রাশেদুল ইসলাম
লক্ষ্যহীন জীবন
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ২১ নভেম্বর,রবিবার,২০২১ | আপডেট: ১০:৫৬ এএম, ১৯ ডিসেম্বর,বৃহস্পতিবার,২০২৪
সেদিন একটি মৌখিক পরীক্ষা বোর্ডে উপস্থিত থাকার সুযোগ হয় আমার । অনেক সম্মান ও ক্ষমতার পদ । কঠোর পরিশ্রম, মেধা ও যোগ্যতা থাকলেই এ ধরণের পরীক্ষায় একজন অংশ নিতে পারেন । সেখনে প্রতিযোগী সকলের প্রতি আমার একটা সাধারণ প্রশ্ন ছিল-
‘তোমার জীবনের সুনির্দিষ্ট কোন লক্ষ্য আছে কি, যা অর্জনের জন্য তুমি কাজ করছ’ ?
চেহারা দেখে মনে হয়েছে, এ রকম প্রশ্ন তাঁদের কেউ আশা করেন নি । তারপরও সকলেই এ প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন । তাঁদের প্রায় প্রত্যেকেই জবাবে বলেছেন, যে পদের জন্য তিনি আবেদন করেছেন, সেই চাকরি পাওয়াই তাঁর জীবনের লক্ষ্য । কেউ কেউ আর একটু জোর দিয়ে বলেছেন, খুব ছোটকাল থেকেই তিনি এই চাকরি পাওয়ার স্বপ্ন দেখে আসছেন ।
আমরা যদি তাঁদের প্রশ্নের জবাব সঠিক বিবেচনা করি, তাহলে তাঁদের প্রত্যাশিত চাকরি পাওয়ার সাথে সাথেই তাঁদের জীবনের একমাত্র লক্ষ্য পূরণ হয়ে গেল । সে ক্ষেত্রে তাঁদের কর্মজীবনের লক্ষ্য কি হবে ? যেহেতু তাঁদের জীবনে আর কোন লক্ষ্য নেই, তাহলে কি একটি লক্ষ্যহীন কর্মজীবন শুরু হবে তাঁদের ?
এখানে একটি বিষয় আমি বিনীতভাবে জানাতে চাই যে, একজন ছাত্রের জীবনের লক্ষ্য বোঝানোর শতভাগ দায়িত্ব সম্মানিত শিক্ষকগণের । আমরা যাঁদের মৌখিক পরীক্ষা নিয়েছি, তাঁদেরকে স্কুল, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয় জীবন সফলতার সাথে শেষ করেই এই পর্যায়ে আসতে হয়েছে । এই দীর্ঘ পরিক্রমায় কোন একজন শিক্ষক তাঁদেরকে জীবনের লক্ষ্য সম্বন্ধে বুঝিয়ে বলেননি- বিষয়টি অবাক হওয়ার মত ।
একজন শিক্ষক হয়ত বলবেন, আমি আমার ছাত্রছাত্রীদের জীবনের লক্ষ্য বিষয়ে রচনা পড়িয়েছি । হ্যাঁ, আমি নিজেও ছাত্রজীবনে তা পড়েছি । আমাকে মুখস্থ করতে বলা হয়েছে । আমি মুখস্থ করেছি । আমাকে এ বিষয়ে বুঝিয়ে বলা হয়নি । ফলে, আমি নিজেও তখন কিছু বুঝিনি । তবে আমি সেকেলে মানুষ । একালের শিক্ষকগণও যে বিষয়টি ছাত্রছাত্রীদের কাছে পরিস্কার করেন নি, এই মৌখিক পরীক্ষা নিতে গিয়ে আমার তা জানা হোল ।
আমাদের সময়ে ছাত্রজীবনের লক্ষ্য বলতে ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হওয়াকে বোঝানো হত । আমরা মাথা দুলিয়ে, জোরে আওয়াজ তুলে পড়তে পড়তে তোতাপাখির মত সেই রচনা মুখস্থ করতাম । আর আমার মুখস্থ ক্ষমতা এমন ছিল যে, দাড়ি কমা পর্যন্ত মুখস্থ হয়ে যেত । বোঝার কথা শিক্ষকগণ কখনো বলেন নি; আমি নিজেও তা বোঝার চেষ্টা করিনি ।
ব্রিটিশ ভারতে আধুনিক শিক্ষার প্রচলন করেন লর্ড বেনটিঙ্ক (Lord William Bentinck) । ১৮৩৫ সালে । পরিকল্পনাকারি লর্ড মেকলে । কিন্তু এর আগেই ভারতের, বিশেষ করে কোলকাতার শিক্ষিত মানুষের মধ্যে এদেশীয় জাতীয়তাবাদ চেতনার একটা জোয়ার আসে । দেশের অতিসাধারণ মানুষও আলোচনায় স্থান পায় । তখন চিকিৎসার অভাবে ওলাওঠা, কলেরাসহ বিভিন্ন রোগে গ্রামকে গ্রাম উজাড় হয়ে যেত। গ্রামের অতি সাধারণ মানুষের যে আধুনিক চিকিৎসা সেবা দরকার- এই দাবীতে সবাই সোচ্চার হয় । পরবর্তীতে স্বদেশী আন্দোলনে নিজেদের সমস্যা নিজেরা সমাধান করার উপর গুরুত্ব দেওয়া হয় । তখনকার লেখকগন ছাত্রছাত্রী দের জন্য ‘আমার জীবনের লক্ষ্য’ বিষয়ে যে রচনা তৈরি করে দেন, সেখানে তাঁদের ডাক্তার হওয়ার ব্যাপারে অনেক গুরুত্ব দেওয়া হয়। লক্ষ্য আর্তমানবতার সেবা, তথা গ্রামের সাধারণ মানুষের চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করা । উপায় ডাক্তার হওয়া ।
জীবনের লক্ষ্য ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার বিষয়টি আসে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর । সকলেরই জানা, আমাদের মুক্তিযোদ্ধাগণ নিজেরাই ১৯৭১ সালে স্বাধীনতাযুদ্ধ চলাকালে এদেশের সকল প্রকার পুল, সেতু, ব্রীজ বোমা মেরে উড়িয়ে দেন । তখন পাকহানাদার বাহিনী গ্রামের যুবকদের হত্যা করত, তরুণী মেয়েদের ধরে নিয়ে যেত এবং গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দিত । পাক হানাদার বাহিনীর গতি রোধ করার জন্যই সে সময় মুক্তিযোদ্ধাগণ সব ধরণের পুল, সেতু, ব্রীজ বোমা মেরে উড়িয়ে দেন । ফলে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায় যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের অবকাঠামো নির্মাণ । তখনকার লেখকগন ছাত্রছাত্রী দের জন্য ‘আমার জীবনের লক্ষ্য’ বিষয়ে যে রচনা তৈরি করে দেন, সেখানে তাঁদের ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার ব্যাপারে অনেক গুরুত্ব দেওয়া হয় । উদ্দেশ্য সদ্য স্বাধীনতা প্রাপ্ত যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের অবকাঠামো নির্মাণে সক্রিয় অবদান রাখা । উপায় ইঞ্জিনিয়ার হওয়া । লক্ষ্য দেশপ্রেম- নিজের যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের অবকাঠামো নির্মাণে সাহায্য করা । মাধ্যম ইঞ্জিনিয়ার পদে আসীন হওয়া ।
তারমানে আমাদের লেখকগন ছাত্রছাত্রীদের জীবনের লক্ষ্য বলতে সর্বদা সময় উপযোগী দিক নির্দেশনা দিয়েছেন । তাঁরা বোঝাতে চেয়েছেন ছাত্রছাত্রীরা তাদের জীবনের লক্ষ্য হিসেবে আর্তমানবতার সেবা বা দেশগড়ার মহান ব্রত নেবে এবং সেই ব্রত একটি পেশা গ্রহণের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করবে। শিক্ষকগণের চিন্তার ক্ষেত্র আরও ব্যাপক । ফলে তাঁরা আরও শিক্ষা দিতে পারেন যে, জীবনের লক্ষ্য অর্জনের জন্য কেবল একটি পেশা নয়; যে কোন ধরণের পেশা গ্রহন করেও জীবনের লক্ষ্য অর্জন করা যায় । কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য এই যে, আমাদের শিক্ষকগণ ছাত্রছাত্রীদের জীবনের লক্ষ্য বিষয়টি ঠিকমত বুঝিয়ে বলেন নি – শুধু মুখস্থ করতে বলেছেন ।
কোন পেশার মানুষকে ছোট করা বা কটাক্ষ করা আমার এ লেখার উদ্দেশ্য নয় । আমি এখানে আমাদের সকলের পেশার সীমাবদ্ধতার কথা বলতে চেয়েছি ।
শুভ কামনা সকলের জন্য ।
(চলমান)
৫ নভেম্বর, ২০২১ । ইস্কাটন, ঢাকা ।