জালাল উদ্দিন আহমেদ
অনলাইন বিজনেস
প্রকাশ: ১০:১০ পিএম, ২৪ সেপ্টেম্বর,বৃহস্পতিবার,২০২০ | আপডেট: ০৪:৪৪ এএম, ২২ ডিসেম্বর,রবিবার,২০২৪
আজকাল একটি বিষয়ের উপর বেশ তোড়জোড় শুরু হয়ে গেছে। অবশ্য এটা অবশ্যম্ভাবী ছিল। প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় এর প্রচলন খুব বেশী দেখা না গেলেও সোস্যাল মিডিয়ায় এর দাপুটে উপস্থিতি বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করেছে বলেই মনে হয়। সত্যি কথা বলতে কি করোনা না এলে আমরা হয়তো সিংহভাগ মানুষই এই সেবাখাত হতে বঞ্চিত হতাম। আমি অনলাইন ব্যবসাপাতির কথা বলতে চাচ্ছি। করোনার আশীর্বাদে এই উইন্ডোটি আমাদের মত সাধারন জনগনের কাছে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। করোনা পূর্ববর্তী সময়ে এই অনলাইন ব্যবসাটা একটি শ্রেণীর মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। তাও অতি নগন্য হিসাবে। আজকের দিনে সমাজের মধ্য ও নিম্ন মধ্যবিত্ত গ্রুপ যেভাবে এই সেবাটির উপর ঝুঁকে পড়েছে তাতে মনে হচ্ছে অদূর ভবিষ্যতে মানুষ শপিং মল বিমুখ হয়ে পড়বে এবং তৎপরবর্তীকালে কাঁচা বাজার সমস্যার সমাধানেও মানুষজন এই পদ্ধতিতে অভ্যস্ত হয়ে পড়বে। মানুষ তো আসলে অভ্যাসের দাস এবং এটাই চিরন্তন সত্য। আজ থেকে পনের বিশ বছর আগে মানুষ বিশেষ করে মধ্য ও নিম্ন মধ্যবিত্তরা এপার্টমেন্ট পদ্ধতির বসবাসকে সরকারী কোয়ার্টারের কেরানীদের বসবাস বলে নাক সিঁটকাতো। সে সময় নিম্ন ও মধ্যম আয়ের মানুষেরা ঢাকার আশে পাশে দু-তিন কাঠা জমি কিনে নিজের বাড়ি বানানোর স্বপ্ন দেখতো। আজকের এই দুর্মুল্যের বাজার ও ঝক্কি ঝামেলার অজুহাতে মানুষ এখন দুই আড়াই রূম বিশিষ্ট একটি ছোট্ট বাসা কিনতে পারলেই তার সাত জনম সার্থক বলে মনে করে। এবং এই এপার্টমেন্ট বসবাস তাদের জন্য সেফ ও স্বাচ্ছন্দময় মনে ক’রে তৃপ্তি পায়।
বিষয়টি অনলাইন ব্যবসার সাথে তুলনীয় কিনা জানি না তবে আগেই বলেছি মানুষ অভ্যাসের দাস। সাধ্যের সীমা অতিক্রম করায় মানুষ তার সাধ পুরন করছে এই ভাগাভাগির এপার্টমেন্ট বসবাসে। তেমনি শপিং মলের ট্যাগ পদ্ধতির মাত্রাতিরিক্ত মুল্য নির্ধারন, রাস্তা ঘাটের ঝক্কি ঝামেলা, যাতায়তের কষ্টিং এবং গা-ঘেঁষা ভিড়ে আজকাল মানুষজন ওসব পথে নিরুৎসাহিত হবে বলেই মনে হয়। তারপরেও অনলাইন বিজনেস অন্য ধাঁচের এক মার্কেটিং পদ্ধতি। মানুষের প্যাশনের জায়গায়টি থেকেই হয়তোবা এই অনলাইন বিজনেস একদিন মানুষের অপরিহার্যতায় পরিণত হয় কিনা তা সময়ই বলে দিবে। মানুষের শখের চাহিদায় হাতের মুঠোয় এসে যাওয়া এক ক্ষুদ্র গলিপথ দিয়ে শুরু হওয়া এই অনলাইন ব্যবসা এখন মানুষের ব্যক্তিগত ও দৈনন্দিন চাহিদার সবকিছুতেই ঢুকে গেছে। কি চান! সবকিছুই হাতের মুঠোয়। সংসারের চাল ডাল আলু চিনি এখন এক টেলিফোনেই সমাধান হয়ে যাচ্ছে। জামা কাপড় শাড়ি! সেও আজকাল অনলাইনে সয়লাব। আইস্ক্রীম পিজা কিংবা ঘরে বসে বিরিয়ানী খেতে চান! সব যেন এক তুড়িতে এফোঁড় ওফোঁড়। করোনার বিধিবদ্ধতায় জীবন চাহিদার সবকিছু আজ অনলাইন ভিত্তিক হয়ে পড়ছে। মুল্য সাশ্রয়েও এই অনলাইন সেবা সাধারন মানুষকে স্বস্তি দিয়েছে। বাজারে যে পন্য আপনি ১০০ টাকায় কিনবেন সেই পন্য মলে আপনাকে কিনতে হয় ১২০-১৩০ টাকায়। কিন্তু অনলাইন আপনাকে সেই পন্য ৮০-৯০ টাকায় দিচ্ছে। কিভাবে সম্ভব! হাঁ সম্ভব। কারন অনলাইন হাবগুলো ওইসব পন্য সরাসরি গুদাম থেকে নিয়ে দিচ্ছে। অর্থাৎ পাইকারী রেটে আমরা ঘরে বসে এক’শ টাকার পন্য আশি টাকায় পাচ্ছি। কারন দোকানে গিয়ে আশি টাকার পন্য এক’শ টাকা হত এবং পাশাপাশি হোল সেলার বা আমদানীকারদের সঙ্গে দোকানদারদের বাকী বকেয়ার বিষয়টিও এখানে একটি ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়াচ্ছে। ফলে হোল সেলাররা এই অনলাইন হাবগুলির কাছ থেকে নগদ টাকায় পন্য বিক্রি করতে উৎসাহিত হচ্ছে। প্রশ্ন উঠতে পারে, তাহলে অন লাইন ব্যবসার লাভ কোথায়। লাভ অবশ্যই আছে। দোকান বা মলে যে লক্ষ কোটি টাকা খরচ করে দোকান বা মল সাজানো হয় কিংবা তাদের ইউটিলিটি খরচ মিলিয়ে যে কষ্টিং পড়ে সেই মুল্য সংযোজনের বিষয়টি তো অনলাইন ওয়ালাদের নাই। সেক্ষেত্রে পার্থক্যটা সহজেই বুঝা যায়। ফলে ডিজিট্যালের বদৌলতে মানুষ সাশ্রয়ী মুল্য ও ঝক্কি ঝামেলা এড়িয়ে ঘরে বসেই তার জীবন চাহিদার প্রয়োজনীয়তা মিট আপ করবেন সেটাই তো স্বাভাবিক। আজকাল আবার মানুষের কাঁচাবাজারে বাজার করতে যাওয়ার বিষয়টিও ক্রমশঃ ক্ষীন হয়ে পড়ছে। সেটাও মানুষের দরজার গোঁড়ায় পৌঁছে গেছে। ভ্যানগাড়ি ভিত্তিক সবজি ওয়ালাদের কর্ম সংস্থানে আজকাল বাজারের মাছ মাংস সবজি শহর বন্দর ও নগরের মানুষের দরজায় পৌঁছে গেছে। আপনি চাঁদপুরের টাটকা ইলিশ খেতে চান! কিংবা মাওয়া ঘাটের তাজা রুই বা কাতল। ব্যশ, একটি ফোন বা তাদের ইনবক্সে নাম ও সাইজ জানিয়ে দিন। চব্বিশ ঘন্টায় আপনার দরজায় আপনার পছন্দের ইলিশ বা রুই পৌঁছে যাবে।
মনে পড়ে বছর পঁচিশেক আগের একটি ঘটনা। আমার এক কাজিন তিনি সরকারী পদস্থ কর্মকর্তাও বটে। তিনি হঠাৎ অসুস্থ্য হয়ে কয়েকদিন হাসপাতালে থাকলেন। সুস্থ্য হয়ে বাসায় ফিরলেন দিন সাতেক পরে। বাসায় ফিরার দু’একদিন বাদেই এক সকালে তার বাসায় কড়া নাড়ার শব্দ। হোটেল শেরাটন হতে একটা ফুলের বাকেট এসেছে। ছোট বোন ভার্জিনিয়া থেকে ভাইয়ের সুস্থ্যতার খুশিতে ফুলের তোড়া পাঠিয়েছে। আশ্চর্য হয়েছিলাম। এ কেমন করে সম্ভব হয়! কিন্তু তা বাস্তব ছিল। কারন আমেরিকা প্রবাসী বোন সেখানকার কোন অনলাইন সার্ভিসের মাধ্যমে তা সম্ভব করেছিল। যেমন আজকাল আমরা করছি এসব। এই তো ক’দিন আগে আমার ছোট মেয়ের বিবাহ বার্ষিকী গেল। সে ঢাকায় থাকে স্বামী সংসার নিয়ে। আমার বড় মেয়েটি থাকে রাজশাহীতে নিজ সংসারে। নির্দিষ্ট দিনে বিকেল নাগাদ ছোট মেয়ের দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ। পিজা হার্ট থেকে বাহক এক বিশাল বক্সে সদ্য প্রস্তুত গরম গরম পিজা নিয়ে হাজির। অর্থাৎ বড় মেয়ে তার প্রিয় ছোট বোনের বিবাহ বার্ষিকীতে পিজা পাঠিয়েছে শুভেচ্ছা স্বরূপ। শুধু একটা টেলিফোনিক ম্যাসেজ এবং ক্রেডিট/ডেবিট কার্ডের মাধ্যমে মুল্য পরিশোধ। বিশ্ব তো এখন হাতের মুঠোয়। আজকাল চকবাজারের আনন্দের মাল্টোভা কেক খাওয়ার জন্য সেখানে যাওয়া লাগে না। একটা ফোন রেকোয়েষ্ট বা ইনবক্স। ক’দিন আগে বন্ধুর হাতে নতুন হুয়াই স্মার্টফোন দেখে চমকে গেলাম। ঢাকার বাজারে এখনো আসে নি। কি ব্যাপার! “এইতো দারাজের মাধ্যমে অন লাইনে কিনে ফেললাম। প্রমো চলছে। তাছাড়া বাজারে এলে তো দাম বেশীই হবে” – বন্ধুর উত্তর।
সুতরাং আমাদের জীবনের নির্ঘন্টগুলি যত সব নতুন ছকে সাজানো হচ্ছে। অনলাইনের এই রমরমা দিনক্ষনে আজকাল আন্তর্জাতিক অনলাইন হাউজগুলি বেশ দাঁপিয়ে বেড়াচ্ছে বলেই মনে হয়। বিশাল বিশাল আয়োজনে আজকের দুনিয়ায় আমাজন ও আলিবাবা আমাদের খুব পরিচিত নাম। বাংলাদেশী প্রেক্ষিতে দারাজ ইভ্যালি তাদের মার্কেটিং কর্মচাঞ্চল্যে আজ অপরিহার্য ও অতি পরিচিত নাম। বছর পাঁচেক আগেও মানুষ হাতে ব্যাগ নিয়ে বাজার করতে যেত। এখন খালি হাতে বাজারে যায় আর ফিরার সময় পলিব্যগ ভর্তি বাজার নিয়ে বাসায় ফিরে। এখন তো আর বাজারেও যেতে হয় না। ভ্যানগাড়ির সবজি ওয়ালারা বাসায় এসে গৃহকর্তীদের পছন্দের সবজি দরজায় পৌঁছে দেয়। আবার করোনার স্বাস্থ্য সচেতনেতার এইসব দিনগুলিতে অনলাইনের অভিনব কায়দায় বিক্রির কৌশলে মানুষজন সেদিকেই ঝুঁকছে বলে মনে হয়। আজকের কেনাকাটা ও শপিং এর সহজলভ্যতায় মানুষজন অনলাইন পদ্ধতিটাকেই গ্রহন করছে। তবে এই অনলাইনের প্রচলনে যারা সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্থ হবে তারা হচ্ছে প্রতিষ্ঠিত শপিং মল ও ক্ষেত্র বিশেষে পসরা সাজিয়ে বিশাল বিশাল আয়োজনের দোকানপাট। কোটি কোটি টাকার বিনিয়োগের আয়োজনে প্রতিষ্ঠিত এইসব বিজনেস হাউজগুলো ক্ষতির সম্মুখীন হবে বলে ধারন করা যায়। তবে প্রতিটি ক্ষেত্রের প্রতিক্ষেত্র থাকে। সেক্ষেত্রে তারাও হয়তো একসময় অনলাইনের মাদার অর্গানিজেশন হিসাবে বাজার নিয়ন্ত্রনে চলে আসবেন। এমনকি বিখ্যাত ও বড়সব অনলাইনের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সহযোগী হিসাবে তাদের ব্যবসাকে পুনরজ্জীবিত করবেন। কোথায় অনলাইন নেই! কুরবানীর গরু/ছাগলও তো অনলাইনে বিক্রি হতে দেখলাম এবার। বিল ক্লিনটনের মাই লাইফ পড়তে চান! অনলাইনে চলে যান। হয় পড়েন কিংবা কিনেন। দুটোরই অপশন রয়েছে। বগুড়ার দই, সাতক্ষীরার সন্দেশ, চাঁপাইয়ের রসকদম, মুক্তাগাছার মন্ডা – আজকাল অনলাইনের বদৌলতে সব বাড়ির দরজায় হাজির। চিকিৎসা সেবায় আজকাল অনলাইনের আনাগোনা। শিক্ষা ব্যবস্থায় অনলাইন অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। অনলাইনে টক’শো এমনকি যোগাযোগ ব্যাবস্থার সর্বক্ষেত্রে আজ ভার্চুয়ালের ছড়াছড়ি। দেশের জন সম্পৃক্ততার রাজনীতিও ইদানীং অনলাইনে কাজ সেরে নিচ্ছে। বেশ ভালই আছি আমরা। জিতে রহো অনলা