রাশেদুল ইসলাম
আমিই পারি
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ৩ জুলাই,শনিবার,২০২১ | আপডেট: ১০:৪৬ পিএম, ২০ ডিসেম্বর,শুক্রবার,২০২৪
সরকারি চাকরি শেষ । এখন আমি অবসরে ।
তবে অবসরে গেলেও প্রচলিত আইন ও বিধিবিধান অনুসারে আমি নির্দিষ্ট পরিমাণ আর্থিক সুযোগ সুবিধাদি পাবো । বর্তমান সরকার যে ব্যবস্থা রেখেছেন, তাতে যেকোন সরকারি কর্মচারী অবসরে গেলেও একটু হিসেব করে চললে, আমৃত্যু মোটামুটি অভাবমুক্ত থাকার সুযোগ রয়েছে তাঁর । আশাকরি যথানিয়মেই আমি তা পাব। সুষ্ঠুভাবে দায়িত্ব পালন শেষে সম্মানের সাথে চাকরি থেকে বিদায় নেওয়ার এই সুযোগ পাওয়ার জন্য মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর প্রতি আমার অশেষ কৃতজ্ঞতা। একইসাথে সরকারের প্রতিও আমার কৃতজ্ঞতা এই কারণে যে, বর্তমান সরকার পেনশন সুবিধাদি বৃদ্ধির পাশাপাশি, সে সব সেবা যাতে সহজে পাওয়া যায়, সে ব্যবস্থাও করেছেন । এ কারণে বর্তমান সরকার, বিশেষ করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি আমার অশেষ কৃতজ্ঞতা ।
আমি সমাজ বিচ্ছিন্ন কোন মানুষ নই । ফলে আমাকে কেন্দ্র করে যে কোন ঘটনার একটি সামাজিক ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া থাকে । সেদিন গ্রাম থেকে আমার এক আত্মীয় আসেন । তিনি জানান, আমার চাকরি চলে যাওয়াতে তাঁরা খুব মর্মাহত । তাঁদের বুকের বল একদম কমে গেছে । তিনি আরও জানান, এলাকায় আমার শত্রু গোছের যারা আছেন, তাঁরা মহাখুশী । কারা আমার শত্রু তাঁদের নামও তিনি উল্লেখ করেন । আমার শত্রুগন আমার ক্ষমতা চলে যাওয়ার কারণে খুশী হয়েছেন । যিনি এসেছেন তিনি আমার মিত্র পক্ষের । মিত্রপক্ষ দোয়া করছেন, সরকার যেন তাড়াতাড়ি আমাকে চুক্তিভিত্তিক কোন কাজ দিয়ে দেন ।
আমার আত্মীয় লোকটি চলে যাওয়ার পর কয়েকটি প্রশ্ন আমার মাথায় ঘুরপাক খায় ।
১। আমি কি এখন বেকার ?
২। আমার চাকরি কি চলে গেছে ?
৩। সমাজে কি আমার শত্রু আছে ?
থাকলে কেন ?
আমি নিজের মত করেই এ সব প্রশ্নের জবাব পাওয়ার চেষ্টা করি ।
প্রথমে ৩ নম্বর প্রশ্ন । সমাজে কি আমার শত্রু আছে ? থাকলে কেন ?
আমার মনে হয়, এ প্রশ্ন একেবারেই অবান্তর । কারণ পৃথিবীর সর্বজনস্বীকৃত ভালো মানুষ ছিলেন হজরত মহাম্মদ (সঃ) । তাঁকেও পাথর ছুড়ে ক্ষতবিক্ষত করা হয়েছে । ফলে যারা মনে করেন, তাঁদের কোন শত্রু নেই; তাঁরা বোকার স্বর্গে বাস করেন ।
কিন্তু আমার নিজের কাছে প্রশ্ন,
আমি কি কখনও কারো কাছে আমার চাকুরীর ক্ষমতা দেখিয়েছি ?
যদি না দেখিয়ে থাকি, তাহলে আমার ক্ষমতা চলে যাওয়ার কারণে মানুষ খুশী হবে কেন ?
এখানে এ বিষয়ে একটা ঘটনার কথা উল্লেখ করা যেতে পারে । একবার একটা দাপ্তরিক কাজে আমি একটা জেলা শহরে ছিলাম । হটাৎ হাত থেকে আমার চশমাটি পড়ে ভেঙ্গে যায় । চশমা ছাড়া কিছুই দেখিনে আমি । একজন অফিস প্রধান আমাকে তাঁর গাড়িটি দেন । আমার সাথে তখন সেই শহরে থাকা আমার এক তরুন আত্মীয় তাঁর কয়েকজন বন্ধুসহ ছিলেন । তাঁদেরকে গাড়িতে নিয়েই আমি চশমার দোকানে যাই । আমি ফেরার সময় সেই দোকানি আমার আত্মীয়ের কাছে আমার পরিচয় জানতে চান । দোকানীর প্রশ্ন ছিল, যে অফিস প্রধানের গাড়ি আমি নিয়ে গেছি, আমি নিজে সেই অফিস প্রধান কিনা ?
আমার সেই আত্মীয় জবাব দেন, ‘না । ইনি তাঁর বাবা’ ।
তারমানে সেই অফিস প্রধানের থেকে অনেক বেশী ক্ষমতার মানুষ আমি ।
কথাটি পেছন থেকে আমার কানে আসে । আমি মনে মনে খুবই বিব্রত হই । কারণ, সেই অফিস প্রধান আমাকে গাড়িটি দিতে মোটেও বাধ্য ছিলেন না । অনেকটা ভদ্রতার খাতিরে তিনি তাঁর গাড়ি আমাকে দিয়েছিলেন । আমার আত্মীয়ের সেই মন্তব্য তাঁর গাড়িচালক যদি তাঁর সাথে শেয়ার করে থাকেন, তাহলে তিনি আর কখনও কাউকে এভাবে গাড়ি দেওয়ার কথা নয় । উপরন্তু মনে মনে তিনি আমার শত্রু হয়ে যাবেন । এভাবে আমাদের গুনধর আত্মীয়স্বজনের কারণে আমার মত উচ্চপদে থাকা মানুষের কত যে অহেতুক অজানা শত্রু তৈরি হয়, তা আমরা জানতে পারিনে ।
আমার বাসায় আসা আত্মীয় আমার কয়েকজন শত্রুর নাম উল্লেখ করেন । ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগরের শত্রু চেনার একটা ফর্মুলা ছিল । তিনি কারো কোন ধরণের উপকার করলে তা লিখে রাখতেন । ফলে কেউ কোন শত্রুর কথা বললে, সাথে সাথে তিনি তাঁর নোটবই খুঁজে দেখতেন । নোটবইয়ে লোকটির নাম পাওয়া গেলে, তিনি নিশ্চিত হতেন লোকটি সত্যই তাঁর শত্রু । তিনি মনে করতেন, একজন বাঙালীকে কোন উপকার করলে, কেবলমাত্র তখনই তিনি তাঁর শত্রু হন। উপকার না করলে কেউ কারো শত্রু হয় না । এ কথার সত্যমিথ্যা আমার জানা নেই । তবে আমার স্বভাব বিদ্যাসাগর মহাশয় এঁর সম্পূর্ণ বিপরীত । আমি কারো জন্য কিছু করলে শতভাগ সম্প্রদান কারকে করি । এ বিষয়ে কারো নাম আমি মনে রাখতে চাই নে । আমাকে কেউ শত্রু মনে করে কিনা তা জানার প্রয়োজনও আমার নেই । আমার সুযোগ থাকলে যে কেউ আমার সাহায্য পেতে পারেন ।
পরের প্রশ্ন, আমার চাকরি কি চলে গেছে ?
১৯ জুন, ২০২১ । ইস্কাটন, ঢাকা ।
(দুই)
আমার আগের লেখাটি অনেকে পড়েছেন এবং তাঁদের মূল্যবান মতামত দিয়েছেন ।
এজন্য আমি কৃতজ্ঞ । আমার লেখায় একটা প্রশ্ন ছিল ।
সমাজে কি আমার শত্রু আছে ? থাকলে কেন ?
এ প্রশ্নের জবাবে শত্রু থাকা নিয়ে কেউ কোন ভিন্নমত পোষণ করেননি । কিন্তু কেন আমার মত উচ্চপদে থাকা মানুষের শত্রু তৈরি হয়, সে বিষয়ে অনেকেই সুচিন্তিত মতামত দিয়েছেন । একজন ফেসবুক বন্ধু এ জন্য আমাদের সমাজকে দায়ী করেছেন । তিনি বলেছেন, কথা সাহিত্যিক শরৎচন্দ্র সমাজের যে চিত্র এঁকেছেন, তার কোন পরিবর্তন এখনো আসেনি । শরৎচন্দ্র ১৯৩৮ সালে মৃত্যুবরণ করেন । সংগত কারণেই তাঁর আঁকা সমাজের ছবি সেই ব্রিটিশ আমলের । ফেসবুক বন্ধুর মতে, আমাদের সেই ব্রিটিশ আমলের সামাজিক মানসিকতা এখনও রয়ে গেছে ।
আর একজন ফেসবুক বন্ধু বলেছেন, সমাজে কোন ভালো কাজ করলেই শত্রু সৃষ্টি হয় । একটু উপরে উঠলেই শত্রু সৃষ্টি হয় । তিনি একজন প্রাক্তন সচিব । তিনি উদাহরণ দিয়ে দেখিয়েছেন, তাঁর পদোন্নতির সাথে সাথে তাঁর শত্রু সংখ্যা বেড়েছে । অন্য একজন ফেসবুক বন্ধু ক্ষমতায় থাকা মানুষের নিজের আত্মীয়স্বজন তাঁর শত্রুতা বৃদ্ধির উল্লেখযোগ্য কারণ বলে অভিমত ব্যক্ত করেছেন ।
আমাদের সমাজে ক্ষমতা নিয়ে আলোচনা অতি সাধারণ বিষয় ।‘তুই আমাকে চিনিস’? বা ‘তুই আমাকে চিনিসনে’ - এ ধরণের কথা কখনও বলেনি, এমন মানুষ আমাদের সমাজে নেই । এখানে ‘আমি’ অন্যজনের বেশী ক্ষমতাবান এটাই বোঝান হয় ।
‘সচিব বড় না, এমপি বড়’ ? , ‘ডিসি বড়, না এসপি বড়’ ?, ইউএনও বড়, না ওসি বড় ?’ গ্রামের সাধারণ মানুষের কাছে এ সব প্রশ্ন আমি জীবনে অনেক বার শুনেছি ।
এখানে ‘বড়’ বলতে, কে ক্ষমতায় বড়ো, তাই জানতে চাওয়া হয় ।
এ ধরণের প্রশ্ন শুনলে আমার খুব দুঃখ পায় । মানুষ সহজাত বিচারবুদ্ধি নিয়ে জন্মগ্রহন করে । পবিত্র কোরানের মর্ম অনুযায়ী শিক্ষিত অশিক্ষিত যে কোন মানুষকে ভালো মন্দ এবং ন্যায় অন্যায় বোঝার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে । ফলে অন্য কাউকে এসব প্রশ্ন জিজ্ঞাসা না করে একজন মানুষ নিজেকেই এসব প্রশ্ন করতে পারে । যেমনঃ
হাতের বুড়ো আঙ্গুল বড় ? না, কনিষ্ঠ আঙ্গুল বড় ? মধ্যমা আঙ্গুল বড় ? না, তর্জনী আঙ্গুল বড়?
এখানেও বড় বলতে কোন আঙ্গুল ক্ষমতায় বড়ো তাই জানতে চাওয়া হয়েছে । ক্ষমতার বিষয়ে যদি নিজের আঙ্গুলের কথাও বলা হয়, তাহলে কি কোন আঙ্গুলকে ক্ষমতাহীন বলে বাদ দেওয়ার সুযোগ আছে ? ক্ষমতার বিচারে পাঁচ আঙ্গুলের গুরুত্ব সমান নয় কি ?
ক্ষমতা নিয়ে বিতর্ক শুধু যে গ্রামে হয়, তা নয় । জাতীয় পর্যায়েও একই বিতর্ক ।
প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রী বড়, না পররাষ্ট্র মন্ত্রী বড় ? পুলিশের আইজি বড়, না সুরক্ষা সচিব বড় ?
বাংলাদেশ সরকারের একটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রা আছে । চলমান করোনার অভিশাপ কাটিয়ে ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ একটি উন্নত দেশে রুপান্তরিত হতে চায় । সেই লক্ষ্য অর্জনের জন্য সকল দপ্তর সংস্থার সমান গুরুত্ব রয়েছে । এখানে কাউকে ছোট, বা বড় ভাবার সুযোগ আছে কি ?
কিন্তু বাস্তবে এই সহজ সরল যুক্তি গ্রামের মানুষ যেমন বোঝেন না; জাতীয় পর্যায়ে আমাদের মত শিক্ষিত মানুষেরাও কেন যেন তা বুঝতে চান না ।
আমার লেখায় পরের প্রশ্ন ছিল, আমার চাকরি কি চলে গেছে ?
একজন ফেসবুক বন্ধু এ প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন ।
তিনি বলেছেন, চাকুরী থেকে অবসরে যাওয়া মানে, চাকরি চলে যাওয়া নয় ।
কিন্তু, আমার প্রশ্ন,
আমার গ্রামের মানুষ কি এই উত্তর জানেন না ?
একটি মানব শিশু জন্মের পর থেকেই কথা বলার চেষ্টা করে । এক সময় আধো আধো বোলে কথা বলে । তারপর সম্পূর্ণ কথা বলা শিখে যায় । কিন্তু বাস্তবে আমাদের অনেকেই কখন, কোথায়, কি কথা বলতে হবে তা সারাজীবনেও শিখতে পারেন না । একথা যেমন সত্য; অন্য একটি কথাও একইভাবে সত্য ।
অন্যকে রাগিয়ে দেওয়া বা প্যাঁচমারা কথা আমাদের সমাজে কমবেশী সবাই খুব ভালো বলতে পারেন । এমন মানুষ আমি অনেক দেখেছি, যারা কাউকে খোঁচা না দিয়ে কোন কথা বলতে পারেন না । কথা বলার এই কূটকৌশল আমাদের গ্রামের মানুষেরা যেমন জানেন, শহরের মানুষেরাও এটা থেকে মুক্ত নয় । আমাদের সমাজে পারস্পারিক হানাহানি এবং আস্থাহীনতার মূলে কাজ করে এই কথাবলার কূট- কৌশল ।
যেমনঃ আমি অবসরে গেছি আমার গ্রামের মানুষ এটা ভালো করেই জানেন । এটা না বোঝার কোন কারণ নেই । কিন্তু আমি অবসরে গেছি, এই কথা বলে আমাকে দুঃখ দেওয়া বা উত্তেজিত করা সম্ভব নয় । কিন্তু যদি বলা হয়, আমার চাকরি চলে গেছে, তাহলে অবশ্যই আমার মধ্যে একটা প্রতিক্রিয়া হবে । সত্যই সেটা হয়েছে । তার প্রমাণ এই লেখা । এটা সত্য যে, সেই কথার সূত্র ধরেই এ লেখার শুরু । মানুষের মন ভালো করার কথা আমাদের সমাজের মানুষ তেমন একটা না জানলেও, কি করে মানুষের মধ্যে ঝামেলা বাঁধানো যায়, সেটি তাঁরা খুব ভালো করেই জানেন । কিন্তু দীর্ঘদিন থেকে চলমান এই সমস্যা প্রকট মনে হতে পারে; তবে সবাই আন্তরিক হলে, অভ্যাসের একটু পরিবর্তন আনা গেলে এ সমস্যার সমাধান সম্ভব ।
এখানে আমি একক কোন ব্যক্তি নই । আমি এই সমাজের একজন । আমার গ্রাম একক কোন গ্রাম নয় । দেশের ৮৭ হাজার ১৯১ টি গ্রামের একটি গ্রাম আমার গ্রাম । এখানে জনজীবনের একটি চিত্র তুলে ধরা হয়েছে – যে চিত্র আমূল পরিবর্তন সম্ভব । সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রত্যেক গ্রাম থেকে কিছু ছেলেমেয়ে এগিয়ে এলে, সুনির্দিষ্ট গাইড নিয়ে কাজ করলে সুফল পাওয়া যাবে ইনশাল্লাহ ।
(চলবে)
২০ জুন, ২০২১ । ইস্কাটন, ঢাকা ।