রাশেদুল ইসলাম
(দুই)
স্ববিরোধিতা
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ৪ সেপ্টেম্বর,শনিবার,২০২১ | আপডেট: ০১:৫৬ পিএম, ২১ ডিসেম্বর,শনিবার,২০২৪
বাঙালি শিক্ষিত সমাজে আনুষ্ঠানিক স্ববিরোধিতার বীজ রোপিত হয় ইংরেজ আমলে । পরিকল্পনাকারি লর্ড মেকলে । লর্ড মেকলে প্রণীত রিপোর্ট ( Macaulay’s Minute’ 1835) টিতে এ বিষয়ে বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে । লর্ড মেকলে ভারতে শিক্ষা পদ্ধতি প্রবর্তন বিষয়ে ওয়ারেন হেসটিংস প্রবর্তিত শিক্ষা ব্যবস্থার সম্পূর্ণ বিপরীত মতামত প্রদান করেন ।
লর্ড ওয়ারেন হেসটিংস ছিলেন ব্রিটিশ ভারতের প্রথম গভর্নর জেনারেল । প্রকৃত পক্ষে ওয়ারেন হেসটিংস এবং লর্ড ক্লাইভ ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের গোঁড়াপত্তন করেন । ১৭৫০ সালে তিনি ব্রিটিশ ইষ্ট ইনডিয়া কোম্পানিতে কেরানী পদে যোগদান করেন এবং সে বছরেই কোলকাতা আসেন । কোলকাতা আসার পর পরই তিনি তৎকালের দাপ্তরিক ভাষা ফার্সি এবং বহুল প্রচলিত উর্দু ও অন্যান্য স্থানীয় ভাষা শেখায় মনযোগী হন । ওয়ারেন হেসটিংস মনে করেন, কোন দেশে দীর্ঘদিন থাকতে হলে বা রাজত্ব করতে হলে, সে দেশের ভাষা ও সংস্কৃতি জানা দরকার । সাধারণ মানুষের মনোভাব না জেনে এবং সে অনুযায়ী কাজ না করলে কোন দেশে স্থায়ী কিছু করা সম্ভব নয় । এই ধারণা ও বিশ্বাস থেকেই তিনি ভারত উপমহাদেশে প্রচলিত প্রায় সকল ভাষা যেমন বাংলা, সংস্কৃত, পালি, উর্দু, ফার্সি ইত্যাদি ভাষায় অনর্গল কথা বলার দক্ষতা অর্জন করেন ( সুত্রঃ উইকিপিডিয়া) । বলা যায় ওয়ারেন হেসটিংস এঁর বিদেশী ভাষা শেখার এই বিরল গুণ ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের গোঁড়াপত্তনে একটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে । বিষয়টি ইতিহাসের আলোকে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে ।
মোগল সম্রাট আওরংজেব ১৭০৭ সালে মৃত্যুবরণ করেন । তাঁর মৃত্যুর পর দক্ষ ও উপযুক্ত কোন উত্তারাধিকার না থাকার কারণে মোগল সম্রাটের কেন্দ্রীয় শাসন একেবারেই ভেঙ্গে পড়ে । ফলে, প্রাদেশিক শাসনকর্তাগণ অনেক শক্তিশালী হয়ে ওঠে এবং অনেকটা স্বাধীনভাবে শাসনকার্য চালাতে থাকে । যেমনঃ বলা হয়ে থাকে ‘বাংলা-বিহার- উড়িষ্যার স্বাধীন অধিপতি নবাব সিরাজ- উদ- দৌলা’। কিন্তু বাস্তবে নবাব সিরাজ- উদ- দৌলা স্বাধীন অধিপতি ছিলেন না । মোঘল সম্রাটের অধীনে ছিলেন । ইষ্ট ইনডিয়া কোম্পানি ১৭৬৫ সালে খাজনা আদায়ের যে দেওয়ানী ক্ষমতা অর্জন করে, তা নবাবের পক্ষে নয়; মোগল সম্রাটের পক্ষে । কিন্তু মোঘল সম্রাট শাহ আলম এঁর কেন্দ্রীয় শাসন এমন দুর্বল যে প্রাদেশিক শাসনকর্তার উপরে যে কেউ আছেন, তা বোঝার উপায় ছিল না । ফলে লর্ড ক্লাইভ বা ওয়ারেন হেসটিংসকে মোগল সম্রাটদের মোকাবেলা করার কোন প্রয়োজন হয়নি । মোগলদের প্রাদেশিক শাসনকর্তা যেমনঃ হায়দ্রাবাদের নিজাম, মহীশুরের টিপু সুলতান, ঝাঁসির রানী লক্ষ্মীবাঈ, বাংলার নবাব সিরাজ- উদ- দৌলা -এ ধরনের স্বাধীনচেতা দেশপ্রেমিক শাসনকর্তাদেরকে পরাজিত করেই ইংরেজকে ভারত জয় করতে হয় । ইংরেজের বিরুদ্ধে কোন যুদ্ধে প্রাদেশিক শাসনকর্তাদের কেউ মোগল সম্রাটের কোন সহযোগিতা পাননি বলাই সমীচীন । এ ধরনের যুদ্ধে ওয়ারেন হেসটিংস এঁর স্থানীয় ভাষা জ্ঞান অনেক বড় ভূমিকা রাখে । নবাব সিরাজ- উদ- দৌলার খালা ঘসেটি বেগম যে নবাবকে পছন্দ করেন না, কেন করেন না- এ রকম নবাব পরিবারের হাঁড়ির অনেক খবর তিনি সংগ্রহ করেন সাধারণ মানুষের কাছ থেকে এবং সেই ব্যক্তিগত ও পারিবারিক দুর্বলতা কাজে লাগান তিনি । মূলত ওয়ারেন হেসটিংস এঁর কূটচালের দক্ষতা কাজে লাগিয়ে ব্রিটিশ ইষ্ট ইনডিয়া কোম্পানি নবাব সিরাজ- উদ- দৌলাসহ অন্যান্য শাসনকর্তাদের পরাজিত করে একে একে গোটা ভারত জয় করতে সক্ষম হয় ।
লর্ড ওয়ারেন হেসটিংস কলকাতা মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন ১৭৮১ সালে । মূলত আরবী এবং ফার্সি ভাষা শিক্ষাদানের জন্যই এ মাদ্রাসা গড়ে তোলা হয় । এরই ধারাবাহিকতায় ১৭৯১ সালে সংস্কৃত কলেজ এবং ১৮০০ সালে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠা করা হয় । মূলত ব্রিটিশ ইষ্ট ইনডিয়া কোম্পানিতে যোগদানকৃত ইংরেজ শিক্ষানবীশ কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ প্রদানের জন্যই ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠা পায় । এই কলেজে ভারতীয়দের বিভিন্ন ভাষা ও সংস্কৃতি বিষয়ে শিক্ষা দেওয়া হয় । কোলকাতা মাদ্রাসা এবং সংস্কৃত কলেজ থেকে পাশ করা শিক্ষিত শ্রেণি ইংরেজ শাসনকার্যে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে এটাই ছিল এই শিক্ষা পদ্ধতির মূল লক্ষ্য ।
কিন্তু লর্ড মেকলে এ ব্যবস্থার তীব্র বিরোধিতা করেন । এখানে লর্ড মেকলে বিষয়ে কিছু বলা যেতে পারে । লর্ড মেকলে তুখোড় বাগ্মী ও মেধাবী ছিলেন । তাঁর পাণ্ডিত্য ও বাগ্মিতার সাথে তুলনীয় সমসাময়িক কালে আর কেউ ছিলেন বলে আমার জানা নেই । ভারতে আসার আগে তিনি ব্রিটিশ পার্লামেন্টের একজন সম্মানিত সদস্য ছিলেন । ১৮৩৩ সালে ভারত শাসন আইন জারি হওয়ার পর তিনি ব্রিটিশ পার্লামেন্ট থেকে পদত্যাগ করেন । এককথায় লোভনীয় বেতনের কারণেই তিনি ব্রিটিশ ইষ্ট ইনডিয়া কোম্পানির চাকুরী গ্রহন করেন এবং ১৮৩৪ সালে ভারত আগমন করেন ।
১৮৩৫ সালে তাঁর দাখিল করা রিপোর্টে লর্ড মেকলে ভারতীয়দের ভাষা, ধর্ম, সাহিত্য, আচার আচরণ ইত্যাদি বিষয়ে খোলামেলা আলোচনা করেন এবং এসব প্রেক্ষিতে ব্রিটিশ ইষ্ট ইনডিয়া কোম্পানি তথা ভারতে ইংরেজ শাসন দীর্ঘস্থায়ী করতে কি কি করণীয় তা উল্লেখ করেন । ফার্সি ভারতের দাপ্তরিক ভাষা । কিন্তু তা ভারতীয় ভাষা নয় । ইরানী ভাষা । ভারতের প্রধান দুটি ধর্মীয় সম্প্রদায়ের ধর্মীয় ভাষা- আরবী ও সংস্কৃত । এ ভাষা দুটির দাপ্তরিক কোন ব্যবহার নেই । আরবী ও সংস্কৃত ভাষা তিনি পড়তে পারেন না । কিন্তু এ দুটি ভাষায় অনূদিত যত লেখা আছে, তা তিনি পড়েছেন বলে দাবী করেন । এ দুটি ভাষায় যত সাহিত্য লেখা হয়েছে, তার জন্য ইউরোপের ভালো যে কোন একটি লাইব্রেরীর একটি মাত্র তাকই যথেষ্ট বলে তিনি তাঁর রিপোর্টে উল্লেখ করেন ।
লর্ড মেকলের কথার সার বক্তব্য এইযে, ভারতীয়দের কোন শিক্ষা নেই । কিন্তু ভারতের সকলকে শিক্ষা দেওয়া তাঁদের কাজ নয় । তাঁরা ভারত শাসন করতে চান এবং সেই শাসন দীর্ঘস্থায়ী করতে চান । এ কারণে তাঁদের লক্ষ্য হবে এমন একটি শিক্ষিত শ্রেণি তৈরি করা, যারা রক্তে এবং বর্ণে হবে ভারতীয়; কিন্তু, কাজে, মনন ও মানসিকতায় হবে ইংরেজ । ( ‘...a class of persons Indian in blood and color, but English in tastes, in opinions, in morals and in intellect’).
(সুত্রঃ উইকিপিডিয়া)
(চলবে)
৩ আগস্ট,২০২১। ইস্কাটন, ঢাকা ।