। তবে যা রটে তা কিছটা তো বটে। বিপরীতমুখী এই বচনকে গ্রাহ্যে এনে বলা যায় সংশোধনের পথ যখন উন্মুক্ত তখন এসব নিয়ে উচ্চবাচ্য না করাই শ্রেয়।