রাশেদুল ইসলাম
ভালো মানুষের নেটওয়ার্ক
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ২৯ জুলাই,বৃহস্পতিবার,২০২১ | আপডেট: ১২:১৯ পিএম, ১৯ ডিসেম্বর,বৃহস্পতিবার,২০২৪
মানুষের ক্ষতি করা খুব সহজ । ইঁদুর, বিড়াল, তেলাপোকা, ছারপোকা -এসকল প্রাণী শুধু নয়, শারীরিকভাবে অক্ষম যে কোন ব্যক্তি, মূর্খ, শিক্ষিত, অশিক্ষিত যে কোন মানুষ, যে কারো, যে কোন সময় ক্ষতি করতে পারে । ক্ষতি করার জন্য কারো কোন ক্ষমতা, দক্ষতা বা যোগ্যতার প্রয়োজন নেই । ফলে, যুক্তি বিচারে মানুষের ক্ষতি করার মধ্যে কোন বাহাদুরি নেই । তারপরও মানুষ মানুষের ক্ষতি করে । অনেকে ক্ষতি করে তার বাহাদুরি প্রকাশ করে । শুধু মানুষের ক্ষতি করার জন্যই অনেক ধরণের নেটওয়ার্কও কাজ করে ।
মানুষ জন্মগতভাবে কিন্তু ক্ষতিকারক কোন প্রাণী নয় । একটি সদ্যজাত শিশু জন্ম নিয়েই অপরিচিত পরিবেশে সুতীব্র চিৎকারে কেঁদে ওঠে । কিন্তু একটু পরেই নিজেকে সামলে নেই সে। তারপর তার মুখের হাসির রেখা মায়ের গর্ভধারণের কষ্ট ভুলিয়ে দেয়; পরিবারের সবাইকে উজ্জীবিত করে সে । ২০ জন বয়স্ক মানুষের একটি বন্দী শিবিরে দুই বছর বয়সী একটা শিশু থাকলে, সে একাই ২০ জনের সেই দলকে রাতদিন মাতিয়ে রাখতে পারে । এভাবে মানুষকে খুশী করার অসীম সম্ভাবনা নিয়েই একটি শিশু বড় হতে থাকে । কিন্তু সে খারাপ হয় তার নিজের পরিবার থেকে, সমাজ থেকে এবং আপনার আমার মত মানুষের কাছ থেকে ।
মানুষের উপকার করার জন্য ক্ষমতার প্রয়োজন হয় সত্য; কিন্তু, সেই ক্ষমতা মানুষের সহজাত । সেই ক্ষমতা কেউ কাউকে দিতে হয়না; নিজে নিজেই সেই ক্ষমতা অর্জন করতে পারে সে । তার জন্য শুধু একটা ভালো মন ও পরিবেশ দরকার । এই ভালো মন ও পরিবেশ তাকে দিতে পারে তার পরিবার, তার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সমাজ তথা দেশ । প্রাথমিক ভাবে এ দায়িত্ব পরিবার ও তার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের।
আমাদের চলমান সমাজ ব্যবস্থা মানুষের জন্য তেমন উপকারবান্ধব নয় । এ কারণে সমাজে মানুষের উপকার করা খুব সহজ কাজ নয় । এখানে মানুষের উপকার করার জন্য সত্যিই ক্ষমতার প্রয়োজন হয় । ফলে বর্তমান সমাজে বাহাদুরি যদি করতেই হয়, তাহলে কারো উপকার করে বাহাদুরি করা বাঞ্চনীয় । এতে একদিকে বাহাদুরি করার একটা যৌক্তিকতা থাকে; অন্যদিকে সমাজ তথা দেশের অনেক উপকারও হয় । একজন ১০ টি এতিম শিশুর দায়িত্ব নিয়ে জোর গলায় বলতে পারেন, তিনি দশজন এতিমের দায়িত্ব নিয়েছেন । সাথে সাথে আর একজন ২০ জনের দায়িত্ব নেওয়ার ঘোষণা দিতে পারেন ।
বিভিন্ন প্রচার মাধ্যম এবং দৈনিক সংবাদ পত্র থেকে পাওয়া সংবাদে অনেকে মনে করেন আমাদের সমাজে খারাপ মানুষের সংখ্যা বেশী । কারণ খারাপ কাজ ও খারাপ মানুষের প্রচার অনেক বেশী হয় । আমাদের সমাজে খারাপ খবরের পাঠক বেশী । এ কারণে অনেক গুরুত্বের সাথে খারাপ খবর প্রচার করা হয় । বাস্তবতা কিন্তু ভিন্ন । আমাদের সমাজে ভালো মানুষের সংখ্যা এখনও অনেক বেশী । ভালো কাজ করা মানুষের সংখ্যাও অনেক বেশী । কিন্তু সমাজে যারা ভালো কাজ করেন, তাঁরা সাধারণত প্রচার বিমুখ । নিরবে নিভৃতে কাজ করেন তাঁরা । মুসলমান সমাজে এ বিষয়ে ধর্মের ভূমিকা অনেক বেশী বলে আমার মনে হয় । কারণ, আমাদের ধর্মীয় শিক্ষা ব্যবস্থায় দাণ করার বিষয়টি যত গুরুত্বের সাথে আলোচনা করা হয়, সৎকাজ করা বিষয়ে মোটেও তা করা হয় না । ইসলামে দাণ করার বিষয়টি গোপনে সম্পাদনের কথা বলা হয়েছে । অনেকে মনে করেন সৎকাজও গোপনে করা সমীচীন । কিন্তু, পবিত্র কোরআনের বিধান সম্পূর্ণ বিপরীত । কোরআনে বলা হয়েছে-
‘নিজেদের মধ্যে সৎকাজে কে এগিয়ে আছে, তা পরীক্ষা করার জন্যই মানুষ সৃষ্টি করা হয়েছে’ (সূরা মূলক, আয়াত ২)।
পবিত্র কোরআনের এই আয়াতের প্রকৃত অর্থ আল্লাহর নবী (সঃ) ভালো জানেন । তবে আমার মনে হয়েছে, এই আয়াতের মর্ম অনুযায়ী অর্থ সৎকাজ একটি প্রতিযোগিতার বিষয় । কোন প্রতিযোগিতায় গোপনীয়তার স্থান নেই । এই কারণে যে, একজনের সৎকাজ অন্যজনের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস হতে পারে। আর এ ধরণের প্রতিযোগিতা মহান আল্লাহর মানবসৃষ্টির মত মহৎ কর্মকে সার্থক করতে পারে ।
একজন সচিবের কথা বলি । ২০১০ সালের দিকে তাঁর নিজ গ্রামে অবস্থিত প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৫ম শ্রেণির একটা ক্লাস নেন তিনি । বিষয়টি তাঁর মনপুত হওয়ায় পরীক্ষার আগে তিনি তাদের আরও ১০/১২ টি ক্লাস নেন । আগের বছরে সেই স্কুল থেকে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষায় মাত্র ১ জন জিপিএ ফাইভ পায় । কিন্তু, সেবার তাঁর পড়ানোর কারণে, সেই একই স্কুল থেকে একসাথে ১২ জন ছেলেমেয়ে জিপিএ ফাইভ পেয়ে যায় । এতে তাঁর মনে হয়, সামান্য চেষ্টায় যদি গ্রামের ছেলেমেয়েরা এত ভালো ফল করে, তাহলে তাঁর নিজের অসুবিধা কোথায় ? বর্তমানে সচিব মহোদয় তাঁর গ্রামের ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত ৪০ জন ছেলেমেয়েকে নিয়মিত পড়ান । এই করোনাকালে অফিসের তেমন চাপ না থাকলে, সকাল ৭ টা থেকে প্রায় সারাদিনই তিনি ঢাকায় থেকে সে সব ছাত্রছাত্রীদের লেখাপড়া তদারকি করেন । তাঁর পুরানো ছাত্রছাত্রী, যারা ঢাকার কলেজে পড়ে, তাঁরা তাঁর বাসায় এসে পড়ে যায় । তাঁর গ্রামের এসব ছাত্রছাত্রীরা রাজধানী ঢাকার সমপর্যায়ের যে কোন ছাত্রছাত্রীর সাথে প্রতিযোগিতা করে টিকে থাকতে সক্ষম বলে তিনি মনে করেন ।
তবে সচিব মহোদয় এই কাজটি গোপনে করেন । এসব সামান্য বিষয় তিনি কাউকে জানাতে চান না ।
আপনার আমার আশেপাশে সচিব মহোদয়ের মত আমাদের চেনা জানা অনেকেই আছেন । কিন্তু তাঁদের কোন নেটওয়ার্ক নেই । আমাদের সমাজে ভালো কাজ করা ভালোমানুষের কোন নেটওয়ার্ক নেই ।
আমরা একটু আন্তরিক হলে আমাদের সমাজের ভালো কাজ করা ভালোমানুষদের একটা ডাটাবেজ তৈরি করতে পারি । ভালোমানুষদের একটা নেটওয়ার্ক গড়ে তুলতে পারি ।
শুভকামনা সকলের জন্য ।
মহান আল্লাহ আমাদের করোনার অভিশাপ থেকে রক্ষা করুন ।
(চলবে)
১৬ জুলাই, ২০২১। ইস্কাটন, ঢাকা ।