রাশেদুল ইসলাম
ইসলামের মৌলিক বিষয় (চার)
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ২০ নভেম্বর,শনিবার,২০২১ | আপডেট: ০৯:৫৩ এএম, ১৯ ডিসেম্বর,বৃহস্পতিবার,২০২৪
হযরত মোহাম্মদ (সঃ) মক্কা থেকে বিতাড়িত হন । কিন্তু মদিনার বাসিন্দারা তাঁকে সাদরে গ্রহন করেন । প্রকৃত পক্ষে মক্কা ত্যাগ করার এক বছর আগে থেকেই মদিনার সকল সম্প্রদায়ের গোত্রপ্রধানগণ হযরত মোহাম্মদ (সঃ) কে তাঁদের নেতা হিসেবে গ্রহন করার প্রস্তাব করে আসছিলেন । মদিনাবাসী তাঁদের বিভিন্ন ধর্মবর্ণের মানুষের মধ্যে শতবর্ষব্যাপী চলে আসা নৈরাজ্য থেকে মুক্তি চান । আর এ জন্যই সর্বসম্মতভাবেই হযরত মোহাম্মদ (সঃ)কে তাঁরা তাঁদের সকলের নেতা হিসেবে চেয়েছিলেন । মদিনায় ‘তখন চোখের বদলে চোখ, খুনের বদলে খুন’ – এই নীতিতে বিভিন্ন গোত্রের মধ্যে হানাহানি ও রক্তারক্তি নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার ছিল । হযরত মোহাম্মদ (সঃ) মদিনা যাওয়ার অল্পকিছুদিনের মধ্যেই মোজাহির, আনসার, ইহুদি ও মদিনার অন্যান্য সম্প্রদায়ের মানুষের সর্বসম্মতিক্রমে ‘মদিনা সনদ’ স্বাক্ষরিত হয় । এখানে উল্লেখ্য যে, মহানবী (সঃ) এঁর মত মক্কা থেকে মদিনায় হিজরতকারী মুসলমানদের মোজাহির এবং মদিনার যে সকল মানুষ মোজাহিরদের আশ্রয় ও সাহায্য সহযোগিতা দেন, তাঁদেরকে আনসার বলা হত । অবশ্য ‘মদিনা সনদ’ স্বাক্ষরের সময় নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতের ভিন্নতা রয়েছে । কারো কারো মতে ‘মদিনা সনদ’ স্বাক্ষরিত হয় বদর যুদ্ধের আগে এবং কারো কারো মতে তা হয় বদর যুদ্ধের পরে । তবে মদিনাবাসীদের নৈরাজ্যকর অবস্থা থেকে সুশৃঙ্খল জীবনযাপনে রুপান্তরের ক্ষেত্রে ‘মদিনা সনদ’এর কার্যকর ভূমিকা নিয়ে কারো মধ্যে কোন দ্বিমত নেই ।
বহুধর্মবর্ণ মানুষের মধ্যে শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস এবং সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে নিজ নিজ ধর্ম পালনের নিশ্চয়তা দেওয়া ইসলামী শাসন ব্যবস্থার উল্লেখযোগ্য দলিলের নাম ‘মদিনা সনদ’ । যেখানে শাসনকর্তা ও প্রধান বিচারপতি ছিলেন স্বয়ং হযরত মোহাম্মদ (সঃ) নিজে । মদিনা সনদের শেষ কথা ছিল, ‘এই দলিল অন্যায়কারী ও পাপীকে কোন নিরাপত্তা দেবে না । যুদ্ধেই যাক কিংবা শহরে ঘরেই থাকুক, অন্যায়কারী ও পাপাচারী না হলে সে নিরাপদ । আল্লাহ ভালো ও আল্লাহভীরু মানুষের আশ্রয়দাতা’ ( সিরাতে রাসুলুল্লাহ (সাঃ, ইবনে ইসহাক)।
এখানে উল্লেখ্য, পবিত্র কোরআনে ইসলামের সকল ক্ষেত্রে মুসলমানদের মহানবী হযরত মোহাম্মদ (সঃ)কে অনুসরণ করতে বলা হয়েছে । বলা হয়েছে -
‘তোমরা রসুল যা করতে বলেন, তাই কর (সূরা আনফাল ) । বলা হয়েছে, “যে রসুলের আনুগত্য করে, সে আল্লাহরই আনুগত্য করে (সূরা নিসা, আয়াত ৮০)।
হযরত মোহাম্মদ (সঃ) মক্কাবাসীদের কখনো শত্রু মনে করেন নি । কিন্তু মক্কার কোরাইশসহ অন্যান্য গোত্রের অভিজাত শ্রেণির একটি বড় অংশ তাঁকে জানের শত্রু মনে করতেন । যেহেতু হযরত মোহাম্মদ (সঃ) মক্কার মানুষের কাছে বিভিন্নভাবে নির্যাতন ও অপমানের শিকার হন এবং তাঁকে হত্যার আদেশ দেওয়ার পর তিনি মদিনায় পালিয়ে যেতে বাধ্য হন; তিনি অবশ্যই এসবের প্রতিশোধ নিবেন । তাঁদের আশংকা ছিল তৎকালে প্রচলিত রীতি অনুযায়ী মদিনায় শক্তি সঞ্চয় করে মোহম্মদ (সঃ) মক্কায় ফিরে আসবেন এবং তাঁদের সকলকে হত্যা করবেন । এ কারণে তাঁদের একমাত্র লক্ষ্য ছিল মদিনায় আশ্রয় নেওয়া হযরত মোহাম্মদ (সঃ) এবং তাঁর অনুসারীদের সকলকে হত্যা করা । এ কারণেই হযরত মোহাম্মদ (সঃ)কে ইসলাম ও তাঁর অনুসারীদের রক্ষার জন্যই মক্কাবাসীদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন যুদ্ধে অংশ নিতে হয় । ইতিহাসে এসকল যুদ্ধ বদর যুদ্ধ, ওহুদের যুদ্ধ, খন্দকের যুদ্ধ ইত্যাদি নামে পরিচিত ।
নবী করিম (সঃ) এঁর সময়কালের অধিকাংশ যুদ্ধে, তিনি নিজে সরাসরি যোগ দেন । যে সব যুদ্ধে তিনি নিজে উপস্থিত থাকতে পারেননি, সে সব ক্ষেত্রে তিনি সংশ্লিষ্ট সেনাপতিকে কয়েকটি বিষয়ে সুস্পষ্ট নির্দেশ দিয়েছেন । যেমনঃ যুদ্ধে আগে আক্রমন না করা, নারী, শিশু, বৃদ্ধ ও প্রতিবন্ধীদের কোন ক্ষতি না করা, সমাধি ক্ষেত্র বা ফলবান বৃক্ষের কোন ক্ষতি না করা ইত্যাদি (সূত্রঃ হযরত মোহাম্মদ (সঃ) এঁর জীবনী, সম্পাদনা শেখ মোহাম্মদ ইসমাইল এবং আব্দুল কাদের মল্লিক) । সকল ক্ষেত্রেই মহানবী পবিত্র কোরআনের আদেশ যথযথ অনুসরণ করেছেন। কোথাও তাঁর ব্যক্তিগত ইচ্ছা অনিচ্ছার প্রতিফলন ঘটেনি । বলা যায়, ৮ম হিজরি সালের ২০ রমজান মক্কা বিজয়ের মাধ্যমে মক্কাবাসীদের সাথে হযরত মোহাম্মদ (সঃ) এঁর শত্রুতার অবসান ঘটে ।
হযরত মোহাম্মদ (সঃ) এঁর মক্কা বিজয়ের ইতিহাস ইসলামে শত্রুর প্রতি ক্ষমা প্রদর্শনের একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে আছে । মক্কায় ইসলাম প্রচার করতে গিয়ে মহানবী (সঃ) নিজে ও তাঁর অনুসারীগণ এমন লাঞ্ছনা, নির্যাতন ও অপমানের শিকার হন যে, মক্কাবাসীরাই মনে করতেন যে, তাঁদের অপরাধ ক্ষমার অযোগ্য । কিন্তু মহানবী (সঃ) সকলকে ক্ষমা করে দেন । যুদ্ধ জয়ী কোন বীর যেভাবে উন্নত শিরে উদ্যত খোলা তলোয়ার হাতে বিজিত রাজ্যে প্রবেশ করে, মহানবী (সঃ) সেভাবে মক্কায় যাননি । তিনি তাঁর উঠের পিঠে অবনত মস্তকে নিজের জন্মভুমি মক্কায় প্রবেশ করেন । তাঁর চির শত্রু আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হিন্দা, যিনি উহুদের যুদ্ধে শহীদ হওয়া চাচা বীর হামজার মৃতদেহ তলোয়ারের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত করেন, তাঁর বুক চিরে কাঁচা কলিজা চিবিয়ে খান বলে কথিত আছে, তাঁকেও তিনি ক্ষমা করে দেন । তখনকার যুদ্ধের নিয়ম অনুযায়ী পরাজিত মক্কাবাসীর সকলেই যুদ্ধবন্দী এবং তাঁদের সম্পদ গণিমতের মাল হিসেবে গণ্য হবার কথা ( সিরাতে রাসুলুল্লাহ (সাঃ, ইবনে ইসহাক)। কিন্তু হযরত মোহাম্মদ (সঃ) এসব বিবেচনায় না নিয়ে, সকলকে ক্ষমা প্রকাশের মাধ্যমে ক্ষমা প্রদর্শনের ক্ষেত্রে ইসলামের প্রকৃত সৌন্দর্য তুলে ধরেছেন ।
(চলমান)
২৩ অক্টোবর, ২০২১। ইস্কাটন, ঢাকা ।