রাশেদুল ইসলাম
ভয় কেন পাই
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ২৩ জুলাই,শুক্রবার,২০২১ | আপডেট: ০৯:৫৩ এএম, ১৯ ডিসেম্বর,বৃহস্পতিবার,২০২৪
কথাটা আমার মাথায় আসে এক অমাবস্যার রাতে । আমি জানি আমার মধ্যে সাহিত্য প্রতিভা নেই । এ কারণে, আমি শুধু কল্পনা করে কিছু লিখতে পারিনে । আমার আশেপাশে যা কিছু ঘটে, যা কিছু দেখি- তাই নিজের মত করে লিখি আমি । তবে আমার পাগলামামা বইটি মোটামুটি কল্পনা নির্ভর। আমি যেহেতু কল্পনা দিয়ে লিখতে পারিনে- এ কারণে পাগলামামা বইটির একটি অধ্যায় লেখার জন্য ২০১৬ সালে পঞ্জিকা দেখে কৃষ্ণপক্ষের এক রাতে আমাকে ঢাকা চিড়িয়াখানায় থাকতে হয় । যারা বইটি পড়েছেন তাঁরা বিস্তারিত জানেন । এটি ছিল অমাবস্যার রাত । কথা ছিল চিড়িয়াখানার লোকজন রাতের আঁধারে আমাকে একা থাকার সুযোগ করে দেবেন । তাঁরা ঠিক সেই ব্যবস্থা করেন । এ কারণে তৎকালীন কিউরেটর এঁর প্রতি আমার আন্তরিক কৃতজ্ঞতার কথা বইটিতে উল্লেখ করা হয় ।
চিড়িয়াখানার কিউরেটর মহোদয়ের অফিসে সে রাতে প্রথমে আমাকে চিড়িয়াখানা সম্বন্ধে বিস্তারিত ধারণা দেওয়া হয় । রাতের বেলা চিড়িয়াখানায় দর্শনার্থী প্রবেশ সম্পূর্ণ নিষেধ । এ কারণে চিড়িয়াখানার ভিতরে পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা নেই । অমাবস্যার রাত । এমনিতেই ঘুটঘুটে অন্ধকার । ব্রিফিং শেষে চিড়িয়াখানার দুজন প্রহরী আমাকে একটি পুকুরের ধারে রেখে চলে যান। প্রহরী দুজন আলো নিয়ে চলে যেতেই, গাঁড় অন্ধকার আমাকে ঘিরে ধরে । এমন অন্ধকার যে নিজের হাত পর্যন্ত দেখা যায় না । চারিদিকে পোকামাকড়ের বিচিত্র সব ডাক । বিভিন্ন পশুপাখি থেকে আসা এক ধরণের শব্দ । গাছপালাগুলো নিকষ কালো মূর্তির মত দাঁড়িয়ে । আশেপাশের কেমন এক শোঁ শোঁ শব্দে আতঙ্ক আমাকে পেয়ে বসে । আমি জানি একটু দুরেই কয়েকজন প্রহরী আছেন; চিড়িয়াখানার কয়েকজন কর্মকর্তা কর্মচারী আছেন । তাঁরাও বেশী দূরে নয় । শুনেছি ভিতরে আনসার ক্যাম্পও আছে । আমি নিজের পদমর্যাদার কথা ভাবি । ভয় পাওয়ার বৈজ্ঞানিক কোন যুক্তি নেই বলেও নিজের মনকে প্রবোধ দেওয়ার চেষ্টা করি । কিন্তু কোন লাভ হয় না । ভয়ে আমার শরীর ঠক ঠক করে কাঁপতে থাকে। দেহটা নিশ্চল পাথরের মত মনে হয় ।
সে রাতেই আমার মাথায় এই প্রশ্ন আসে,
আমি ভয় পাই কেন ?
অনেক ভেবে আমার মনে হয়, ভয় পাওয়ার মূলে আছে শিশুকালে আমার মায়ের সেই ঘুমপাড়ানী গান –
খোকা ঘুমালো,
পাড়া জুড়ালো,
বর্গী এলো দেশে ...।
গানটি সুর করে গাওয়া হলেও, এই গানের মধ্যে কুখ্যাত বর্গী দস্যুদের কথা বলে শিশুদের ভয় দেখানো হয় । অন্যান্য দৈত্যদানোর কথা বলা হয় । ভয় পেয়ে যেন শিশুটি ঘুমিয়ে যায় । এই ভয় শিশুর অবচেতন মনে স্থায়ী ভাবে গেঁথে যায় । ভবিষ্যতে সে যতবড় ক্ষমতাধর মানুষ হোক না কেন, যতবড় পদের মানুষ হোক না কেন, যে কোন নির্জন স্থানে একা হলেই সে ভয় পায় ।
আসলে ভয় দেখিয়ে শিশুদের ঘুম পাড়ানো আমাদের সামাজিক সংস্কৃতির একটি অঙ্গ হয়ে গেছে। ফলে কেউ এটাকে অস্বাভাবিক মনে করেন না । কিন্তু এই ভয় দেখানো শিশু বড় হয়ে যদি দেশের সেনাপ্রধানও হন, তাহলেও তিনি ভীতু হতে বাধ্য । এটা কোন জাতির জন্য শুভ লক্ষণ হতে পারে না ।
আমরা মনে করি, শিশুর বাবামাকে শিশুকে ভয় দেখিয়ে ঘুম পাড়ানোর ক্ষতিকর প্রভাব বোঝাতে পারলে; শিশুদের সুষ্ঠু মানসিক বিকাশের পথে এ ধরণের অন্তরায় থেকে রক্ষা পাওয়া যেতে পারে। এ বিষয়ে রাতারাতি সুফল পাওয়া না গেলেও, ভবিষ্যতে একটি সাহসী ও সুন্দর জাতি গঠনে এই কার্যক্রম কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। পাগলামামা বইটিতে এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়। বইটি ২০১৭ সালের একুশে বইমেলায় প্রকাশিত । এ ধরণের কর্মসূচি বাস্তবায়নে তেমন কোন খরচও নেই। কিন্তু আমার জানামতে, এ বিষয়ে এখনও সরকারি বা বেসরকারি পর্যায়ে তেমন কোন কার্যক্রম গ্রহন করা হয়নি ।
অর্পণ- দর্পণ স্মৃতি ফাউনডেশন ‘এগিয়ে যাওয়ার জন্য বইপড়ি’ প্রতিযোগিতা আয়োজনের পাশাপাশি শিশুদের ভয় দেখিয়ে ঘুম পাড়ানো থেকে বিরত রাখার জন্য ‘আমিই পারি’ কর্মসূচির আওতায় কাজ করতে চায় । এ বিষয়ে প্রাথমিক ভাবে একজন শিশু মনরোগ বিশেষজ্ঞ ‘ভয় দেখিয়ে শিশুদের ঘুম পাড়ানোর ক্ষতিকর প্রভাব ও তা প্রতিকারের জন্য করণীয়’- শীর্ষক একটি সেমিনার পেপার তৈরির দায়িত্ব নিয়েছেন । আমরা তাঁর প্রতি সবিশেষ কৃতজ্ঞ ।
ফাউনডেশন সেমিনার পেপারের উপর যথানিয়মে সেমিনার অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা নিবে এবং উপস্থিত বিশেষজ্ঞজন থেকে প্রাপ্ত সুপারিশ অনুযায়ী পরবর্তী কার্যক্রম গ্রহন করবে ।
সেমিনার অনুষ্ঠানের তারিখ ও সময় সংশ্লিষ্ট সকলকে যথাসময়ে অবহিত করা হবে ।
এ বিষয়ে কারো কোন পরামর্শ পাওয়া গেলে, তা গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা হবে ।
মহান আল্লাহ আমাদের করোনার অভিশাপ থেকে রক্ষা করুন ।
১৮ জুলাই, ২০২১। ইস্কাটন, ঢাকা ।