রাশেদুল ইসলাম
স্ববিরোধিতা
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ২৭ আগস্ট,শুক্রবার,২০২১ | আপডেট: ০৯:৫৫ এএম, ১৯ ডিসেম্বর,বৃহস্পতিবার,২০২৪
শিল্পী রথীন্দ্রনাথ রায়ের একটি জনপ্রিয় গান -
‘ও যার অন্তরে, বাহিরে, কোনই তফাৎ নাই,
ও তার সন্ধানে, কোনখানে, বলো আমি যাই,
আমি তারেই শুধু চাই,
বলো কেমন করে পাই...’ ।
এটি একটি লোকসঙ্গীত । এই গানের মাধ্যমে আকুল হয়ে এমন একজন মানুষের সন্ধান করা হয়েছে, যে ঠক বা প্রতারক নয় । যার অন্তর এবং বাইরের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই ।
লোকসঙ্গীত আবহমান গ্রামবাংলার চিত্র তুলে ধরে । আর যা আবহমান কাল থেকে চলে আসে তার নাম সংস্কৃতি । এটা যদি সত্য হয়, তাহলে আবহমান কাল থেকে আমাদের গ্রামবাংলার মানুষ মুখে যা বলে, মনে তা বলে না । তারা মনে যা বলে, বাস্তবে তা করে না । আবার বাস্তবে যা করে, মনে তা বিশ্বাস করে না । তাহলে যুক্তির দিক দিয়ে এটাই আমাদের সংস্কৃতির অঙ্গ । এটাই আমাদের জাতীয় চরিত্র ।
প্রশ্ন হোল, উপরে বর্ণিত স্ববিরোধিতা যদি সত্যিই আমাদের জাতীয় চরিত্র হয়, তাহলে কি তা মেনে নিতে হবে ? না, এটাকে সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করে প্রতিকারের ব্যবস্থা নিতে হবে ?
ব্রিটিশ ভারতে আধুনিক বিচার ব্যবস্থা ও শিক্ষা ব্যবস্থা প্রবর্তনে লর্ড মেকলে (Thomas Babington Macaulay) উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন । তিনি ১৮৩৪ থেকে ১৮৩৮ সাল পর্যন্ত ব্রিটিশ গভর্নর কাউন্সিলের আইন সদস্য ছিলেন । আইন কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে তিনি যে ক্রিমিনাল কোড রিপোর্ট দাখিল করেন, তাতে তিনি একইসাথে প্রশংসিত ও সমালোচিত হন । সমালোচিত হওয়ার মূল কারণ ছিল, তিনি তাঁর কার্যবিবরণীতে বাঙালী ও ভারতীয়দের সম্বন্ধে অনেক বিরুপ মন্তব্য করেন । বাঙালী সম্পর্কে তিনি বলেন,
‘বাঙালিরা দুর্বল ও কাপুরুষ (Physically fragile and moral cowards). তারা মিথ্যাবাদী (Habitual liars), পলায়নপর (Evaders), খারাপ কাজে ইন্দনদাতা (Connivers) এবং জালিয়াত (Frauds).’
লর্ড মেকলেকে তাঁর এ ধরনের মন্তব্যের জন্য বাঙালী ও ভারতীয় অন্যান্য বুদ্ধিজীবীগণ তুলোধোনা করে ছেড়েছেন । স্বয়ং কার্ল মার্ক্স তাকে, ‘Systematic falsifier of history’ বলে উল্লেখ করেছেন। তারমানে কার্ল মার্ক্সের মতে, লর্ড মেকলে ইতিহাস বিকৃত করেছেন (সুত্রঃ উইকিপিডিয়া) ।
কিন্তু আমরা যদি ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করি, তাহলে রথীন্দ্রনাথ রায়ের গানের কথা এবং লর্ড মেকলের কথার মধ্যে খুব বেশী পার্থক্য আছে কি ?
সাধারণত আমাদের বিরুদ্ধে কেউ কোন অভিযোগ করলে, আমরা অভিযোগটাকে সমস্যা হিসেবে দেখিনে । বরং, যিনি অভিযোগ আনেন, তাঁর পিছনে লাগি । লর্ড মেকলেও আমাদের হাত থেকে রেহায় পাননি । কিন্তু আমরা যদি তাঁর পিছনে না লেগে, এটাকে একটা সমস্যা হিসেবে মেনে নিতাম, তাহলে এতদিনে প্রতিকারের অনেক পথ পাওয়া যেত এবং সমস্যা নিরসনের একটা ব্যবস্থা হতে পারত । কিন্তু আমাদের সেই অনাদিকালের মানসিকতার কোন পরিবর্তন আসেনি । এখনও কেউ কারো বিরুদ্ধে চুরি বা অন্য কোন অভিযোগ আনলে, যিনি অভিযোগ এনেছেন, তিনি নিজেই বা তার গোষ্ঠীর কেউ চোর বা অন্য ধরণের খারাপ কিছু- তা প্রমাণে উঠে পড়ে লাগি আমরা । মূল সমস্যাকে মোটেও আমলে নিই না । ফলে যে লাউ, সেই কদু । সমাজে চুরি, ডাকাতি, প্রতারণাসহ বিভিন্ন অপরাধ ক্রমবর্ধমান হারে বাড়তে থাকে এবং তা বাড়ছে ।
এখানে একটি গল্প বলা যেতে পারে ।
একবার একটি নরখাদক উপজাতি পরিবারের একটি ছেলে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পায় । সেই উপজাতি পরিবার শুধু নয়, গোটা উপজাতি গোত্রের জন্য এটি একটি বিরল ঘটনা ছিল । ছেলেটি যখন অক্সফোর্ডের ডিগ্রী নিয়ে বাড়িতে গেলেন, তখন তাঁদের গোত্র প্রধান ছেলেটির উদ্দেশে অনেক বড় একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। রীতি অনুযায়ী সেই অনুষ্ঠানে খাবারের মেনুতে নরমাংসও রাখা হয় । অক্সফোর্ড ডিগ্রিধারী ছেলেটিও সবার সাথে বসে সেই নরমাংশ ভক্ষন করেন। তখন ছেলেটির এক বন্ধু তাকে প্রশ্ন করেন, তাহলে গ্রাজুয়েট হয়ে কি উন্নতি হয়েছে তার ? ছেলেটি জবাব দেয়, ‘তুমি হয়ত লক্ষ করনি, তোমরা সব হাত দিয়ে নরমাংস খাচ্ছ; আমি কিন্তু হাত দিয়ে নয়, কাটাচামচ দিয়ে খাচ্ছি’ ।
আমাদের সমাজের জন্য গল্পটি অনেক প্রাসাংগিক । কিন্তু, আমাদের আবহমান কালের জাতীয় চরিত্র যদি স্ববিরোধিতামুলক হয়েও থাকে, তাহলে আমাদের শিক্ষিত সমাজ তা গ্রহন করবে কেন? তাহলে শিক্ষিত হওয়ার দরকার কি ?
(চলবে)
২৬ জুলাই, ২০২১ । ইস্কাটন, ঢাকা ।