রাশেদুল ইসলাম
(চার)
স্ববিরোধিতা
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ২০ সেপ্টেম্বর,সোমবার,২০২১ | আপডেট: ০৯:৫৩ এএম, ১৯ ডিসেম্বর,বৃহস্পতিবার,২০২৪
উইলিয়াম কেরী ১৮০০ সালেই শ্রীরামপুর মিশনে এশিয়া মহাদেশের প্রথম বাংলা মুদ্রণ যন্ত্র (Printing Press) স্থাপন করেন । উল্লেখ্য, ১৭৮৯ সাল পর্যন্ত ভারতে কোন বাংলা পাঠ্যবই ছিল না, বাংলা পড়ানোর মত কোন পণ্ডিত ছিলেন না বা বাংলা ব্যাকরণ লেখার মত কোন শিক্ষিত বাঙালী ছিলেন না । সে বছর ২৩ এপ্রিল প্রকাশিত ক্যালকাটা গেজেটে এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের সাহায্য চাওয়া হয় (সুত্রঃ উইকিপিডিয়া)। উইলিয়াম কেরী স্থানীয় ভাষার সব ধরণের গ্রন্থের বাংলায় অনুবাদ করার জন্য সকলকে উৎসাহিত করেন । একইসাথে তিনি বাংলায় পাঠ্যপুস্তক রচনা ও প্রকাশে সকলকে উদ্বুদ্ধ করেন । নিজে বাংলা থেকে ইংরেজী অভিধান লেখাসহ বিভিন্ন ভাষার অনুবাদ করেন এবং ১৮১২ সালে ইতিহাসমালা নামে একটি গ্রন্থও রচনা করেন তিনি । ১৮১৮ সালে বাংলাভাষায় প্রথম সংবাদ পত্র ‘সমাচার দর্পণ’ তিনি প্রকাশ করেন । মহাভারত ও রামায়ণ – এ দুটি মহাকাব্যের বাংলা অনুবাদ পুস্তক আকারে তিনিই প্রথম প্রকাশ করেন । শ্রীরামপুর মিশন থেকে রামরাম বসু এবং মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালংকারের মত অনেক বিখ্যাত ব্যক্তির বই প্রকাশিত হয় । (সুত্রঃ উইকিপিডিয়া)। তবে আরবী ও ফার্সি ভাষার কোন অনুবাদ গ্রন্থ শ্রীরামপুর মিশন থেকে প্রকাশিত হয়েছে বলে জানা যায় না ।
উইলিয়াম কেরী ১৮০১ সালে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে বাংলা বিভাগের প্রধান হন । উল্লেখ্য, সে সময় বাংলা বিভাগে প্রধান হওয়ার মত উপযুক্ত কোন বাঙালী পণ্ডিত না থাকাই ইংরেজ উইলিয়াম কেরীকে এই দায়িত্ব প্রদান করা হয় । ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর তখন একই কলেজে সংস্কৃত বিষয়ের পণ্ডিত হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন (সুত্রঃ উইকিপিডিয়া)।
ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে উইলিয়াম কেরীকে পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্ধ ও তা ব্যয় করার ক্ষমতা দেওয়া হয়। আগেই বলা হয়েছে যে, ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ ভারতে ইষ্ট ইনডিয়া কোম্পানির নবযোগদানকৃত ইংরেজ কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষন কেন্দ্র ছিল । এই কলেজে শিক্ষানবিশ ইংরেজ কর্মকর্তাদের ভারতীয়দের ভাষা ও সংস্কৃতি বিষয়ে শিক্ষা দেওয়া হত । এ কারণে বাংলা ভাষায় ভারতের ইতিহাস, ধর্ম, সাহিত্য, বিজ্ঞান বিভিন্ন বিষয়ে লেখা ও আলোচনার উপর অধিক গুরুত্ব দেওয়া হয় । ফলে রামায়ন মহাভারতের পাশাপাশি ইলিয়াড, অডিসির কথা চলে আসে । হিন্দু পৌরাণিক কাহিনির পাশাপাশি চলে আসে গ্রীক পৌরাণিক কাহিনি । প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের জ্ঞানচর্চার মিলন কেন্দ্রে পরিণত হয় ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ । এ ধরণের জ্ঞানচর্চা ভারতীয়দের মধ্যে নিজেকে জানার ও অন্যকে জানানোর আগ্রহ সৃষ্টি করে । এতে একদিকে ভারতীয়দের মধ্যে জাতীয়তাবাদ চেতনার উন্মেষ ঘটে; অন্যদিকে তা বাংলার নবজাগরণে পরিণত হয় - বাংলা রেনেসাঁ যুগের সৃষ্টি হয় ।
বাংলার রেনেসাঁকে দুই পর্বে ভাগ করা হয় । প্রথম পর্বের সূচনা করেন রাজা রাম মোহন রায় -যার শুরু ১৭৭৫ সালে । রাজা রাম মোহন রায় সংস্কৃত, আরবী ও ফার্সি ভাষায় সুপণ্ডিত ছিলেন । তিনি ১৮১৫ সালে বেদান্ত এবুং ১৮১৭ সালে উপনিষদ অনুবাদ করেন । বেদ ও উপনিষদের উপর গভীর জ্ঞান তাঁকে ‘আদিধর্ম’ এর সন্ধান দেয় । তিনি অনুধাবন করেন আদিধর্মে কোন মূর্তিপূজা বা শ্রেণিবৈষম্য ছিল না । আদিধর্ম একেশ্বরবাদের । তিনি এই সিদ্ধান্তে উপনিত হন যে, ইসলাম, খ্রিষ্ট এবং হিন্দু ধর্মের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই । কারণ তিনটি ধর্মেই এক ঈশ্বরের আরাধনা করা হয় । রাজা রাম মোহন রায় একেশ্বরবাদে বিশ্বাসী হন । তিনি ১৮২৮ সালের ২৮ আগস্ট,তাঁর সমমনা ব্যক্তিত্ব প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রমুখদের সমন্বয়ে কোলকাতায় একটি নতুন ধর্মবিশ্বাসী দল ‘ব্রাহ্ম সমাজ’ গঠন করেন (সুত্রঃ উইকিপিডিয়া) ।
বেদ উপনিষদ থেকেই রাজা রাম মোহন রায় নিশ্চিত হন যে, হিন্দু ধর্মে প্রচলিত সতীদাহ প্রথা, যে প্রথায় স্ত্রীর জীবদ্দশায় স্বামী মারা গেলে জীবিত স্ত্রীকে স্বামীর সাথে একই চিতায় দাহ করা হত; তা আদিধর্মের বিধান নয় বা সনাতন হিন্দু ধর্মের বিধান নয় । তিনি এই অমানবিক প্রথা বাতিলের জন্য কলম ধরেন । এগিয়ে আসেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, উইলিয়াম কেরী প্রমুখ । লর্ড উইলিয়াম বেনটিংক এঁর মত মানবিক ও দুঃসাহসী ভাইসরয় থাকার কারণেই ১৮২৯ সালে একটি রেগুলেশন জারি করে এই অমানবিক সতীদাহ প্রথা বাতিল করা সম্ভব হয় ।
রাজা রাম মোহন রায়ের কথা ও কাজ একদিকে যেমন কোলকাতার উচ্চবর্ণের উচ্চশিক্ষিত হিন্দু সম্প্রদায়ের চিন্তা ও চেতনায় ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে; অন্যদিকে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের ধর্ম, সাহিত্য, দর্শন ও অন্যান্য বিষয়ের জ্ঞানচর্চা – সবকিছু মিলে এক নতুন জাগরণের সৃষ্টি হয় । ইতিহাসে প্রথম পর্বের বাংলার এই রেনেসাঁর মেয়াদ ধরা হয় ১৭৫৫ সাল থেকে ১৮৩৩ পর্যন্ত ।
বাংলার রেনেসাঁ যুগের প্রথম পর্বে যারা অবদান রাখেন তাঁদের মধ্যে রাজা রাম মোহন রায়, , উইলিয়াম কেরী, দেবেদ্রনাথ ঠাকুর, অক্ষয় কুমার দত্ত, ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর, স্বামী বিবেকানন্দ, মাইকেল মধুসূদন দত্তসহ আরও অনেকের নাম উল্লেখযোগ্য । কিন্তু লক্ষণীয় যে, এ তালিকায় কোন বাঙালি মুসলমানের নাম পাওয়া যায় না ।
বাংলার নবজাগরণের প্রথম পর্বে উইলিয়াম কেরী, রাজা রাম মোহন রায়সহ যারা বাংলা ভাষার সমৃদ্ধি ও সামাজিক উন্নয়নে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অবদান রেখেছেন; আমি তাঁদের সকলের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করছি । মহান সৃষ্টিকর্তা তাঁদের সকলের আত্মার শান্তি নিশ্চিত করুন ।
কিন্তু, এখানে একটা প্রশ্ন থেকেই যায়, বাংলা রেনেসাঁ যুগের প্রথম পর্বে কোন বাঙালী মুসলমানের নাম নেই কেন ?
(চলবে)
১০ আগস্ট, ২০২১ । ইস্কাটন, ঢাকা ।