রাশেদুল ইসলাম
দুষ্প্রাপ্য বই
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ৭ আগস্ট,শনিবার,২০২১ | আপডেট: ০৩:৩০ পিএম, ২২ ডিসেম্বর,রবিবার,২০২৪
ফেসবুকে কয়েকজন বন্ধু দুষ্প্রাপ্য বই নিয়ে লেখেন । বিভিন্ন দুষ্প্রাপ্য বইয়ের সাথে আমাদের পরিচয় করিয়ে দেন । আমার দিক থেকে সবিশেষ কৃতজ্ঞতা তাঁদের প্রতি । তাঁদের মধ্যে জালাল আহমেদ (Jalal Ahmed) এবং মাহমুদ হাসান (Mahmud Hasan) আমার পরিচিত । জালাল আহমেদ আমার শ্রদ্ধেয় সিনিয়র সহকর্মী এবং মাহমুদ হাসান বন্ধু ও ব্যাচমেট ।
ছেলেবেলা থেকেই বইয়ের প্রতি আমার দুর্নিবার আকর্ষণ । কিন্তু অজ পাড়াগাঁয়ে জন্ম আমার । বাবার অর্থবিত্ত ও ক্ষমতার দাপটের কথা আমি শুনেছি । কিন্তু মহাত্মা ইমাম গাজ্জালী (রঃ) এঁর কিমিয়ায়ে সাআদাতসহ কিছু ইসলামী বই ছাড়া অন্য কোন বই আমি বাড়িতে পাইনি । তখন গ্রামের পর গ্রাম হেঁটে আমাকে বই যোগাড় করতে হয়েছে । মাইল কে মাইল হেঁটেও যে আমি খুব বেশী বই যোগাড় করতে পেরেছি, তা নয় । তবে একথাও সত্য, আমার যত পড়াশুনা তার বড় অংশ ছেলেবেলাতেই হয়েছে । পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় মজিদ খানের শিক্ষানীতি বাতিলের দাবীতে ছাত্র আন্দোলনের এক পর্যায়ে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করা হয় । আবাসিক হলগুলোও বন্ধ রাখা হয় । ঢাকাতে তখন আমার থাকার বিকল্প কোন ব্যবস্থা ছিল না । সেই বন্ধকালীন সময়, বোধহয় ছয়মাস, আমাকে ঢাকা শহরে অনেকটা ভাসমান থাকতে হয় । সে সময়ে আমার সারাদিনের ঠিকানা ছিল শাহবাগের পাবলিক লাইব্রেরি । পাবলিক লাইব্রেরীর বাথরুমে আমার টুথব্রাশ এবং পেস্ট লুকানো থাকত । রাতে থাকার কোন স্থায়ী ঠিকানা ছিল না আমার । যেখানেই থাকি, সকালে দাঁত মাজা হত পাবলিক লাইব্রেরিতে । বলা যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধের সেই কয়েকটি মাস সারাদিনই বই পড়েছি আমি । কিন্তু ছেলেবেলায় যে নেশা নিয়ে বই যোগাড় করে পড়েছি; ততদিনে সেই নেশা আমার কেটে গেছে । এখনও আমার বইপড়ার কোন নেশা নেই । কিন্তু কেউ যখন কোন দুষ্প্রাপ্য বই নিয়ে কথা বলেন, তখন আমার ছেলেবেলার বইপড়ার নেশাটা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে । আমি নস্টালজিক হয়ে পড়ি ।
বলা হয়, কেউ যদি সাধারণ মানুষের তুলনায় একটু উপরে উঠতে চান, তাহলে তাকে অবশ্যই বই পড়তে হবে । কথাটা বলেছেন আমেরিকান লেখক জিম রন । বিখ্যাত ফরাসী লেখক ও রাজনীতিবিদ ভিক্টর হুগো বলেন, ‘পড়তে শেখা মানে আগুন জ্বালাতে শেখা; বইয়ের এক একটা অক্ষর, এক একটা অগ্নিস্ফুলিঙ্গের মত’ । তবে ইতালীয় ধর্মযাজক ও দার্শনিক টমাস আইকুনাস হুসিয়ার করে বলেন, ‘একটি বইপড়া মানুষ থেকে সাবধান’। ‘Beware of the person of one book’. এ কথার মানে এইযে, একটি বই পড়া বা একই জাতীয় বইপড়া মানুষ ভয়ঙ্কর হতে পারে । একটি বই পড়া মানুষ সুনাগরিক হিসেবে গড়ে ওঠার পথে অন্তরায় হতে পারে । একটি জাতিকে সভ্য জাতি হিসেবে গড়ে তুলতে সর্বকালের সব ধরণের বই পড়া প্রয়োজন । এখানেই দুষ্প্রাপ্য বইয়ের সংগ্রহ একান্তভাবেই প্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে । বাংলাদেশের মত একটি দেশের জাতীয় কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার এই সংগ্রহশালার মুখ্য ভূমিকা পালন করতে পারে । এ ধরণের জাতীয় গ্রন্থাগারের গুরুত্ব বোঝাতে জার্মান পদার্থবিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইনের একটি উক্তি উল্লেখ করা যেতে পারে । তিনি বলেন, “ The only thing that you absolutely have to know, is the location of the Library”. তারমানে একজন নাগরিককে অবশ্যই একটি লাইব্রেরীর রাস্তা চিনতে হবে ।
দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আমাদের দেশের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারটি সুপরিকল্পিত ভাবে গড়ে ওঠার সুযোগ পায়নি । এর পিছনে অবশ্য ঐতিসাহিক কারণ রয়েছে। কারণটি এখানে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে ।
ঐতিহাসিকভাবে সত্য যে, আমাদের দেশের রাজধানী ঢাকাও কখনো সুপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠার সুযোগ পায়নি । ১৬১০ সালে মোগল সম্রাট জাহাঙ্গীর ঢাকাকে সুবে বাংলার রাজধানী ঘোষণা করেন এবং ইসলাম খান চিশতীকে সুবেদার নিয়োগ করেন । ইসলাম খান ঢাকা নগরীর গোঁড়াপত্তন করেন এবং নগর উন্নয়নে মনযোগী হন । কিন্তু সুবে বাংলার রাজধানী ঢাকা থেকে স্থানান্তর করা হলে ঢাকা নগরীর গুরুত্ব কমে যায় । পরবর্তী প্রায় ৩০০ বছর পর ইংরেজ আমলে পূর্ববাংলার পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের জন্য ১৯০৫ সালে পূর্ববাংলা ও আসামকে নিয়ে একটি নতুন প্রদেশ গঠন করা হয় । সে সময় ঢাকাকে প্রাদেশিক রাজধানী ঘোষণা করা হয় । লর্ড কার্জন তখন ঢাকা নগরীকে একটি পরিকল্পিত রাজধানী শহর হিসেবে গড়ে তোলার অবকাঠামো নির্মাণের কাজ শুরু করেন । ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হল সেই সময়ের নির্মাণ কাজের একটি উদাহরণ । কিন্তু, ইংরেজের সেই বঙ্গভঙ্গ আদেশকে দুরভিসন্ধিমূলক মনে করা হয় এবং গোটা ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন তখন বঙ্গভঙ্গ আইন বাতিল করার আন্দোলনে পরিণত হয় । ফলে রাজধানী ঢাকার অবকাঠামো নির্মাণ কাজ থেমে যায় এবং শেষ পর্যন্ত ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ আদেশটি বাতিল করা হয় ।
১৯৪৭ সালে ভারত উপমহাদেশে ইংরেজ শাসনের অবসান হয় । বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ পড়ে জানা যায় যে, কথা ছিল কোলকাতা পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী হবে । কেবলমাত্র ক্ষমতা গ্রহনের জন্যই ঢাকাকে পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঘোষণা দিয়ে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ এবং খাজা নাজিমউদ্দীন ভারত ছেড়ে চলে আসেন । বিষয়টি তৎকালীন অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ারদীকে উদ্দেশ্যমূলকভাবে জানানো হয়নি (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃষ্ঠা ৭৩, শেখ মুজিবুর রহমান) । ফলে ১৯৪৭ সালে দেশবিভাগের সময়ও ঢাকাকে সুপরিকল্পিতভাবে পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী করা হয়নি ।
আমাদের দেশের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে কোলকাতা রাজধানী হওয়ার প্রসঙ্গ অবতারণা অনেক বেশী প্রাসঙ্গিক । কারণ যিনি ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের আদেশ জারী করেন, সেই লর্ড কার্জন ১৯০৩ সালের ৩০ জানুয়ারি কোলকাতায় ইম্পেরিয়াল লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা করেন । কোলকাতা পাবলিক লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮৩৬ সালে । সে লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা হয় ব্যক্তিগত মালিকানায় । মালিক ছিলেন প্রিন্স দারকানাথ ঠাকুর।
(সুত্রঃ উইকিপিডিইয়া)
(চলবে)
২৮ জুলাই, ২০২১ । ইস্কাটন, ঢাকা ।