রাশেদুল ইসলাম
দুষ্প্রাপ্য বই
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ১১ আগস্ট, বুধবার,২০২১ | আপডেট: ০৪:৪২ এএম, ২২ ডিসেম্বর,রবিবার,২০২৪
এখানে একটি বিষয় উল্লেখ করা যায় যে, ১৯১০ সালে স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় কোলকাতা ইম্পেরিয়াল লাইব্রেরীর সভাপতি ছিলেন । সে সময় তিনি তাঁর ব্যক্তিগত সংগ্রহ থেকে ৮০ হাজার বই ইম্পেরিয়াল লাইব্রেরীকে দাণ করেন (সুত্রঃ উইকিপিডিয়া)। আসলে যে কোন এলাকায় লাইব্রেরী প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সেখানকার অনেক বিদ্যোৎসাহী ব্যক্তি সেচ্ছায় ব্যক্তিগত সংগ্রহ থেকে লাইব্রেরীতে বই দাণ করে থাকেন । এ ধরণের অভিজ্ঞতা থেকেই ঢাকা কেন্দ্রীয় পাবলিক লাইব্রেরী প্রতিষ্ঠাকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষক তৎকালের একজন প্রথিতযশা ইসলামী চিন্তাবিদ ও সাহিত্যিকের সাথে দেখা করেন । তাঁর একটি ব্যক্তিগত বিশাল লাইব্রেরী ছিল। শিক্ষকগণ সেই প্রথিতযশা ব্যক্তিকে তাঁর মৃত্যুর পূর্বে বইগুলো ঢাকা কেন্দ্রীয় লাইব্রেরিতে দাণ করার জন্য অনুরোধ জানান । কিন্তু তিনি রাজী হননি । কথিত আছে লাইব্রেরীর সেই মূল্যবান বইগুলো তাঁর মৃত্যুর পর নীলক্ষেতের হকারস মার্কেটে সের দরে বিক্রি হয় ।
এখানে এই উদাহরণ উল্লেখ করার কারণ এইযে, দুষ্প্রাপ্য বইয়ের গুরুত্ব সবার কাছে সমান নই । পিতা বই পছন্দ করলে, তাঁর পুত্রকন্যাও যে বই পছন্দ করবেন তা নয় । এ কারণে বর্তমানে ব্যক্তিগত পর্যায়ে যাঁদের সংগ্রহে দুষ্প্রাপ্য বই আছে, তাঁরা বইগুলো তাঁদের মৃত্যুর পূর্বে ঢাকা কেন্দ্রীয় পাবলিক লাইব্রেরীতে দাণ করতে পারেন । উপরের উদাহরণ থেকে এটা পরিস্কার যে, উপযুক্ত মানুষের হাতে না পড়লে, দুষ্প্রাপ্য বইয়ের কোন গুরুত্ব থাকে না; সেগুলো সের বা কেজি দরেই বিক্রি হয়ে যায় ।
এ লেখা থেকে এটাও পরিস্কার যে, তৎকালীন পাকিস্তান আমলের ১৯৫৪-৫৫ সালে ঢাকা কেন্দ্রীয় লাইব্রেরী প্রতিষ্ঠাকালে সরকারি বা বেসরকারি পর্যায়ে এ বিষয়ে উল্লেখযোগ্য কোন গুরুত্ব আরোপ করা হয়নি । ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যে সকল শিক্ষকগণের সীমিত প্রচেষ্টায় কেন্দ্রীয় পাবলিক লাইব্রেরিটি গড়ে ওঠে, আমি তাঁদের সকলের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করছি । মহান আল্লাহ তাঁদের উত্তম পুরষ্কার দান করুন ।
বাংলাদেশ ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীন হয় । ইতিহাস জানা নিন্দুকেরাও স্বীকার করবেন যে, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম না হলে বাঙালী হিসাবে স্বতন্দ্র জাতিস্বত্বা নিয়ে একটি স্বাধীন দেশ পাওয়া কখনো সম্ভব ছিল না । তবে একটি স্বাধীন দেশ পাওয়া এবং তা টিকিয়ে রাখা এক কথা নয় । একটি দেশকে তাঁর স্বাধীন স্বত্বা নিয়ে টিকিয়ে রাখা আরও অনেক বেশী চ্যালেঞ্জের ।
বর্তমান সমাজে মানুষের অপরাধ প্রবণতা, মাদকাসক্তি আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে । করোনা ভাইরাসের এই কঠিন দুঃসময়েও এসবের হার ক্রমবর্ধমান। মানুষের অপরাধ প্রবণতা ও মাদকাসক্ত যুবসমাজ জনজীবনে শান্তি নষ্ট করে । রাষ্ট্রকে অস্থিতিশীল করে । এ একারণে মানুষের মধ্যে সামাজিক অপরাধ প্রবণতা ও যুবসমাজের মধ্যে মাদকাসক্তি নিরসনের বিভিন্ন কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহন খুবই জরুরী । এ ক্ষেত্রে পাবলিক লাইব্রেরী একটি বড় ভূমিকা পালন করতে পারে ।
ব্রিটিশ পার্লামেন্টে পাবলিক লাইব্রেরী আইন পাশ হয় ১৮৫০ সালে । ১৮৫১ সালে যুক্তরাজ্যের জনসংখ্যা ছিল মাত্র ১ কোটি ৭৯ লক্ষ । তখনই তাদের লাইব্রেরী সংখ্যা ছিল ৪ হাজার ১ শত ৪৫ (সুত্রঃ উইকিপিডিয়া)। এই লাইব্রেরীর মাধ্যমেই তারা শ্রমিকসহ সমাজের অন্যান্য মানুষের বিভিন্ন অপরাধ প্রবণতা কমাতে পেরেছে । কিন্তু দুঃখের বিষয় একই আইন বলে পূর্ববাংলায় ১৮৫৪ সালে ৪ টি জেলায় মাত্র ৪ টি লাইব্রেরী গড়ে ওঠে (সুত্রঃ গণগ্রন্থাগার অধিদপ্তরের ওয়েবসাইট) ।
গণগ্রন্থাগার অধিদপ্তরের ওয়েবসাইট থেকে জানা যায় যে, ১৯৯৪ সালের একটি জরীপ অনুযায়ী বাংলাদেশে ৮ শত ৮৩ টি বেসরকারী পাবলিক লাইব্রেরী এবং ৭১ টি সরকারি পাবলিক লাইব্রেরী রয়েছে । বাংলাদেশে বর্তমান লোকসংখ্যা ১৬ কোটি ৬৪ লক্ষ ৬৮ হাজার (Worldometer).
এই পরিসংখ্যান থেকে প্রতীয়মান হয় যে, আমাদের দেশে সামাজিক অপরাধ প্রবণতা কমানোর ক্ষেত্রে পাবলিক লাইব্রেরীকে হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করার বিষয়টি কখনো তেমন গুরুত্ব পায়নি। আমার মনে হয়েছে এক্ষেত্রে কোন কিছুর গভীরে না গিয়ে নিজেরদের মনগড়া যুক্তিকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। মনগড়া যুক্তির ব্যাখ্যা নিম্নরূপ -
আমরা সধারনত অন্যের মনগড়া যুক্তি দ্বারা প্রভাবিত হই । যেমন আগে বলা হত, এদেশের মানুষ বই পড়েনা, পাবলিক লাইব্রেরী করে কি লাভ ? এখন বলা হচ্ছে, ডিজিটাল যুগে কেউ বই পড়ে না। কেউ লাইব্রেরীতে যায় না । আমি নিজেও যেহেতু লাইব্রেরীতে যাইনে, বই পড়িনে – তাই আমিও মনে করি, এই মনগড়া যুক্তি ঠিক আছে ।
কিন্তু, আমার সেদিনের লেখার উপর একজন ফেসবুক বন্ধু ভিন্নরূপ মতামত দিয়েছেন । তিনি মেহেরপুর থেকে ঢাকায় বেড়াতে এসেছিলেন । তিনি দুদিন পাবলিক লাইব্রেরীতে গিয়ে একদিনও বসার জন্য আসন খালি পান নি । তিনি লাইব্রেরী সম্প্রসারণের জন্য বিনীত অনুরোধ জানিয়েছেন। তাঁর কথার সাথে আমার মনগড়া যুক্তি কিন্তু মিলছে না ।
এ ধরণের মনগড়া যুক্তির কারণেই কোন গ্রহণযোগ্য প্রস্তাব নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে তুলে ধরা সম্ভব হয় না । আর কোন কিছু যুক্তিগ্রাহ্য করতে সে বিষয়ে গবেষণাধর্মী প্রস্তাবের প্রয়োজন হয় । আমাদের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নিঃসন্দেহে শতভাগ দেশপ্রেমিক । তাঁর সময়কালে দেশ ও দেশের মানুষের জন্য মঙ্গলকর এমন কোন প্রস্তাব নেই, যা তিনি অনুমোদন করেননি । আর এ কারণেই অবিলম্বে দেশব্যাপী সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে পাবলিক লাইব্রেরী সম্প্রসারণের একটি গ্রহণযোগ্য প্রস্তাব মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর জন্য প্রণয়ন করা যুক্তিযুক্ত বলে আমি মনে করি । এ বিষয়ে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহন করা যেতে পারে ।
উপরের বিস্তারিত আলোচনা থেকে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের বিবেচনার জন্য নিম্নরূপ সুপারিশ করা যেতে পারেঃ
১) ব্যক্তি পর্যায়ে সংরক্ষিত দুষ্প্রাপ্য বই সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির মৃত্যুর পূর্বে ঢাকা কেন্দ্রীয় লাইব্রেরীতে দাণ করার জন্য একটি উৎসাহব্যঞ্জক কার্যক্রম গ্রহন করা যেতে পারে । এই ধরণের বই সংগ্রহের জন্য লাইব্রেরীতে বিশেষ কর্নারের ব্যবস্থা করা বাঞ্চনীয় ।
২) ঢাকা কেন্দ্রীয় পাবলিক লাইব্রেরীতে সংগৃহীত দুষ্প্রাপ্য বই দেশের অন্যান্য লাইব্রেরী থেকে ডিজিটাল পদ্ধতিতে পাওয়ার ব্যবস্থা রাখা ।
৩) পাবলিক লাইব্রেরী ব্যবহারের জন্য জনসচেতনতা সৃষ্টির কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহন ।
৪) পাঠকের চাহিদা অনুযায়ী পাবলিক লাইব্রেরীর সুযোগসুবিধা বৃদ্ধির ব্যবস্থা নেওয়া ।
৫) দেশব্যাপী সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে পাবলিক লাইব্রেরী সম্প্রসারণের জন্য গ্রহণযোগ্য প্রস্তাব প্রস্তুতকরণ এবং তা বিভিন্ন অংশীজনের সাথে মতবিনিময়ের মাধ্যমে চূড়ান্ত করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নিকট প্রেরণের ব্যবস্থা গ্রহন ।
আমার এ লেখাটি সম্পূর্ণ স্বব্যাখ্যাত । সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তর বিষয়টি বিবেচনায় নিতে পারেন ।
মহান আল্লাহ আমাদের করোনা, ডেঙ্গু, অতিবর্ষণজনিত প্লাবনসহ বিভিন্ন দুর্যোগ থেকে রক্ষা করুন ।
শুভ কামনা সকলের জন্য ।
৩১ জুলাই, ২০২১ । ইস্কাটন, ঢাকা ।