মোঃ শফিকুল আলম
অস্ট্রেলিয়ায় বাংলাদেশী ব্যবসায়ীদের নিয়ে সমকালীন বিতর্কের যৌক্তিকতা কতটুকু ?
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ৩ জুন,বৃহস্পতিবার,২০২১ | আপডেট: ১০:২৯ এএম, ১৯ ডিসেম্বর,বৃহস্পতিবার,২০২৪
অস্ট্রেলিয়ায় স্বচ্ছ বিধি বিধান বাংলাদেশী অস্ট্রেলিয়ানদের ব্যবসায়-বানিজ্যে যেমন সফলকাম করছে; তেমন অনেকে আবার মেইন স্ট্রীম পলিটিক্সেও উৎসাহিত হচ্ছেন দেশের আইন-কানুন সহজবোধ্য এবং স্বচ্ছ কাঁচের মতো পরিষ্কার। দিনের ভেতরেই অনলাইনে একটি প্রোপ্রাইটরি লিমিটেড কোম্পানী প্রতিষ্ঠা করা যায়। ব্যবসায় ঝুঁকি থাকে। ঝুঁকি মোকাবেলায় ইন্সিউরেন্স থাকা আবশ্যক। ব্যবসায় যেমন লাভ হবে; তেমনি লোকসান হতে পারে; দায় বা দেনা তৈরী হতে পারে। ব্যবসায় পরিচালনায় ব্যর্থ হলে ব্যবসায় বন্ধ করে দিতে হতে পারে। এসব বিবেচনা থেকে পাবলিক লাইয়াবিলিটিজ ইন্সিউরেন্স, ওয়ার্কার্স কমপেনসেশন ইন্সিউরেন্স ইত্যাদি না থাকলে এখানে কেউ ব্যবসায় শুরু করতে আইনত: অনুমোদন পায়না। প্রতিটি বিষয়ে যেমন কমনওয়েলথ ল’ রয়েছে; তেমন স্টেটগুলোরও আলাদা আলাদা আইন রয়েছে। তবে কোনো স্টেটের আইন কমনওয়েলথ এর আইনের সাথে কনফ্লিক্ট করতে পারেনা। সেক্ষেত্রে কমনওয়েলথ এর আইন ডোমিনেট করবে।
সকল আইন অনুসরন করেই অন্যান্যদের মতো বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত অস্ট্রেলিয়ানরা রেঁস্তোরা, ক্লিনিং, রিয়াল স্টেট এজেন্সী, ডেভলপারস বিজনেস, ক্লিনিক, গ্রোসারীজ ইত্যাদি প্রতিষ্ঠান তৈরী করে ব্যবসায় করছেন। অনেকেই প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন। আবার অনেকে পাননি। কোভিড প্যানডেমিকের সময়ে অনেকের মতো বাংলাদেশীদের অনেকের ব্যবসায় বন্ধ করে দিতে হয়েছে। বন্ধ করতে হয়েছে অনেক প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানও। ব্যবসায় শুরু করা এবং বন্ধ করে দেয়া দু’টোই আইন অনুসরন করে হয়ে থাকে। ব্যবসায় বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারনে ক্ষতিগ্রস্ত পক্ষ ইন্সিউরেন্সের মাধ্যমে ক্ষতিপূরন পেয়ে থাকেন।
এদেশের সাংসদগন শুধুই সংসদে আইন প্রনয়ন করে থাকেন। বিনিময়ে জনগনের ট্যাক্সের পয়সায় উচ্চ হারে বেতনভাতা পেয়ে থাকেন। আইন প্রনয়ন করতে গিয়ে রীতিমত তাঁরা তাঁদের মেয়াদকালীন অধ্যায়ন এবং গবেষনায় লিপ্ত থাকেন। তাইতো সকল পক্ষের কথা চিন্তা করে আইন প্রনীত হয়ে থাকে। একজন ব্যবসায় প্রতিষ্ঠা করলে একাধিক জনের কর্মসংস্থান হয়ে থাকে। অর্জিত অর্থের বীপরীতে ট্যাক্স প্রদান করে থাকেন। ট্যাক্সের অর্থ ওয়েলফেয়ারে ব্যয়িত হয়। সে কারনেই ব্যবসায়ীদেরকে প্রতিষ্ঠান গড়ার আগ্রহ সৃষ্টিতে যেমন আইন প্রনীত হয়; আবার ব্যবসায় পরিচালনায় ব্যর্থ হলে যাতে ব্যবসায় সহজে বন্ধ করে দিয়ে এক্সিট করতে পারেন আইনে সে ব্যবস্থাও রয়েছে।
উন্নত বিশ্বের ক্যাপিটাল মার্কেট এবং প্রোপার্টি মার্কেট সবচাইতে ঝুঁকিরূর্ণ ব্যবসায়। কোভিড প্যানডেমিকে এ দু’টি মার্কেট ওভারঅল বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। দু’য়েকজন বাঙ্গালীর ব্যবসায় বন্ধ হয়েছে এবং হচ্ছে বলে শোনা যাচ্ছে। অধিকাংশ মার্কেট রিপেয়ার্ড হওয়াতে ঘুরে দাঁড়িয়েছেন। যারা ব্যবসায় বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছেন তাদের সাথে সম্পৃক্ত ব্যবসায়ী এবং ভোক্তারাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। তাদের অনেকেরই কাঙ্খিত বাড়ীটি সময় মতো নির্মিত হয়নি। ভাড়া বাড়ীতে দীর্ঘ সময়ের জন্য ভাড়া পরিশোধ করতে হচ্ছে। ব্যাংকের সুদ পরিশোধ করতে হচ্ছে।
যে সমস্ত বিল্ডার তাদের প্রতিষ্ঠান দেউলিয়া ঘোষনা করেছেন তারা সেটি দেশের আইন অনুসরন করেই হয়তো করেছেন তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ থাকার কারন নেই। এই ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের তাদের পরিচালনায় নির্মানাধীন অসম্পূর্ণ বাড়ীগুলোর অসমাপ্ত কাজ তা’হলে কিভাবে সম্পন্ন হবে? এই কাজ এখন আইনত: ইন্সিউরেন্স কোম্পানি সম্পন্ন করে দিবে। এ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে আরও বাড়তি সময় নষ্ট হবে।
বাংলাদেশী কমিউনিটির মধ্যে প্রচারনা রয়েছে এই দেউলিয়া ঘোষিত বিল্ডারগন বাড়ী করার বিপরীতে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার প্রতারনা করেছেন। অনেকে আবার প্রশ্ন করছেন সেটি কি এদেশে সম্ভব? যে দেশে একটি স্টেটের প্রিমিয়ার এক বোতল মদ উপহার নিয়ে সংসদের গিফট রেজিস্টারে এন্টি না করায় পদত্যাগ করেন সেদেশে বাংলাদেশী বিল্ডার কি করে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার প্রতারনা করে জেইল এসকেপ করবেন?
এসব দেশে বাড়ীর ব্যাংকলোন যতোক্ষণ পর্যন্ত পরিশোধ না হয় ততোক্ষণ পর্যন্ত বলা যায় বাড়ীটি লীজ(পার্চেইজ লীজ) নেয়া হয়েছে। বাড়ীটি ব্যাংকের কাছে মর্টগেইজড থাকে। লোন সম্পূর্ণ পরিশোধিত হলেই শুধু পার্চেইজড হয়েছে বলা যাবে। জমি কিনে যখন বিল্ডার দিয়ে বাড়ী নির্মান করানো হয় তখন কি বাড়ী তৈরীতে যে অর্থ ব্যয়িত হবে বলে অনুমিত হয় তার পুরোটা বিল্ডারকে আগাম দেয়া হয়? কে এতো পরিমান অর্থ এক সংগে পরিশোধ করেন? না, জমি যেমন ব্যাংকলোনে কেনা; বাড়ী নির্মান ব্যয়ের বিপরীতেও তেমনি ব্যাংকলোন নেয়া হয়ে থাকে। ব্যাংক লোন অনুমোদন করলেই কি আমার এ্যাকাউন্টে সব টাকা চলে আসে? এবং আমি সব তুলে বিল্ডারকে দিয়ে দিলাম। এবং বিল্ডার আমার টাকা এবং অনেকের টাকা মিলে মিলিয়ন মিলিয়ন মেরে দিলেন!! বিষয়টা কি এরকম? সাম্প্রতিক কমিউনিটি গসিপে এরকমটাই মনে হবে। যারা সব জানেন তারাও আবার এসব গসিপে এ্যাকটিভলি পার্টিসিপেট করছেন।
আসলে বিষয়টি এরকম নয়। বিল্ডারের সাথে জমির মালিকের চুক্তি হয়। চুক্তি অনুযায়ী ফেইস বাই ফেইস কাজ সম্পাদিত হলে পরে জমির মালিক সায় দিলে এবং ব্যাংক যখন নিশ্চিত হয় নির্দিষ্ট ফেইসের কাজ সম্পন্ন হয়েছে তখনই কেবল অনুমোদিত ঋণের নির্দিষ্ট অংশ বিল্ডার বরাবরে পরিশোধ করে থাকে। এক্ষেত্রে যথেষ্ট চেক এন্ড ব্যালেন্স কাজ করে। সুতরাং কোনো বিল্ডারের পক্ষেই মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার প্রতারনা করে রেহাই পাবার সুযোগ নেই।
তবে সুযোগ আছে। কার ক্ষেত্রে সেটি হতে পারে? বাংলাদেশে দুর্নীতি করে অর্জিত অর্থ হুন্ডির মাধ্যমে এনে কোনো পরিচিতজনের মাধ্যমে পুরো ক্যাশ বা এস্টিমেটেড এ্যামাউন্টের উল্লেখযোগ্য অংশ বিল্ডারকে অগ্রিম প্রদান করে থাকলে বিল্ডার সে সুযোগ গ্রহন করে থাকতে পারেন। সে ক্ষেত্রে এই মিডলম্যানরাও একটা কমিশন গ্রহনের কারনে বিল্ডারদের সহযোগী হিসেবে কাজ করে থাকেন। পরে যখন বিল্ডার কথা রাখেননা তখন মিডলম্যান ধরাশায়ী হয়ে কমিউনিটিতে প্রচার করতে থাকেন বিল্ডার মিলিয়ন মিলিয় ডলার প্রতারনা করে ব্যবসায় বন্ধ করে দিয়েছেন। এটি প্রচারনা করা যায়; প্রমান করা যায়না। ফলে কমিউনিটির সৎ এবং নিষ্ঠাবান উদ্যোক্তাগন এই নেতিবাচক প্রচারনায় ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা তৈরী হয়। কারন এই সমস্ত নেতিবাচক প্রচারনার ফলে বাঙ্গালী বিল্ডার দিয়ে কোনো বাঙ্গালী বাড়ী নির্মানে আগ্রহী হবেননা। বাঙ্গালী বিনিয়োগকারীগন প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে যাবেন। বাড়ীর মালিকের অনুমতি ব্যতিরিকে, ব্যাংক কর্তৃপক্ষের সন্তুষ্টি ছাড়া মিলিয়ন মিলিয়ন ডলারের প্রতারনা করা একেবারেই অসম্ভব।
কমিউনিটিতে এই ধরনের অবিবেচক নেতিবাচক প্রচারকগনের অপপ্রচারে বিভ্রান্তি তৈরী হতে পারে। আমাদের উচিত হবে যদি কেউ সত্যি সত্যিই ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকেন তবে তারা ফেয়ারট্রেডিংসহ যথাযথ আইনী কর্তৃপক্ষের কাছে প্রতিকার চাইবেন। আমরা গল্প তৈরী করতে পারবো। সহানুভূতি প্রকাশের নামে দু’কলম লিখে আমার প্রচার করতে পারবো; কিন্তু আপনি যিনি প্রকৃতপক্ষে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তার কোনো উপকারে আসবোনা। অপরদিকে আমার মিথ্যা সহানুভূতির প্রকাশ সৎ, নিষ্ঠাবান বিনিয়োগকারীকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। আসুন আমরা সবকিছু ইমোশনাললি না দেখে রেশেনাললি দেখি।